পরিবার ও আমি (বিয়ে ,দাম্পত্য,শিশু লালন পালন )

নীলজোসনার রান্নাঘরঃ ‘দিন-মাস-বছর’

নীলজোসনার রান্নাঘরঃ ‘দিন-মাস-বছর’

কিছু মানুষ আছেন, সংসার করেন একনিষ্ঠভাবে। যা করেন, সব এক্কেবারে ঠিকঠাক। সময় নিয়ে, ধরে ধরে, খুঁটিনাটি বাদ না দিয়ে। নীলজোসনা চিরকালই ফাঁকিবাজ। সে অবাক বিষ্ময়ে এই মানুষগুলোকে ভাবে, ‘কিভাবে পারে?’ নীলজোসনা কাজ করে কচ্ছপের ক্যলেন্ডারে। একটু একটু করে, প্রতিদিন। যাতে তার সুযোগসন্ধানী ঘাড়ে কাজের বোঝা খুব ভার না হয়ে পড়ে।

রান্নাঘরের কথায় আসি। বাড়ির সবচেয়ে দরকারী জায়গা হল রান্নাঘর। সারাদিনের চলে ফিরে বেড়ানোর রসদ এই জায়গাটি থেকেই আসে। উপমহাদেশের আবহমান কাল থেকে চলে আসা নিয়ম হল, এই ঘরটি মেয়েদের দখলে থাকবে। মেয়েরা এ ঘরের যাবতীয় কিংবা আংশিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের পুরোটা কাজ করবেন। খুব অল্প কিছু ব্যতিক্রম আছে যদিও। সেটা ছাড়া এমনকি যেসব পুরুষ বাইরে রান্নার কাজই করে, হয়ত, তাঁরাও বাড়িতে স্ত্রীকে রান্না ঘরে দেখেই স্বস্তিবোধ করেন। এর কারণ পুরোটাই সামাজিক নয়, কিছুটা গঠনগত বৈশিষ্ট্যও আছে বটে। মহিলারা, সাধারণত, একসাথে অনেকগুলো বিষয় খেয়াল, নিয়ন্ত্রণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ করতে জানেন, করতে পারেন। নিন্দুকেরা প্রায়শই বলে থাকেন, ‘মহিলারা ঘোরালো, প্যাঁচালো, কম্পলিকেটেড। কত কিছু ভেবে নেয়, না বলতেই।নিজে অসুস্থ? সাহায্যকারী আসেনি? দ্বিগুণ বা তিনগুণ রান্না? মাসের শেষ? ফ্রিজ নষ্ট? ওভেন? তাতে কি? সময়মত, ধোঁয়াওঠা খাবার পছন্দের মানুষের সামনে দেয়ার অসাধারণ তৃপ্তি সাদাচুলের বৃদ্ধাকেও বাড়ির সবচেয়ে তপ্ত এই ঘরে টেনে নিয়ে যায়।

আজকাল মহিলাদের ব্যপার কিছুটা আলাদা। সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে বাংলাদেশের মানুষের রুচি, চাহিদা বদলেছে। চাকুরীজীবি, কিংবা বাড়িতে থাকা মহিলা দুপক্ষেরই ব্যস্ততা আগের চেয়ে অনেক বেশী। প্রতি বেলায় নানা পদে টেবিল সাজানোর চেয়ে বাচ্চাদের টিফিন, নিজের আর বাচ্চাদের বাবার লাঞ্চবক্স, রান্নাঘরের পরিচ্ছন্নতা, নিজের স্থূলতা রোধ, ফ্রিজের ব্যবস্থাপনা, স্থায়ী বা অস্থায়ী সাহায্যকারীদের ব্যবস্থাপনা সব মিলে একটা ব্রিগ্রেডের কাজ একার মাথায় সামলাতে হয়।

