সকাল আটটায় ক্লাস ধরতে তাড়াহুড়া করে হল বের হলো তাসনিম।ক্লাসরুমে ঢোকার আগে,এক কাপ চা আর সিঙ্গারা মুখে গুজে, পানি খেতে খেতে তিনতলার ক্লাস রুমে ঢুকল সে।ক্লাস,আড্ডা,গল্পে মেতে রইল সে,তারপর,সেমিনারে পড়াশোনায় ডুবে গেল।
তাসনিম, এবার অনার্সে ভর্তি হয়েছে,বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে তার নতুন আবাস।বাবা,মা,দাদীকে ছেড়ে থাকতে বেশ ক'দিন খুব কষ্ট হয়েছিল।একটু একটু করে মানিয়ে নিয়েছিল নিজেকে।আব্বুর শাসন,মায়ের চোখে চোখে রাখার দিনগুলো থেকে কিছু মুক্ত-স্বাধীন চলার, এ দিনগুলো সে,উপভোগ করেছে।তবে,নিজেকে একা সব সামলে নিতে খুব চাপ নিতে হয়েছে।বাবা তো বারবার বলে দিয়েছেন,সব কিছু বুঝেশুনে করতে,দায়িত্বশীলতার সাথে করতে।আর যেই কথা তিনি সবসময় বলেন,"নিজে নিজের দায়িত্বশীল হওয়া,সবচে' কঠিন সেটাই তোকে পারতে হবে।"
মনে মনে তাসনিম ভাবে শাসন,বকা থেকে তো বাঁচা গেলো,ছুটির আগে তো কেউ নাগালে পাবে না।ফোনে একটু আধটু বকোনি,জারি সে,তাসনিম অকোপটেই হজম করে নেবে।ছোট্টমামাটা হয়েছে বিচ্ছু,ঢাকায় থাকেন,তিনি মাঝে মাঝে খোঁজখবর নেন।পরে বোনের কাছে রিপোর্ট করেন।
উফ,কি যন্ত্রনাদায়ক ছিলো প্রতিটা সকাল বেলা,কলেজে বের হওয়ার আগে,ভাত না খেয়ে যাওয়াটা প্রায় হারাম ছিলো।আম্মা বলতেন,এক লোকমা হলেও, খেয়ে তারপর,যাওয়ার নাম করবি,খালি পেটে থাকা কোন ভাল অভ্যাস নয়।"তাসনিম জোর করে,মুখে পুরতো খাবার, চোখ জুড়ে বড় বড় ফোটায় পানির ফোটা টপটপ করে জড়তো একটু আদুরে খামখেয়ালীপনা ছিল তার।কিন্তু,আম্মার রাগী মুখের দিকে তাকাতে সাহস হতো না। আব্বু সময় পেলে খাইয়েও দিতেন,তাসনিমও আব্বুকে খাইতে দিতো অফিসের কাজে যখন ব্যস্ত থাকতেন তিনি।ছোট্ট বোন তাসনুভা অবশ্য,খেতে দারুন পছন্দ করে,বাড়ির গাছের ফল,পুকুরের মাছ সব একা একা খেয়ে, একাই রাজত্ব করছে।
সারাদিন দৌড়ে বেড়ায় চঞ্চলা,এ কাজ সেকাজ,নতুনকে জানার আগ্রহে,খাওয়ার কথা মনে থাকে না তার।বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন বন্ধু জাকিয়া,শারমিন,মুন্নি ওদের নিয়ে,কাটে সাহিত্য আড্ডা,বেড়াতে যাওয়া,নতুন খাবার খেতে বেড়ানো।মুন্নি অবশ্য হলেই রান্না করে,সময়মতো না খেলে তার চলে না।বাকীরা নাক সিটকায়,ওকে নাম দিয়েছে,ভাতপ্রেমী।কি অদ্ভুত নামরে বাবা।আর জাকিয়া তো ক্যাম্পাসের আচার,ফুসকা,ভেলপুরির নাম বলতে অজ্ঞান,মুন্নি তো রোজ বকা দেয়।মাঝে মাঝে রান্নাও করে,আনে ওদের জন্য। শারমিন ক্যান্টিনে খায়,তবে ফাস্টফুডও পছন্দ একটু-আধটু।দুপুরে দাদীর ফোন,"খেয়েছিস,দাদুভাই?"এ প্রশ্নটা শুনতে তাসনিমের ভালো লাগে না।বলে,হু, খেয়েছি,তোমরা তো বাসায় মজার মজার খাবার খাও,আমি একা কি খাই বলতো।"দাদী বলেন,তাও দাদু ঠিকমতো খাবে,পড়াশোনায় ভালো করতে চাই বল,তাসনিম কথার মাঝে বলে,আমার অনেক শক্তি দাদু,চিন্তা করো না।মুন্নি, শারমিন দাড়িয়ে আছে,পড়ে ফোন করো।"দাদীর ফোন রেখে সে,লাইব্রেরীর দিকে বের হয়।
