সাহিত্য

ছুটে চলা গল্পের একটা অংশ

ছুটে চলা গল্পের একটা অংশ
মাঝে মাঝে দরকার নাই টাইপের কাজ করতে খুব মজা লাগে!এই যেমন এখন,খুব যত্ন করে হাতের নখ গুলোকে সাইজ করছিলাম,কানে হেডফোন গুঁজে নিয়েছি যাতে করে কেউ ডাকাডাকি করলেও শুনতে না হয়! কিন্তু শুনতে হলো,কারণ মোবাইলের গান বন্ধ হয়ে গেছে,কল আসছে তাই! সুপ্তির ফোন। আমি কল টা রিসিভ করে কাজে মনোযোগ দিলাম, -কিরে?ডাকোস কেন? -করতেছিস কি তুই? -নখচর্চা!তোর কি খবর?কি সমস্যা বলে ফেল? -দোস্ত,ঝামেলা তো হইয়া গেছে একটা!কি করি এখন?! আমি কপাল কুঁচকে বললাম, -ঝেড়ে কাশ,কি হইছে? -আরে আমি তো ট্যাক্সে ফেল করছি! আমি একটা হাই তুলতে তুলতে বললাম, -কইরা ভালোই করছিস,আমাদের এখানে তো যেই প্রশ্ন করছিলো,আর যেভাবে পড়াইছে,সব তো পরীক্ষার খাতায় লেখার আগেই বের হয়ে গেছে মাথা থেকে!আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় পাশ করে ফেলছি,বাট ট্যাক্স এর 'ট' টাও এখন আর মাথায় নাই!তুই ই ভালো করছিস,আরেকবার ভালো মতো পড়ার সুযোগ পাইছিস! সুপ্তি কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, -দোস্ত,মজা নিস না!কি করুম এখন সেটা বল,আমার তো এখন দুই তিন জায়গায় কথা শুনতে হইবো,ভুইলা যাইস না,আমার বিয়ে হইছে! -নারে ভুলি নাই,গত একবছর ধইরা তোর বিয়ে খাইছি,কেমনে ভুলি বল?! আর তোরে কে কি বলবে এখন?বিয়ে-সংসারের ঝামেলায় যে তুই ক্লাস করতে পারিস নাই,সেটা দেখে নাই কেউ?ট্যাক্স কি থিউরী,যে এক রাতে পড়ে হইয়া যায়! -এগুলা কেউ বুঝবো নারে! -তাইলে কানে তুলা দে,যা খুশী অন্যরা বলে বলুক!এতো কথা শোনার টাইম নাই তোর,বুঝছিস?আর কালকেই কোর্স এড করে ফেল,ঝামেলা শেষ! -দোস্ত,বাপ-মা হাজার বকলেও গায়ে লাগে না,উল্টো ঝাড়ি দেয়া যায় কিন্তু শ্বশুড় বাড়িতে একটু মুখ কালো করলেই অনেক লাগেরে!কিচ্ছু বলা যায় না! আমি হেসে ফেললাম! -এই জন্যই তো বলছি,কানে তুলা দিয়ে রাখ!আরে মানুষ মাত্রই বকা খাইতে হবে,সো ব্যাপার মনে করলেই ঝামেলা! সুপ্তি আরো কতোক্ষন মিনমিন করে ফোন রাখল। আমারো ততোক্ষনে কাজ হয়ে গেছে,ওদিকে আসরের আযান ও পড়েছে,আমি দ্রুত রুম থেকে বের হলাম। রাতে আবারো সুপ্তি ফোন করল,আমি ধরেই বুঝলাম,বেচারীর খুবই মন খারাপ!টেবিল থেকে উঠে লাইট অফ করে বিছানায় বসলাম। -তুই কি ভাইয়া কে বলেছিস? -হুম,বলেছি। -কি বলে জনাব? সুপ্তি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, -বাদ দে তার কথা,সে কি বলবে!বলে,আমার বোন রিমির তো বিয়ের সময় ফাইনাল পরীক্ষা ছিলো,বাট ও তো অনেক ভালো রেজাল্ট করেছে! -হুম,রিমি আপু তো ন্যাশনালে পল সাইন্সে পড়তো তাই না? -হুম,এবং তার বিয়ের সাত দিন পর ফাইনাল পরীক্ষা ছিলো,তাই আমার শ্বাশুড়ি নিজে যেয়ে চারদিনের মাথায় আপুকে এ বাসায় নিয়ে এসেছিলেন,এবং পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপু এখানেই ছিলো! -বাহ!!