সাহিত্য

খোলসের ভেতর অথবা চকচকে আবরণ

খোলসের ভেতর অথবা চকচকে আবরণ
মাঝে সাঝে একটা দিন যায়,যখন শত ব্যস্ততার মাঝেও খাপছাড়া দিনের আমেজ থাকে,মেঘলা দিনে টুপটাপ বৃষ্টি আর আধ ভেজা দুপুরর বিকেলের সে দিন গুলো তে অতীত খুব বেশি টানে কিন্তু মনকে তার খোরাক দেবার সময় কই? হাতে যে কত্ত কাজ! ঐ তো বাস আসছে,হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে খানিকটা আশ্বস্ত হলো নিতু,এখনো সময় বাকী আছে, কিন্তু জ্যামের উপর তো ভরসা নেই তাই আগেভাগেই বের হওয়া। অনেকক্ষন ধরে মোবাইলে রিং হচ্ছে,কিন্তু বাসে দাঁড়ানো অবস্থায় মোবাইলে কথা বলার সাহস,ইচ্ছে কোনটাই নেই। কোন রকমে মোবাইলটা বের করে নাম্বারটা দেখলো। ছোট্ট একটা নি:শ্বাস ফেলে বাইরে তাকালো নিতু। কতো ব্যস্ত এই শহরটা,রাস্তায় উপচে পড়া গাড়ি আর দু'পাশে মানুষ এর ভীড়। খেয়াল করলে অবাক লাগে,এমন অবস্থায় কেমন করে বাঁচে মানুষ গুলো? কেমন করে এর মাঝে স্বপ্ন দেখে,স্বপ্ন গড়ে আবার ভেঙে যাওয়ার কষ্ট চেপে নতুন করে বাঁচে! কেমন করে পারে? না পেরেই বা উপায় কি? বেঁচে থাকার নামটাই যদি জীবন হয় তাহলে ভেতর-বাহির যাই হোক,বাস্তবতা মেনে নিয়েই লড়াই করে যেতে হয়। এর মাঝে কিছু সিদ্ধান্ত থাকে যার ভালো দিক এর চাইতে খারাপ দিকটাই বেশি কিন্তু তা সত্ত্বেও মানুষ সিদ্ধান্তটা মেনে নেয়,ক্ষণিকের ভালোদিকটা দেখে সাথে অসীম খারাপটা জেনে। যেমনটা করেছে নীরা ভাবি।
আসরের নামাজ শেষ করে নিতু টেবিলের কাজ গুছাতে থাকে ব্যস্ত হাতে জানে,৬.৩০টার আগে কোন ভাবেই বের হতে পারবে না তবুও ক্ষীণ আশা নিয়ে কাজ করতে থাকে। মোবাইলের বিপ শব্দ শুনে ব্যাগের দিকে হাত বাড়ায়। 'আজ কখন বের হবে?' একটা নি:শ্বাস ফেলে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে স্ক্রীণের দিকে। ধীরে ধীরে মুখে হাসি ফুটে উঠে। নিহাল ভালো করেই জানে নিতুর বের হতে ক'টা বাজতে পারে,এবং নিতুর অফিস থেকে তার অফিসের দূরত্বটাও বেশ কিন্তু তবুও রোজ ৫টা বাজলেই ম্যাসেজ পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করবে,প্রশ্নটা শুনেই মাথায় চট করে যে চিন্তা গুলো আসে তা হচ্ছে,আজকে কি নিহালের দ্রুত অফিস শেষ? একসাথে বাড়ি ফেরা হবে? নাকি ওর ফিরতে আজ দেরি হবে? ইত্যাদি। অথচ উত্তর একটাও না,নিহাল আসলে জানতে চাচ্ছে,নিতু কখন বের হচ্ছে কতোক্ষন লাগতে পারে ওর বাসায় যেতে। কারণ,যতোক্ষন নিতু বাসায় ফিরে এসএমএস করে না জানাবে ততোক্ষণই নিহালের টেনশন! '৬টার মধ্যেই বের হওয়ার চেষ্টা করবো কিন্তু সাড়ে ৬টা বাজতে পারে,বাসায় ঢুকার আগে একটু মুদি দোকানে যাবো কিছু জিনিস কেনা লাগবে,৮টার মধ্যেই বাসায় যেতে পারবো ইনশাআল্লাহ। ' রিপ্লাই দিয়ে আবার কাজে মনোযোগ দিলো কিন্তু অনেকক্ষন যাবত আর কোন রিপ্লাই না আসায় মনটা খচ খচ করতে লাগল। খুব বেশী ব্যস্ত নাকি? রিপ্লাই একটা তো আসার কথা! ৬.২০ এর দিকে নিচে নেমে এসে দেখে রিসিপশনে একটা চিরচেনা প্রশান্তিময় মুখ। খুব মনোযোগ দিয়ে পেপার পড়ছে,আহহ!