আসুন কিছু উপায় ভাবি, যাতে এই রান্নাঘর-বেডরুম-পড়ার ঘর-সাজানো গুছানোর কাজগুলো সহজে করার দরজা খুলে দেয়া যায়। মনে রাখা ভালো, কাজ কম করতে হবে এই চিন্তার চাইতে গুছিয়ে কম সময়ে বেশী কাজ সুন্দরভাবে করা যাবে (ফাঁকিবাজদের চিন্তা যেমন হয় আর কি!) এই ধারণাকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।

এক। মাসের প্ল্যান

প্রতি মাসের শেষ পাঁচ দিনে আগামী মাসের প্ল্যান করে ফেলতে পারেন। সম্ভাব্য মেহমান আসা বা দরকারী দাওয়াতের ডেট করে ফেলতে পারেন। কি কি বই পড়বেন, বা কি মুভি/লেকচার দেখবেন, তাও থাকতে পারে আপনার লিস্টে। বাচ্চাদের নিয়ে কোথাও যাবেন কি না, অথবা ওদের কিছু শেখানোর এগুলোর বাস্তবানুগ এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিক নোট করতে পারেন। খুব ভালো হয়, একটা ডায়েরিতে মাসের নাম দিয়ে লিখে ফেললে। কোনটা কোনটা না করলেই নয়, সেগুলোর পাশে লাল দাগ দিতে পারেন। আবার কোনটার জন্য ডেডলাইন থাকলে লাল কালিতে তারিখটাই লিখে রাখতে পারেন। মনে রাখবেন, আপনার পরিকল্পনা যত নমনীয় হবে, আপনি এর সাথে ততটাই স্বস্তিতে এগোতে পারবেন। যেমন, ঠিক কোনদিন কোন কাজটা করবেন, সেটা না রেখে সপ্তাহে অতটুকু করবেন, বা কততম সপ্তাহে কোন কাজ করবেন লিখতে পারেন।

উদাহরণ দিই। অগাস্ট ২০১৬র প্ল্যানটা এমন হতে পারে আপনারঃ

বইঃ আল মাহমুদ শ্রেষ্ঠ গল্প, নারী পুরুষ ও সমাজ, সৈয়দ মুজতবা আলী রচনাবলী ...

গোছানোঃ বড় আলমারী, বইয়ের শেলফ ২টা, রান্নাঘরের শেলফ, সোফা...

মুছা/ধোয়াঃ পর্দা, দক্ষিণের চারটা জানালা, সব দরজা, সুইচ বোর্ড, ফ্যান তিনটা...

দাওয়াত/ ট্যুর/গেটুঃ বড় ফুফু, অমুক (১৫র আগে), তমুকের নতুন বাবু (ফ্লাইট ১৮তে, গিফট কিনতে হবে)...

মুভিঃ বড়দের- Exodus , ছোটদের- Ice Age

ফোন করা: অমুক, তমুক (গুলশান থেকে একটা জিনিস কিনতে বলতে হবে)

দুইটা ব্যপারঃ

১। প্রতিটার নিচে জায়গা রাখবেন, যেন যে কোন সময় মনে হওয়া কথা এড করতে পারেন, আর দুইতিনদিন পরপরই দেখবেন। ভালো হয়,পিন করে রান্নাঘরের দেয়ালে টাঙ্গিয়ে দিলে, একটু চোখের আড়ালে।  

২। বাসার কি কি কাজ মাসে একবার, কি কি বছরে দুইবার এসবের সিদ্ধান্ত আগে নিয়ে নেন। যাদের বাসা ছোট, তারা প্রতি মাসেই সব লাইট ফ্যান পর্দা ইত্যাদি একবার করে পইষ্কার করতে পারেন। আর যাদের বাসা বড়, তারা ঘুরে ঘুরে এক মাসে এটা আর এক মাসে ওটা, এভাবে পরিকল্পনা রাখবেন।

 

