উইমেন (সামাজিক,মানসিক,সুবিধা বঞ্চিত নারী)

জেন্ডার স্টাডিজ – ৩ (রোকেয়া-কথন)

জেন্ডার স্টাডিজ – ৩ (রোকেয়া-কথন)

বেগম রোকেয়া এমন একজন মানুষ, আগামী সম্ভবত আরও এক শতকে ত্যাগ, প্রজ্ঞা এবং জ্ঞানে যার তুলনা পাওয়া কঠিন হবে। প্রচলিত রীতিতে কিন্তু তাঁকে স্মরণ করতে গিয়ে আমরা প্রায়ই দ্বিধান্বিত হয়ে যাই। তিনি একজন বিশাল মানুষ, যার প্রমাণ হল তাঁর ব্যপারে তার গুণগ্রাহী কিংবা সমালোচকদের চিন্তার বৈচিত্র্য। তাঁর সুপরিসর কর্মক্ষেত্রকে তাঁর পরের সময়ের মানুষ পুরোটা বুঝতে সক্ষম না হতেই পারে, যার ফলে জন্ম হয় খন্ডিত ধারণার।


বেগম রোকেয়া একটি উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। একজন বিপ্লবী কখনও লেখায় নিজেকে প্রকাশ করেন, কখনও কাজে দেখান, আবার কখনও তাঁর মতবাদের আদলে মানুষ তৈরী করেন।অথচ হিসেব করে দেখতে গেলে, একজন মানুষের জীবনে যতগুলো আকষ্মিকতা আসতে পারে বা আসা সম্ভব, তার সবগুলোই এই মানুষটির জীবনে এসেছে। অকালে পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যাওয়া, কিশোরী বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়া, নিঃসন্তান দাম্পত্য, মাত্র এগারো বছরেই বিবাহিত জীবনের সমাপ্তি এবং এরপর লেখালিখির জন্য নারী পুরুষ নির্বিশেষে সমাজের অচল অংশের তীব্র সমালোচনা, এই সবকিছুকে কি সাধনায় শক্তি তে পরিণত করেছেন তিনি, এটি গবেষণার দাবিদার। এবং জীবনের ঝুলিতে জমা করেছেন, দার্শনিক, কর্মী, সমাজ গবেষক, সুংস্কারক এবং সুলেখিকার সুনাম। তাঁর এই বিপ্লব সর্বাত্নক, সর্বমুখী।


বেগম রোকেয়া নারীবাদী ছিলেন, এই কথাটি যেমন সত্য, তিনি নারীকে মানুষ ভেবেই মানবতাবাদের জয়গান গেয়েছেন এটিই সবচেয়ে বড় সত্য। এজন্য তাঁকে নারীকে সর্ববিদ্যায় পারদর্শী অতিমানব বানাতেও হয়নি, আবার পুরুষকে চরম শত্রু হিসেবে দেখিয়ে তার ‘বিরুদ্ধে’ নারীকে উজ্জীবিত করতেও হয়নি। তথাকথিত আক্রমণাত্নক নারীবাদের পথ তিনি সযত্নে পরিহার করেছেন। লেখায়, কাজে, সাধনায় নারীদেরকে আত্নশক্তির চর্চা শিখাতে চেয়েছেন। নিজের হাতে ধরে তাদের দেখিয়েছেন, সে ও হাত-মা-মুখ-মাথা সম্বলিত মানব সন্তান।


বেগম রোকেয়াকে ‘নারীবাদী’ কেন বলবো, সেটা জানার আগে দরকার নারীবাদের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে চিন্তা করা। নারী নামক সমাজের যে অংশ যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গঠনের জন্য পৃথক, সেই বৈশিষ্ট্যের জন্য তাকে অবদমিত করা, অবমাননা অবহেলার চরম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার বহুল প্রচলন আছে এ সমাজেই। একটা সময়ে নারীকে মানুষের পর্যায় থেকে নামিয়ে ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ বানিয়ে দেয়া হয়, যে অবস্থা এখনও অনেকাংশেই বর্তমান। শুধুমাত্র কিছু শারীরিক বৈশিষ্ট্যের জন্য নিজেকে প্রভু ভেবে জেঁকে বসা পুরুষ একটা সময়ে এই সামাজিক রীতিনীতিকে রাষ্ট্রীয় বিধানে পরিণত করেছে। এখানে ‘পুরুষ’ শব্দটি কোন লিঙ্গের প্রতিনিধি নয়, বরং মানব থেকে অমানবিক হয়ে ওঠার দরজা।