ভালো তো!কিন্তু আ্মি তো দেখেছি,তুই ক্লাস থেকে শুরু করে পরীক্ষা সব কিছুই শ্বশুড় বাড়ি থেকেই এসে করিস,এমনকি গ্রুপ স্ট্যাডি করতে তোর বান্ধবীরা তোর বাবার  বাসায় যায়,আর তুই বলে আসিস ক্লাসে যাচ্ছিস,কারন বাবার বাড়ি আসবি শুনলে তোর শ্বাশুড়ি না না করবে তাই! সুপ্তি কোন জবাব দিলো না। আমি জানি ও সব সময় চুপ করেই থাকে,থাকতে হয় ওকে... আর দশটা মেয়ের মতো সুপ্তি জোর গলায় দাবী করতে পারে না,নিজের প্রয়োজন-অপ্রয়োজন বলতে পারে না!নিজের জন্য কখনো দু'কথা বেশি হবে এটা সুপ্তি কোনভাবেই হতে দিবে না! আর ওর এই সুযোগটাই সবাই নেয়। ওর জামাই শান্তিপ্রিয় মানুষ!শ্বশুড় সমাজসেবা প্রিয়, শ্বাশুড়ি শাসন প্রিয়,আর সুপ্তি হলো নীরবতার প্রিয়...ব্যাস,সব মিলিয়ে সোনায় সোহাগা অবস্থা! আমি নরম গলায় বললাম, -মন খারাপ করিস না,আর সাহস রাখ,দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা করিস না,আমরা,তারপর তোর ক্লাসমেটরা তো আছি আল্লাহর রহমতে,যা যখন দরকার হেল্প করবো,তুই ক্লাস করা শুরু করে দে,আর টিচার কে বলে রাখিস তোর নিয়মিত ক্লাস করতে সমস্যা,যেহেতু প্রাইভেট,ক্লাস প্রেজেন্ট অনেক ইম্পোর্টেন্ট। ওকে? -দোস্ত,এখন মনে হয় আমাকে শুধু সব বিষয়ে কোন রকম পাশ করেই দিন পার করতে হবে?!নিয়মিত ক্লাস করার কোন আশা নাই! এ বাসায় কাজের লোক টিকে না,আমার শ্বাশুড়ী খিটমিট করেন বেশি,তাই বেশির ভাগ কাজ তো আমাকেই করতে হয়,এদিকে মেহমান আসা-যাওয়ারও কমতি নেই!আমি তো রাত ১০টার পরেও অবসর হতে পারিনা!দোস্ত,আমি চোখে কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না! -তোর না আরো দুইজন ভাসুরের বউ আছেন বাসায়,উনারা কি করেন?উনারা একটু হেল্প করতে পারেন না? -উনাদেরকে আমার শ্বাশুড়ির খুব একটা পছন্দ না,আর তারাও তাদের বাচ্চার স্কুল-টিচার নিয়ে এমন ব্যস্ত যে,তিন তলা থেকে দোতালায় নামার সুযোগ পান না!,প্রায় সময়ই বিকেলে এক কাপ চা খাবেন,সেটাও আমাকেই বানাতে হয়! এবার আমি চুপ করে রইলাম!কি বলবো?সংসার যুদ্ধ তো বোধহয় একেই বলে! এভাবে যুদ্ধ করেই পড়াশুনা কোন রকমে শেষ করতে হবে!সামনে আগাতে হবে,যেভাবে আর দশজন মেয়েরা করে। তবে,সংসার কি আসলেই এমন যুদ্ধক্ষেত্র হওয়ার কথা?সহমর্মিতা,সহোযগিতা,ইনসাফ আর ভালোবাসা পূর্ণ হওয়ার কথা না? বাবা-মায়ের মতো শাসন যেমন থাকবে,তেমনি আদরও থাকবে,পরিবারের অন্যান্যদের সাথে ভালো সম্পর্ক থাকবে,সবার সহোযোগীতা থাকবে সব কাজে এমনটাই তো হওয়ার কথা...! বাট আমাদের সমাজে এসব তো শুধু বইয়ের পাতায় অথবা নীতি কথার লাইনেই সীমাবদ্ধ! আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, -এতো ভয় পাচ্ছিস কেন?