সালাম দিতেই হাসিমুখে মুখ তুললো নিহাল,জবাব দিয়ে বলল,
-অবাক হয়েছো তাই না? নিতু হাসি চেপে বলল,
-ম্যাসেজের রিপ্লাই আসছিলো না দেখে মনে হচ্ছিলো নিরবতার ভাষাটা ভিন্ন কিছুই হবে। আজ দ্রুত বের হলে কিভাবে?
-বের হতে পেরেছি কারণ আবার ফিরতে হবে তাই! এদিকে কাজে এসেছিলাম,ওটার রিপোর্ট নিয়ে আবার ফিরবো অফিসে,কিন্তু মনে হলো এতো কাছে এসেও মুখটা না দেখে কিভাবে যাই? তুমি তো জানোই আমি অতো নিষ্ঠুর না!
হাসতে হাসতে দু'জনে অফিস থেকে একটু দূরে টং এর দোকানে বসলো,চা-পুড়ির অর্ডার দিয়ে কিছুক্ষন চুপচাপ বসেছিলো দু'জন। নিরবতা ভেঙে নিতু বলল-
- আজ নীরা ভাবি ফোন দিয়েছিলো আবার,বাসে ছিলাম তাই ধরতে পারিনি,কথা হয়েছে তোমার ভাইয়ের সাথে? নিহাল মাথা নেড়ে বলল,
-নিতু ব্যাপারটা নিয়ে মনে হয় আমরা বেশি ইনভলভ না হলেই ভালো হয়,শাহেদ ভাইয়ের যে মনোভাব দেখছি,তার রাগ আকাশ ছুঁয়ে আছে অনুতাপ এর কোন লক্ষণই নেই,এ অবস্থায় ভাবির হয়ে যে ই কিছু বলবে সে ই চিরশক্রু হবে তার।
- কিন্তু একেবারে চুপ যে থাকতে পারছি না! খারাপ লাগে। এভাবে এইসব সামান্য কিছু কারণে সংসারটা ভেঙে যাবে?মাঝে বাচ্চাটার জীবনটা ধ্বংস হবে। আলতো করে নিতুর হাতটা চেপে ধরে নিহাল বলল,
- আমাদের বিয়ের পর যেদিন ঐ দুজনের সাথে প্রথম কফি খেয়ে আমরা বের হলাম,তুমি তখন বলেছিলে শাহেদ ভাইকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নীরা ভাবি ভুল করছে,আল্লাহ না করুন এর জন্য উনি খুব কষ্ট পাবেন। আমি সেদিন অনেক ভেবেছিলাম,দু'জন মানুষের সংসার জীবনে বাবা-মায়েদের কি এমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতে পারে যার জন্য সংসার ভেঙে যাবে! কিন্তু নিজেদের ২বছরের সংসার জীবন পার করে বুঝতে পারছি,কোন ভূমিকা না থাকলেও বাবা-মা এর গুরুত্বটা সংসারে অনেক বড় একটা বিষয়। শুরুতে হয়তো বুঝা যায় না,কিন্তু পরে পদে পদে উপলব্ধি করা যায়।
নিতু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল,
- বিয়ের আগে ছেলে-মেয়ের সম্পর্কের কথা জানাজানি হলে সব পরিবার ই নেগেটিভ প্রতিক্রিয়া দেখাবে,মেয়ের পরিবার ছেলের সাথে আর ছেলের পরিবার মেয়ের সাথে। ৮০% ক্ষেত্রে চরম নেগেটিভ প্রতিক্রিয়া দেখায় তারা কিন্তু ছেলে-মেয়ে যদি ধরেই নেয় তারা সারা জীবন এক সাথে থাকবে দু'পরিবারের সদস্য হয়ে তাহলে সময়ের সাথে সাথে বাবা-মায়ের জায়গায় দাঁড়িয়ে তিক্ত ঘটনা গুলো ভুলে যাওয়া ই উচিত।