নারীর গঠন বৈশিষ্ট্য থেকে ফায়দা নেয়া এবং নিজের আসনে থেকে নারীকে পুতুল নাচিয়ে মানবাধিকারের সমান জায়গাটি থেকে নারীকে নামিয়ে দেয়াই এই অমানবিকতার প্রথম ধাপ ছিলো। ‘মুনাফা’ নামক সর্বনাশা নেশায় এখন মানুষ সার্বিকভাবেই সরে এসেছে মানবিকতার সম্মানিত আসন থেকে। এই আধুনিকতার পাতলা এবং চকচকে আবরণের অন্তরালে রয়েছে অসংখ্য শ্রমিকের আর্তনাদ, খেটে খাওয়া মানুষের গলদেশে আত্নহ...র জোয়াল। আর নারী সেখানে সবচেয়ে বেশী অসহায়, তার কোলে অসহায় তার শিশু। কারণ সৃষ্টির সময়েই নারীকে নমনীয় অথচ বাড়তি অঙ্গানুতে সজ্জিত করে পাঠানো হয়েছে, কেবলই মানবজাতির পরম্পরা রক্ষার জন্য। নারী খুব কমই পারে ঝুঁকিপূর্ন এই অবস্থান থেকে নিজেকে, নিজেদেরকে বের করে আনতে, নিদেনপক্ষে জোর দাবী তুলে শব্দও করতে পারে কি? জবাব হল, না, পারে না। সভ্যতার নির্মম চাকা, পুরুষতান্ত্রিকতার ঋণাত্নক চর্চা, পুরুষকে তো বটেই, কখনও নারীকেও পুরুষতন্ত্রের অশুভ বাহন করে তোলে।


বেগম রোকেয়া নারীকেই জাগাতে চেয়েছেন, ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে চেয়েছেন তার ভেতরে প্রোথিত ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’সুলভ দাস মনোভাবকে, তার ভেতরে অসাবধানে গ্রন্থিত পুরুষতান্ত্রিকতাকে। ভাবতে অবাক লাগে, যেসময় সমাজ কেবল শিক্ষিত হয়ে উঠছে, উপমহাদেশ তখনও রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে সুষ্পষ্ট সংজ্ঞায় পৌঁছতে আপ্রাণ লড়াই করে যাচ্ছে, সেখানে কি করে একজন ‘অবরোধবাসিনী’ ‘সুলতানার স্বপ্ন’র মতো রচনা লিখতে পারেন? কল্পনা করতে পারেন এমন একটা জগতের, যেখানে পুরুষ নেই? কেউ ভুল বুঝতে পারেন, বুঝেওছেন নির্বিচারে। তখনকার সময়ে বেগম রোকেয়াকে, তাঁর লেখাকে একঘরে করেও রেখেছিলেন। অথচ পুরুষকে তিনি অপ্রয়োজনীয় প্রমাণ করতে চান নি, ‘নারীস্থান’এর স্বপ্ন দেখেছেন, দেখিয়েছেন নারীকে। তাকে জানাতে চেয়েছেন, তুমি পারো। নিজেকে জানো। তোমার চারপাশ আলোয় ভরিয়ে দাও, নিজেকে ‘মানুষ’ ভাবো।