আর মানুষ কি বিয়ের পর পড়াশুনা করে না?তারা কি ভালো রেজাল্ট করে না?এসব কোন ব্যাপার না!ধৈর্য্য ধর,আর একটু বেশি পরিশ্রম করতে হবে এই যা!তবে আত্নবিশ্বাস হারাবি না, তোর নতুন সংসার,তাই এখন একটু বেশি সমস্যা হচ্ছে হয়তো...ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে,ইনশাআল্লাহ। দেখবি তখন তোর শ্বাশুড়িও অনেক ছাড় দিবেন,আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে হবে আর সাহস রাখবি। -হুম,আমার আসলে খুব ভয় ভয় লাগেরে!এখন মনে হচ্ছে,বিয়ে-শাদী আসলে পড়াশুনা শেষ করে করলেই ভালো ছিলো! এইরকম টানা-টানি করে কোন রকম একটা সার্টিফিকেট নিয়ে কি লাভ?অথচ টাকা-সময় তো ঠিকই যাচ্ছে!তার উপর কিছু উনিশ-বিশ হলে দুই বাড়িতেই কথা শুনতে হয়! আমি হাসলাম! আমাদের সমাজে একটা মেয়েকে পড়াশুনা শেষ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে গেলে যে সব কষ্ট-সমস্যা সহ্য করতে হয় সে অর্থে বলতে গেলে,সুপ্তি ভালোই করেছে! গলায় কাঁটা নিয়ে খাবার খাওয়ার কষ্টের চাইতে মনে হয় কাঁটা বিহীন গলায় না খেয়ে থাকাও অনেক ভালো!! ভাবতে ভাবতে লাইট অন করলাম,ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সাড়ে ১১টা বাজে,কালকে একটা গ্রুপের প্রেজেন্টেশন রেডি করে দিতে হবে! -সুপ্তি শোন,এতো চিন্তা করবি না,চিন্তা করে কোন লাভ নেই,যা হয় আল্লাহ নিশ্চয়ই তাতে কল্যান রাখেন,মানুষের ইচ্ছেতেই সব কিছু হয় না। আর তুই তোর মা কে দেখ,আমার মা কে দেখ,তারাও এমন সব ঝামেলা ম্যানেজ করে পড়াশুনা শেষ করেছেন,এমন আরো অনেকেই করছে,অনেকে তো ২/৩বাচ্চা সামলে পড়াশুনা করছেন!তোর মেধা আছে,আগ্রহ আছে আর কিছুর তো দরকার নেই,একটু কষ্ট কর দেখবি ইনশাআল্লাহ তোকে আল্লাহ সাহায্য করবেন। -আমাদের মায়েরা কষ্ট করেছেন,দেখে তো আমাদেরকেও একই কষ্টে ডুবায় দিয়েছেন!দেখেছি তো অনেককে,ওরকম ২/৩বাচ্চা সামলে যারা পড়ছেন ওটাকে পড়া বলে না,কোন রকম একটা কাগজের সার্টিফিকেট আদায় করা জাস্ট! স্পষ্ট টের পেলাম সুপ্তি ভেতরে ভেতরে অভিমানে ফুঁসছে! -একটু আগে না বললাম,যা কিছু হয় আল্লাহ অবশ্যই তাতে কল্যান রাখেন,এবং উনার হুকুম ছাড়া কিছু হয় না। মানুষকে কেন দোষ দিস?আল্লাহর কাছে দোয়া কর,দেখবি উনিই ভালো সমাধান দিবেন। কোন রকম আফসোস করবি না। সুপ্তি আর কিছু বলল না,চুপ করে ফোনটা রেখে দিলো,শুধু এপাশ থেকে আমি ওর একটা গোপন দীর্ঘশ্বাসটা শুনতে পেলাম,যেটা ও কাউকে শোনাতে চায় না! ব্যাস্ততার মাঝে মাঝে আজকাল খুব একটা সুপ্তিকে ফোন করা হয়ে উঠে না,ও মাঝে মাঝে ফোন করে বই-নোটের কথা বলে,আমি সেগুলো ওর বাবার বাসায় রেখে আসি,ওখান থেকে কেউ দিয়ে আসে ওর বাসায়। ঈদ উপলক্ষে ঈদের আগের দিন ফোন দিলাম,ধরলো না,রাতের নিজেই ব্যাক করলো,কনফারেন্সে আরো দুই বান্ধবী ছিলো। সালাম-শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর বললাম, -তো কবে আসছিস এই বাসায়?