না হলে সম্পর্কটা বিয়ের আগে পরে ভয়ংকর রকমের তিক্ত হতে পারে। সেদিন নীরা ভাবির পরিবার সম্পর্কে শাহেদ ভাইয়ের মন্তব্য গুলো আমার ভেতরই প্রচণ্ড রাগ উঠাচ্ছিলো,তারা যতো বাঁধাই দিক,কোন সন্তান নিজের বাবা-মা সম্পর্কে বাজে কথা সহ্য করবে না,একদিন কি দুদিন ক্ষোভ হবেই আর তাই আমি বলেছিলাম,নীরা ভাবি ভুল করছেন শাহেদ ভাই এর সাথে উনি ভালো থাকতে পারবেন না। বিয়ের পর বাবা-মা সম্পর্কে মেয়েরা আরো বেশি সেন্সেটিভ হয়ে যায়,এখন হয়তো শাহেদ ভাইয়ের মন্তব্য গুলো সহ্য করতে পারছেন কিন্তু পরে এগুলো আর সহ্য হবে না। আহহ... কেন যে মানুষ আবেগে এমন অন্ধ হয়!
-হুম! প্রথমে বিষয়টা নিয়ে তিক্ত মন্তব্য এর পর খোঁটা, অপমান সেই সাথে তর্ক,ঝগড়া এভাবেই ধীরে ধীরে এতো বছরের সম্পর্কটা বিয়ের বছর না ঘুরতেই ভাঙার দিকে গড়ালো,এক পর্যায়ে শুধুমাত্র অনাগত বাচ্চার দিকে তাকিয়ে আটকে আছে শেষ সিদ্ধান্তটুকু।
নিতু উদাস কন্ঠে বলল, - এখনো তো শেষ হয়নি তাই না? হয়তো একটু চেষ্টা করলে,হয়তো দুজন একটু ছাড় দিলে হয়তো... হয়তো আরেকটু চাইলে সম্পর্কটা টিকে যাবে।
-আমাদের ভাবনা গুলো সহজ বুঝি যা তাদের বেলায় কঠিন,বেশি ভেবো না। ফয়সালা আল্লাহর হাতে উনি চাইলে সব অসম্ভবই সম্ভব। আচ্ছা এখন উঠো,তোমাকে রিকশা করে দিয়ে আমি বাসে উঠি।
নিতু মুচকি হেসে বলল,
-রিকশা কেন? শুধু শুধু এতগুলো টাকা যাবে।
নিহাল মুখ বাঁকিয়ে বলল,
-গেলে তোমার জামাইর টাকা যাবে,তোমার কি? এই ভীড় ঠেলে বাসে উঠতে হবে না,রিকশায় যাও।
নিতু মিষ্টি করে হাসলো শুধু কিছু বললো না। রিকশা রেলগেট এর কাছে এসে জ্যামে পড়লো,নিতু ছোট বেলার মতো আগ্রহ নিয়ে সামনে তাকালো। ট্রেন যাচ্ছে ট্রেন ঐ যে। এসএমএস আসার টোন শুনে মোবাইলটা হাতে নিলো,নীরা ভাবির এসএমএস।
“নিতু,আমি কি ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়ে বেশি ভুল করে ফেললাম?নাকি এমন মানুষের সাথে বিয়ের সিদ্ধান্তটাই ভুল ছিলো। আমার সামনে কেউ আমার পরিবার কে ছোট করে কথা বলবে আর সে হবে আমার জামাই এটা মানতে পারছিনা কোন ভাবেই,বিয়ের সিদ্ধান্তটা নিজের ছিলো বলে পরিবার কে ও কিছু বলতে পারছিনা কিন্তু ভেতরে ভেতরে একা এভাবে আর সহ্য করতে ও পারছি না। যে বাচ্চাটা আসছে তার জন্য এই পরিবার কি উপযুক্ত হবে? নিতু,আমি পাগল হয়ে যাবো,প্লিজ আমাকে হেল্প করো।