দুই। সপ্তাহের প্ল্যান

এটা মূলত মাসের প্ল্যানের খুচরা অংশ। মাসের প্ল্যান দেখে দেখে প্রতি সপ্তায় করে নিবেন। আপনার যদি পার্ট টাইম সাহায্যকারী থাকে, আর সে আপনি বাসায় থাকা অবস্থায় আসে, তবে তার কাজের সময়টায় আপনিও কাজ করাটা সুবিধাজনক। কারণ তাতে তাকে দেখিয়ে দেয়া, নজর রাখার কাজটা ভালো হয়।

সপ্তাহের কাজের লিস্ট মূলত দুই ধরণের, ঘরের কাজ আর রান্নার। ঘরেরটা আপনি একবারই করতে পারেন। শুধু কাজের জায়গাটা নির্দিষ্ট করতে পারেন, আর সেইদিন মাসের প্ল্যান দেখে সে জায়গার কাজ করবেন। রান্নারটা অবশ্য প্রতি সপ্তাহে করতে হবে। বেশি কথা না বাড়িয়ে নমুনাই দেখাই।

ক) কাজকর্মের লিস্টঃ

দিন-আমার কাজ-খালার কাজ-পড়াশুনা

রবি-ক্লাস-ফ্যান মুছা ২-ক্লাসের পড়া (ক্লাস আছে, তাই ফ্যান মোছার কাজ। যাতে সামনে থাকা লাগবে না)

সোম- রান্নাঘর-কোরআন হিফয (রান্না ঘরে নিজের কাজের পাশাপাশি রান্নাঘরে খালার কাজ)

...ইত্যাদি। একটা নমুনা দিইঃ

দিন

আমার কাজ

খালার কাজ

পড়াশুনা

Sat

ফ্রীজ/কিচেন

কিচেন ফ্লোর, পর্দা

ব্লগের লেখা/পড়া

Sun

রিডিং রুম

রিডিং রুম

গ্রুপের পড়া

Mon

ক্লাস

যে কোন ফ্যান

বই নোট

Tue

আলমারি/ কাপবোর্ড

বারান্দা/ জানালা

আয়াত মুখস্থ

Wed

ক্লাস

সীলিং ঝাড়া/ আলমারীর ঊপর/ খাটের নীচ

ক্লাসের পড়া

Thurs

নখ কাটা, শ্যম্পু

চাদর, পাপোশ

মুভি নাইট

Fri

আত্নীয়দের ফোন, লেকচার শোনা

চপ/ পরোটা ডিপের জন্য, মশলা

লেখার কাজ

খ) রান্নার প্ল্যানঃ

রান্নার প্ল্যানের সাথে ফ্রীজের আন্দাজ আর শপিং এর পরিকল্পনাটাও সেরে নেবেন। এই প্ল্যানের একটা নমুনা দিই।

থার্ড ব্র্যকেটের মধ্যেরগুলো বাচ্চাদের স্কুলের টিফিন...

23-28/07.16

Day

Cook

Shopping

Sat

বেগুন ভাজি, খিচুড়ি

লিস্ট

Sun

[পরটা+ডিম]

কলা ভর্তা, ছোটমাছ

ডিম, চিংড়ি

Mon

[রুটি+চিকেন]

চপ+মাছ

শাক, দেশী ফল

Tue

[কাপ কেক+পরটা]

চিকেন+শাক

কুমড়া, বরবটি, মাছ

Wed

[নুডলস+সবজি]

মাছ

 

Thurs

[সুজির বরফি+পরটা]

ফ্রাইড রাইস+চিকেন কারি

 

