সাহিত্য

স্বপ্নীল উদ্যানের সাথীরা

স্বপ্নীল উদ্যানের সাথীরা

 

ফুলদানিতে রাখা একতোড়া গোলাপ,পাশে এক ঝুরি শিউলি,কাঠালচাপা,সুগন্ধি ছড়াচ্ছে। মিসেস ফাতিমা ব্যস্ত টেবিল সাজাতে, ছেলে নাসিফকে ফলের সালাদ করতে হেল্প করছিলেন।মায়ের কাছে টিস্যুবক্স এগিয়ে দেয় নাসিফ, আনন্দ, উৎসাহে বারবার ঘামছেন তিনি।আজ রাতে বান্ধবীদের গেটটুগেদার  নিয়ে বেশ প্রফুল্ল লাগছে তাঁর।রান্নাও করেছেন সময় নিয়ে বেশ,পদ্মার ইলিশ,গ্রাম থেকে আনা,তেলাপিয়া,বেলেমাছ,চিংড়ির, বড়া কোপ্তা,করোলা- আলুভাজি,লাউচিংড়ি,কচুরলতি আর বিফ, শেষে নতুন আতপ চালের ফিরনি।রান্নায় বরাবরই আনকোরা তিনি,যা ও শিখেছেন,নাসিফের আগ্রহে আর তার বাবার সুন্দর রান্নায় অনুপ্রাণিত হয়ে।তাড়াহুড়ায় কাজ প্রায় শেষ, এবার অপেক্ষার পালা।

বারান্দায় এসে বসলেন,পাসের বাসার ভাবীর মেয়ে নামিরা,ভার্সির বাস থেকে নামল।ফাতিমাও ডুবে গেলেন,ক্যাম্পাসের সেই দিনগুলোতে।ক্লাসে ঢুকেই, ব্যাগটা রেখেই,শুরু হয়ে যেতো খু...শুটি, মুনিয়ার এতো দুষ্টো বুদ্ধি কোথায় পেতো,কে জানে।ওর প্রাণশক্তি উদ্দ্যমতা, কেমন টনিকের মতো ছিলো।আতিয়া, ছিলো শান্ত, অটল,ধীর-স্হির,আজো তেমনি আছে।ওকে দেখলে কেমন প্রশান্তি কাজ করতো,স্বচ্ছ কাঁচ মনের কালিমা টুকরো হয়ে যেতো।মুনিয়া,ওর মধ্যে দুষ্টামি ওকেই সামাল দিতে হতো।আর,বাকী একজনের কথা না বললেই নয়,কোচিংএ সময় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল গন্ডিতে পা দিতে, যে আলো হয়ে ছিলো, মুশফিকা আপা।

অনেকেই বলে,স্কুল-কলেজ লাইফের বন্ধুর মতো বন্ধু হয় না।মিসেস ফাতিমার লাইফে ঠিক উল্টো,তাঁর মতো নিরস,স্বল্পভাষীর কলেজ জীবনে বন্ধুই ছিলো না।আর আজ,সহকর্মীদের প্রিয় আপা, শিক্ষার্থীদের ও চোখেরমনি।আলোছায়ায় পথ চিনতে শিখিয়েছিল ওরা।সবুজ উদ্যানে,নহর বয়ে যাওয়া পাহাড়ের সুউচ্চে স্বপ্ন এঁকে দিয়েছিল, ওরা।

ইউনি' ভর্তি পরীক্ষায় যখন আশানুরূপ সাবজেক্ট হলো না,মুশফিকা কি সাহসই না যুগিয়ে ছিলো।"ইন্নাল্লাহ মা'আনাহ"* বলে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরেছিলো।ওর গুনগুন করে গেয়ে যাওয়া গান আজো, কানে বাজে,"সত্যের সংগ্রামে ফোটা ফুল,"তোমরা আল্লাহর কোন কোন নিয়ামত করবে অস্বীকার," "সংগ্রামী মানুষের সারিতে, আমাকেও রাখিও, রহমান" কত্তো কত্তো গান।আজ অবশ্য, ওর মেয়ের কণ্ঠেই  মিষ্টি গান শুনবে সবাই।