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মোবাইলটা ব্যাগে ভরে নিতু। গত সপ্তাহ দুয়েক ধরেই নীরা দিনে অন্তত একবার এমন এসএমএস পাঠায়,এখন আর কোন উত্তর খুঁজে পায় না নিতু।কষ্ট হয় আবার নিজেকে সামলায়, কেউ ই ছোট্ট না নিজের সিদ্ধান্ত নেবার মতো বয়স সবার ই হয়েছে সুতরাং এসবে তৃতীয় পক্ষ হয়ে সিদ্ধান্ত না দেয়াই ভালো। কিন্তু এসবের মাঝে কতোদিন বেঁচে থাকা যায়? একটা মানুষ এভাবে ঢেউয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে অথচ কিছুই করার নেই,তবু দুটো পজেটিভ কথা বলা যায় মন কিছুটা হলেও শান্তি পায়।
শুধু যে পরিবার কে অপছন্দ তা না,শাহেদ ভাইয়ের জন্যে নীরা আপুর চাকরীটাও চরম অসহ্যকর। অথচ নিহালের কাছে শুনেছে বিয়ের আগে শাহেদ ভাই বউ এর চাকরী নিয়ে বেশ উদার মাইন্ডের ছিলেন,কখনো এসব বিষয়ে নেগেটিভ কিছু বলতে শোনেনি। নিতুর মনে হয়, বিয়ের আগে বউ এর চাকরীর ব্যাপারে,তার স্বাধীনতার ব্যাপারে তীব্র মুক্তমনা কিংবা উদার মানুষিকতা পোষনকারী এমন অনেকেই বিয়ের পর তার মন-মানুষিকতা গুলো যে কোথায় বন্দী করে ফেলে নিজেও জানে না।
আচ্ছা, নিজেকে একজন চিরায়ত ধ্যান ধারনার স্বামী ভাবা সহজ নাকি সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত সমাজের আর দশটা মানুষদের থেকে আর?কাগজে শিক্ষিত অন্যসব স্বামীদের থেকে আলাদা ভাবা কি খুব কঠিন? এটা যে পুরুষদের জন্য অগ্নি পরীক্ষা তুল্য তা বুঝা যায়,যখন নিজের স্যালারীর চাইতে এক ডিজিট বেশি স্যালারীর জব বউ করে। স্বামী যখন পরিবারের ভরন পোষন ম্যানেজ করতে ব্যস্ত বউ তখন তার দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আরেকটু উচ্চ শিক্ষা বা সমাজের অন্য নারীদের জন্য কিছু করতে যায় তখন নিজের চাইতে বউ এর অবদান কে কেউ বেশি ভাববে এটা সহজে মেনে নেয়াটা চরম ভাবে অসহ্যকর তাদের জন্য। অথচ মেয়েরা কতোওও কিছুই না হাসিমুখে মেনে নেয়। হায়,মনুষ্য সমাজ!
সিগন্যাল অফ হয়েছে,রাস্তার দু’পাশে খাবারের দোকান গুলো ঘিরে অসংখ্য কাপল দেখতে পেলো।নিতুর মনে প্রশ্ন জাগে,এরাও কি ভবিষতে শাহেদ-নীরার মতো হবে? খোলসের ভেতরের কেউ নাকি বাইরের চকচকে আবরন? নাকি ওদের মতো হবার ভয়ে এর মাঝ দরিয়াতেই ডুবে যাবে? অজান্তেই চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে নিতুর! 

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
লেখকের অন্যান্য ব্লগ সবগুলো দেখুন