তিন। দিনের রুটিন

এটা সবচেয়ে পরিবর্তনশীল এবং সবচেয়ে নিয়ম ভাঙ্গার জায়গা। এক একটা দিন প্ল্যানের ওপর দিয়েও অনেক কাজ হয়ে যাবে, আবার এক একদিন আপনি উদাস ভাবতে হবে, ‘জীবন যখন, যেখানে যেমন...। তবুও, সারাদিনে মোটামুটি কোথায় কখন কি করবেন একটু লিখে প্ল্যান করার সুবিধা হল মাথা থেকে কিছু হচ্ছে নাটাইপের অস্থিরতা ঝেঁটিয়ে বিদায় করা যায়। আর সময় নষ্ট কম হয়। আপনি যদি জানেন, রাতে আপনার পনর মিনিট কাপড় ইস্ত্রি করতে হবে, যেটা না করলে সকালে দুই মিনিটের দেরি হয়ে যাবেই। তাহলে সন্ধ্যায় হঠাত আসা কোন প্রিয় মানুষের সাথে কথা বলতে বলতে আপনি হাতের কাজটা সেরে নিতে পারেন।

 

শেষ কথা; পৃথিবীর যে কোণেই আল্লাহ আপনাকে রাখু... না কেন, যে অবস্থায়ই রাখু... না কেন, যত কষ্টেই আপনি থাকেন না কেন, এই গোল গ্রহে আপনার জন্য কিছু কাজ নির্দিষ্ট আছে। হতে পারে, সারাজীবনে কোন একটা রাস্তা থেকে একটি পাথর সরানোও আপনাকে বানানোর উদ্দেশ্য, যে পাথর থেকে একটা দাঙ্গা লেগে যেতো হয়ত। শুধু গোপন ব্যপার হচ্ছে, আমরা সে কাজটা জেনে আসিনি। তাই চলার পথের প্রতিটি করণীয়ের দরজায় করাঘাত করে করে এগোতে থাকাই আপনার আমার আর আরও কোটি কোটি মানুষের জীবনকে সুন্দর করে দিবে। একসময় আপনি অধিকার নামক বিচ্ছিরি বাজে শব্দটা ভুলে যাবেন হয়ত, সবাই যখন তাদের কর্তব্যগুলোয় সচেতন হয়ে যাবে।

আপনার নিজের কাছেই হয়ত কেমন অস্বস্তি লাগবে, এই হলুদ-মরিচ-ঝাড়ু-সাবানের কাজগুলোকে খাতায় লিখে করতে। কিন্তু যেদিন আপনি থাকবেন না, আপনার জন্য কান্না করার মানুষগুলো যেন আপনার কাপড়জামা নয়, আপনার কাছ থেকে শেখা একটা ছোট্ট কাজের দুয়া দিয়ে জারী রাখেন আপনার ভালো কাজের ধারাকে, এজন্য পরিকল্পনা প্রয়োজন। আমরা নারী, সমাজ-সংস্কৃতি-সভ্যতা বিকশিত হয় আমাদের হাতে, তাই আমাদের কাঁধে দেয়া দায়িত্ব আর আমানতের চিন্তাও আমাদেরই করতে হবে। কারণ, এ দুনিয়ার না পাওয়াকে হয়ত সে দুনিয়ায় বহুগুণে ফেরত পাওয়া সম্ভব, অন্তত আশা করা যায়, কিন্তু এখানের না-করা-কর্তব্যকে শুধরে নেয়ার সুযোগ আর মিলতে না-ও পারে।

গড়ে উঠুক সভ্যতা, নারীর কোমল হাতের কঠোর শাসনে বেড়ে উঠুক সংস্কৃতির বাহকেরা, ভালোবাসার উষ্ণ প্রস্রবণ ধুয়ে দিক ক্ষুদ্র না পাওয়াগুলোকে।

 


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
সম্পর্কিত ব্লগ
আমার ডিভাইস ভাবনা

আমার ডিভাইস ভাবনা

২২ জানুয়ারী ২০২৪

হৃদয়ে রক্তক্ষরণ

হৃদয়ে রক্তক্ষরণ

২৮ ডিসেম্বার ২০২৩

আমার বাচ্চা খায় না!!????

আমার বাচ্চা খায় না!!????

২৪ ডিসেম্বার ২০২৩

আক্রমনাত্মক দাওয়াহ!!!

আক্রমনাত্মক দাওয়াহ!!!

১৩ ডিসেম্বার ২০২৩