ভাবছি তোর বাসায় তুই আসলে একটা গেট টুগেদার রাখবো। - নারে আসা হবে না। আমার শ্বাশুড়ি ওমরাহ করতে গিয়েছিলেন,গতকাল এসেছেন,এসে আবার অসূস্থ হয়ে গেছেন,এর মধ্যে আবার কাজের লোকও নেই,সো,এবার কোথাও যাওয়ার সুযোগ নেইরে! নায়লা বলল, -এক ঘন্টার জন্যেও আসতে পারবি না?তোর আম্মু তো মন খারাপ করবে,একটা মাত্র মেয়ে একই শহরে থেকেও ঈদে আসবি না,কেমন দেখায়?! -হুমম... মন তো আমারো চাইবে,বাট এই কথা বলাই যাবে না,শ্বাশুড়িকে আর কি বলবো  তোর ভাইয়াই তো অলরেডি না বলে ফেলছে!বলেছে,'এবার কোথাও বের হতে চেয়ো না,আব্বু-আম্মু অসূস্থ!' দেখি ও বাসা থেকে এখন আম্মুরা আসে নাকি! আমি আর কি করবো,ফোনের এপাশে মুখটা বাংলার পাঁচ করা ছাড়া! কি এক অবস্থা!ঈদের একটা সময় তাও দোস্তের সংসার থেকে ছুটি নেই!ইয়া আল্লাহ,রহম করেন...কি কঠিন অবস্থা! :( তানি বলল, -তোর জামাই আর শ্বাশুড়িকে বলবি,রোজ ২রাকাত শুকরানা নামাজ পড়তে,যে এই যুগে তোর মতোন বউ পাইছে তাই!অন্য কেউ হইলে খবরই ছিলো!তোর শ্বাশুড়ির বাকী ২বউএর মতো ভাগতো!হুহ চারজন এক সাথে হেসে বললাম,'কারররেক্ট!দেখতে হবে না?বান্ধবীটা কাদের!' ঈদের চারদিন পর সুপ্তি অবশ্য এসেছিলো মায়ের বাসায়,পরীক্ষা তাই ভার্সিটি থেকে এডমিট আনতে যাবার কথা বলে বের হয়েছিলো! দৌড়ের উপর এসে মায়ের হাতের কাচ্চি বিরিয়ানী খেয়ে আর বাবাকে পায়েশ রান্না করে দিয়ে আবার দৌড়েই চলে যায়। মাঝে মাঝে ক্লাস শেষে বিকেলে বাসে দীর্ঘ সময়ের জার্নিতে বসে জীবনটাকে ভাবতে গেলে,পুরো জীবনটাকে বাস জার্ণিই মনে হয়! দীর্ঘ সময় স্টপেজে দাঁড়িয়ে থাকার পর কাংখিত বাস আসলেও অসম্ভব প্রতিযোগীতে করে উঠতে হয়,তারপর আরো কিছুক্ষন কষ্ট করে বসার সীট পেতে হয়,জ্যাম-পথের দীর্ঘতা সব পেরিয়ে গন্তব্যে পৌছাতে হয়!তবে সেটাও নির্ধারিত গন্তব্য না! ঠিক জীবনটাও এভাবেই অনির্ধারিত গন্তব্যের পেছনে দৌড়েই কাটাতে হয়,মিলুক আর না মিলুক,চাওয়া পাওয়ার হিসেব কে দূরে রেখে প্রয়োজনের সাথে ক্ষণিক সুখের সমোঝতা করে একভাবে দিন গুলো কাটিয়ে দিতে হয়। বাসা ছুটে চলে,জীবনের সময় গুলোও ছুটে চলে,স্বপ্ন-আকাংখা গুলো ছুটে চলার সাথে দূরে মিলিয়ে যায়,সামনে অপেক্ষায় থাকে শুধু অনির্ধারিত বাস্তবতা আর প্রয়োজন!

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
লেখকের অন্যান্য ব্লগ সবগুলো দেখুন