এখন দুই ঘরানার চিন্তার কথা বলবো। প্রথম ধরণের চিন্তা, যারা নারীবাদকে উগ্রতার জানালা দিয়ে চিনেছেন, তাঁদের। এরা তথাকথিত নারীবাদের আঁচল পরেন। আসুন তাঁদের দিকে তাকাই। নারীর ভোটাধিকারের মত মৌলিক দাবীকে উপস্থাপন করতে গিয়ে মূলত এ নারীবাদের সূচনা,অথচ তার বর্তমান রূপ কেমন? এরা নারীর উগ্রতার আড়ালে তৃপ্তির ঢোক গিলতে চান, নারীকে কেবল ঘরছাড়া করতেই নারীবাদের ট্যবলেট বানাচ্ছেন। নারীর ক্ষমতায়নের টিকিট বিক্রি করে যাদের বৈদেশিক মুদ্রার আমদানী বাড়াতে হয়, তাঁদের মুখে আমরা শুনি, বেগম রোকেয়া নারীবাদী ছিলেন! ভালো কথা। কিন্তু ‘কিসের ঘর, কিসের বর’ বলে তাঁরা যখন নারীকে গৃহচ্যুত করে ভাগাড়ে নিক্ষেপ করতে চান, তখন রোকেয়ার ‘জাগো গো ভগিনী’ শ্লোগানকে ব্যবহার করা বড় অশ্লীল, অযুক্তিযুক্ত এবং অন্যায় হয়, দৃষ্টিকটুও লাগে। এই বোধ সম্ভবত তাঁদেরকে আলোড়িত করে না। এই ঘরানার নারীবাদীদের নিয়ে আলোচনা অপ্রয়োজনীয়। নারী যখন যৌতুকের জন্য নির্যাতিত হয়, সেখানে তাঁরা ক্ষীণ কন্ঠ তোলেন বটে। কিন্তু শিক্ষাগত বা বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতাকে পাশ কাটিয়ে নারীকে যখন অপ্রতুল পোশাকে বিনোদনের মাধ্যম বানানো হয়, নারী যখন এই ক্লেদাক্ত জগত থেকে ফিরতে না পেরে আত্নহননের পথ বেছে নেয়, তখন এই নারীবাদ যায় শীতঘুমে। সুতরাং নারীর জেগে ওঠার আয়োজনে আজকের নারীদের জন্যে নারীবাদ তথা নারীস্বাধীনতার এই মাকাল ফলটিকে চিনে নেয়া খুব দরকার। কারণ এই মতবাদের প্রবক্তারা নারীকে মনে, মননে শিক্ষিত করার আগেই কেবল ঘর ছেড়ে বের হবার তাড়া যোগান। যার আংশিক ফল হল, নারীর ঘরের কাজের আরও অধিক অবমূল্যায়ন। তিক্ত হলেও সত্যি, নারীর বাইরে আসার প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা। কিন্তু প্রসাধনচর্চিত মুখের পেছনে লুকানো মাথাগুলো ততটা আদর পায় না। আগে যে নারী ঘরে নির্যাতিত হতো, আজ সে নারী নিগৃহীত হয় কর্মক্ষেত্রে, চলার পথে।


আর এক ঘরানার মানুষ, বেগম রোকেয়ার নামেও শিউরে উঠেন। তাকে ধর্মবিরোধী ভাবেন। দু’টি বিষয় ভেবে দেখা উচিত। এক, বেগম রোকেয়া ধর্মের প্রচারক নন। ধর্মগ্রন্থে লেখা কোন নির্দেশের তিনি বিরোধিতা করেননি। তিনি শুধু প্রতিবাদ করেছেন মানুষের বিভিন্ন আচরণ, ধর্মের নামে চাপিয়ে দেয়া অযৌক্তিক নিয়ম কানুনকে। আর দুই, পৃথিবীর কোন যুক্তিবাদী ধর্মগ্রন্থ নারীকে পুরুষের চেয়ে ‘কম’ মর্যাদার অবমানব হিসেবে দেখায়নি। এই আত্নবিশ্বাস নিয়েই রোকেয়া লিখেছেন, জাগিয়ে তুলতে চেয়েছে নারীর মধ্যের মানুষটিকে, দায়িত্বে কর্তব্যে যে আগে মানুষ, পরে নারী।


আজকের দিনে, নারী অধিকার কিংবা নারীর ক্ষমতায়নের পথে যে ক’টি বাঁধা আছে, তার মধ্যে আত্নমর্যাদাবোধের অভাবও একটি বাঁধা। অবস্থাদৃষ্টে দেখা যায়, কেবল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা ঘরের বাইরে এসে কাজ করার সুযোগ পেলেই এই আত্নমর্যাদাবোধ নিজে থেকে তৈরি হয়ে যায় না। এর জন্য প্রয়োজন সুস্থ বেড়ে ওঠার পরিবেশ, মানবিকতার চর্চা এবং আগে মানুষ ও পরে পুরুষ বা নারী হিসেবে দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তোলা। আর এই কাজটি করার জন্য কাজ করতে হবে, শুধু নারীকেই নয়। বরং সমাজের প্রতিটি অংশকে। কারণ, পুরুষ যে সভ্যতাকে তৈরী করে, তাকে জৈবিক সংস্কৃতির রূপ দান করে নারী। সন্তানের বীজ পুরুষ রোপণ করেন ঠিকই, নারী তার নিজের মধ্যে সে সন্তানকে ধারণ করেন। লালন পালন করার মাধ্যমে ভবিষ্যতের জীবন যাপনের দর্শন তার মস্তিষ্কে গেঁঠে দেন। সুতরাং নারীকে পেছনে রেখে, কিংবা কেবল মনোরঞ্জনের মাধ্যম বানিয়ে রেখে কোন সভ্যতা সম্পূর্ণ হয়ে গড়ে উঠতে পারে না।


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
সম্পর্কিত ব্লগ