হঠাৎ আকাশ কালো হয়ে আসে মেঘে,স্কাইপিতে ফোন দেয় ওদের,আসতে সমস্যা হচ্ছে না তো।পদ্মা সেতু পার হয়ে এসেছে,আতিয়ারা,বাকীরাও কাছাকাছি।ফাতিমার সেদিনকার কথাও মনে পড়ে যায়,সারাদিন ব্যস্ততার নগরী জুড়ে বৃষ্টি, সকালে আম্মার ফোন একটানা,তারপর, পৃথিবীর সবচে' কঠিন কথাটি শুনেছিলো,হৃদয় শূন্য করা।ঝড়জলের রাতে আতিয়া,মুনিয়ার কোলে মাথা রেখে,পদ্মা পাড়ি দিয়েছিলো সে।কি কঠিন ছিলো সেই রাত,ওরা না থাকলে ভাঙ্গাচোরা হৃদয়টা হয়ত আর দাড়াতে পারতো না।দিনরাত গুনগুন করে কুরআন পাঠ করছিলো ওরা,সাথে টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ।আর ফাতিমা ছাতা নিয়ে,দাড়িয়ে ছিলো নতুন মাটিতে বাধা দাদীর গোরের সামনে।চোখের নিশব্দ অশ্রু আর বৃষ্টির ফোটা একাকার হয়ে গিয়েছিল।গ্রাম থেকে এসে সেমিস্টার ফাইনাল,ভাইবা,অ্যাসাইনমেন্ট সবকিছু, ওরা কেমন সামলে নিলো।আজও কৃতজ্ঞতায় চোখ ভারী হয়ে আসে।রুমী'র উক্তিটা,ওদের জন্য পারফেক্ট," You are the light of my heart and the comfort my soul."ফাতিমাও প্রতিটি কাজে চমকে দিয়েছিল ওদের,তার প্রথম কবিতার বইটি উৎসর্গ করেছিলো,ওদের তিনজনকে।আর,সেখানটাতে লেখা ছিলো,ATTICUS' এর সেই উক্তিটি,"Real friends are like stars,they shine brightest on those darkest nights."

নাসিফ ছোট থেকে শুনে এসেছে,তাদের প্রিয় খালামনিদের কথা,সেই তিলোত্তমা মুহূর্তে জীবন-মরনের সন্ধিক্ষনে, পাশে ছিলো আতিয়া,মুনিয়া।নাসিফের বাবা দেশের বাইরে ছিলেন,ফ্লাইট মিস করায় সেদিন,আর ছোট্ট নাসিফকে কোলে নিতে পারেননি।ফাতিমার ক্লান্তি মাখা হাতটা আতিয়ার কাছে আকুতি করছিলো।শেষ রাত্রির প্রার্থনায় আজো,দোয়া করেন ওনাদের জন্য।নাসিফকেও বলেন,কুরআনের সেই আয়াতটি,"হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গী হও।"**এতোসব ভাবনার খেয়াল ভাঙ্গে কলিংবেলে, আতিয়া,মুনিয়া,মুশফিকা একসাথে সালাম দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে,মুনা'আকা করে দীর্ঘক্ষণ আঁকড়ে থাকে।বাচ্চা খেলায় মেতে উঠেছে ততোক্ষণেআড্ডা,হামদ-,বিজ্ঞান,কবিতার আসর শেষে,সবাই খেতে বসেন।কি অনাবিল পরিবেশ,চোখের সামনে ভাসে,"আ'লা সুরুরিন মুতাক্বালিনা,ইয়ুত্বফু আলাইহিম বিকাসিম মিন আ'আমিন।"***

বন্ধুত্ব তো এমনই হওয়া উচিত,যার শিকড় গ্রোথিত হবে,রবের সান্নিধ্যে, পরম উদ্যানের স্বপ্নে বিভোর।


*তাওবা:৪০
**তাওবা-১১৯
***.মুদাচ্ছির:৪৪-৪৫


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)