ছ'মাস পরের কথা,একদিন সকালে তাসনিম বের হয়েছে ক্লাসের উদ্দেশ্যে,আজ ওদের প্রেজেন্টেশন আছে।মনে মনে সে কথাগুলি আওড়াচ্ছে।কিন্তু, মাঝপথে এসেই বিপত্তি,কেমন মাথা ঘুরে এলো,সব চক্কর দিচ্ছে তার,তারপর,জ্ঞানশূন্য..ভ্যাগিস,তার হলের পরিচিত একজন ছিলো কাছেই,তাকে তুলে নিয়ে হসপিটালে নিয়ে গেলো,কললিষ্ট থেকে মুন্নি,শারমিনকে ফোন দিয়ে জানালো।স্যালাইন দেওয়া হয়েছে,শরীর খুব দূর্বল।মুন্নি,শারমিন এসে পড়ল দ্রুত,ছোটমামা চলে এসেছেন।একটু ধাতস্হ হতেই,মামা বললেন,"কি খেয়েছো সকালে,খাবার নিয়ে আসি! "তাসনিম মাথা নাড়াল।মামা,তার মানে,খাস নি কিছুই।কাল সারাদিনে কি খেয়েছিস বলত,তাসনিম মিথ্যা বলতে পারে না,ভয়ে ভয়ে বলে অস্ফুট আওয়াজে,সকালে কমনরুমে চা -সিঙ্গারা,দুপুরে পিজ্জা আর রাতে সবজি,ডিম দিয়ে ভাত খেয়েছিলাম।মামার এই জেরার অভ্যাস আর গেলো না,উকিল কি না।বললেন,"তোমরা বড় বড় ডিগ্রী নেবে,স্নাতক হবে,আর খাওয়াটাই,সঠিক মেইনটেইন করতে পারো না।কি আজব।"তাসনিমের অবস্হা খারাপ দেখে আপাতত কথা বাড়ালেন না,মুন্নি,শারমিনকে খাবার আনিয়ে দিলেন,ওকে খাওয়াতে বলে,ডাক্তারের রুমে আলাপ করতে গেলেন।
তাসনিম সুস্হ হয়ে রাতে ফিরলো,মামা তাকে বাসায় নিয়ে এসেছেন।ডাক্তার শুধু প্যারাসিটামল দিয়েছে,বলেছে টাইমলি খেতে।ওর মন খারাপ প্রেজেন্টেশন মিস হয়ে গেছে বলে,মামা বললেন,আজ না হয়,"প্রেজেন্টেশন মিস করলে,এরকম খাওয়া-দাওয়া করলে পরীক্ষা মিস করবে,তোমার আম্মাকে নালিশ করবো..."তাসনিম ভয়ে ভয়ে,আম্মুকে বলো না,মামা,প্লিজ...,।মামা বলেন,তাহলে ওয়াদা কর,সময়মতো খাবি,নিজের যত্ন নিবি,তাহলে বলবো না।মার্ক টোয়েন,কি বলছে মনে নেই,
"Part of the secret of success in life is to eat what you like and let the food fight it out inside."তাসনিম মামাকে থামিয়ে বলল,বিসিএস দিয়ে তোমার মাথাটা গিয়েছে,সুযোগ পেলেই, কোটেশন দাও।মামা হেসে বলেন,লাষ্ট অন,মিষ্টি ভাগনি আমার,Jess C. Scott বলেছিলেন,"A fit, healthy body—that is the best fashion statement."তোরা যে কি ভাবিস নিজেদের,নিজেদের শরীরের দিকেই নজর দিস না।মনের খবর,না হয় বাদই দিলাম।" মায়ের বকার কথা ভেবে মামা কথা,নিঃশব্দে হজম করতে হলো তাসনিমকে।
কিন্তু,হলে রুমে এসে যখন একা বসে ভাবলো, ছোট্টমামার কথা খুব মনে পড়ল,মনে পড়ল মায়ের সেই শাসনের কথাটি,"খালি পেটে একদম বের হবি না।"কতো যে কল্যাণের বিষয়টি,আজ সে অনুধাবন করলো।রাতে আব্বু কেন, জোর করে, ঘুম থেকে তুলে এনে খাওয়াতো,আজ সে টের পেলো,চোখের কোনে অশ্রু টপ করে পড়ছে কোন বাধা ছাড়াই।কিন্তু,বুকটা যে বড্ড শূন্য লাগছে,ডাক্তার বলেছে,স্টম্যাকে কিছুটা সমস্যা হয়েছে,ঠিকমতো খাদ্যভাস মেইনটেন করলে,সেরে উঠবে।টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে ঔষধ খেয়ে নিলো,আজ সে রাতের খাবার সময়মতো খাবে বলে ঠিক করলো।ক্যান্টিনের দিকে যাবে বলে,উঠে দাড়ালো,কিন্তু,মাথাটা কেমন ব্যথায় ঘুরে এলো ওর...কোন রকমে চেয়ার হাতড়ে বসতে বসতে প্রতীজ্ঞা করল,তাসনিম,নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি অনাচার করবে না,সুস্হতা আল্লাহর কতো বড়ো নিয়ামত,সেদিন হাসপাতালের বেডে থেকে কিছুটা হলেও উপলব্ধি করেছে সে।
                        
                                    
                                                
                                                
                                                
                                                
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)