সাহিত্য

পার্থক্য-বৈপরীত্য!

পার্থক্য-বৈপরীত্য!
images.jpg4 শীত নাকি আসি আসি করছে,অথচ রোদের তেজ দেখে তো মনেই হয় না,যে এবার শীতের পোষাক পড়ার সুযোগ তেমন হবে! কি রোদরে আল্লাহ!বাধ্য হয়ে ব্যাগ থেকে ছাতা বের করল,এই রোদে আর কিছুক্ষন হাঁটলে মাথা ঘুরে পড়ে যেতে হতে পারে! ছাতা বের করতে করতে মোবাইলে ঘড়ির দিকে তাকালো, ১২.১০ বাজে,হাটার গতি বাড়িয়ে দিলো নাতাশা। দ্রুত বাসায় যেতে হবে,সকালে কোন রকম নাশতা বানিয়ে রেখে বেরিয়েছিলো,টেবিলে রেখেও আসতে পারেনি,দুপুরে কি রান্না হবে তাও ঠিক করেনি। তার উপর আজকে ছুটির দিন,বাসা ভর্তি মেহমান! হরতালের কারণে এ ক'দিন স্কুলে ক্লাস হয়নি,তাই আজ শুক্রবারে ক্লাস নিতে যেতে হয়েছে,ওদিকে গ্রাম থেকে দুই ননদ আর দেবরের বউ এসেছে বাচ্চাদের কে নিয়ে বেড়াতে। শ্বাশুড়ি নাতাশার কাছেই থাকেন,তাই সবাই এই বাসাতেই উঠেছে। এ ক'দিন খুব একটা সমস্যা হয়নি মেহমানদারি করতে,কিন্তু বিপত্তিটা বাঁধল আজকেই! রাতেই নাতাশা চেয়েছিলো সব কিছু রেডি করে রাখতে কিন্তু বাজার করা ছিলো না বলে ঝামেলাটা বেশি হলো! সকালে ফজর পড়ে এ মাসের বাজারের লিস্ট করে শরীফ এর দিকে দিতেই বান্দা হাই তুলে বলল, - রেখে যাও টেবিলে,আমি ৯টার দিকে বের হবো। নাতাশা বিরক্ত কন্ঠে বলল, - তো রান্না করবো কখন?! আজকে আমার স্কুল খোলা,সকালের নাশতার সাথে সাথে দুপুরের খাবারের অন্তত ২টা আইটেম হলেও তৈরী করে রেখে যেতে হবে,বাসায় মেহমান আছেন,তার উপর আজকে শুক্রবার, বুঝো না তুমি? শরীফ মনে হলো না খুব একটা বুঝলো,বালিশে মাথা রাখতে রাখতে বলল, - তুমি একটু দ্রুত চলে এসো তাহলেই হবে,আমি অনেক টায়ার্ড আজকে না ঘুমালেই না!প্লিজ ডিস্টার্ব করো না। নাতাশা একটা নিঃশ্বাস ফেলে কিচেনের দিকে চলে গেলো! সবাই শুধু সবার টা ই বুঝে,এর মধ্যে নাতাশা নিজেই বা কি করবে? শরীফ তার দিক বুঝলো,শ্বাশুড়ি তার মেয়েরা বেড়াতে এসেছে,সে দিক বুঝবেন,স্কুল তাদের রুলস-ফায়দা বুঝবে এর মধ্যে সব কিছু ম্যানেজ করতে গেলে নাতাশার অবস্থাটাও যে কাউকে বুঝতে হবে এমন কোন অবস্থা ই নেই! মাসের শেষের দিক থেকে শরীফ কে তাগাদা দিচ্ছে বাজার করার জন্য,বাট তার ছুটির দিন ছাড়া সময় নেই,অন্যদিকে নিজের ২বাচ্চা অসূস্থ থাকায় ওদের নিয়ে ব্যস্ততা সাথে মেহমানদের ঝামেলার কারণে নিজেও পারেনি কিছু টুকটাক বাজার করে রাখতে,তার উপর আজকে ছুটির দিনেও স্কুল খোলা,মিস করার কোন চান্সই নেই। ২টা ক্লাসে পরীক্ষা নিতে হবে,কিছু খাতা পেন্ডিং ছিলো সে গুলোও জমা দিতে হবে,নতুন চ্যাপ্টার পড়ানো শুরু করতে হবে,কত্তো কাজ! উফফ...... এর নাম নাকি জীবন,সংসার!! নাশতা বানাতে বানাতে দেখলো ঘড়ির কাঁটা ৮টা ছুঁই ছুঁই! একেক জনের একেক রকমের পছন্দ,কেউ পরোটা তো কেউ রুটি,কেউ ডিম শুধু ভাজি,কেউ আবার পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে করা ভাজি,কেউ আবার আলুভাজি ছাড়া খাবেই না! শ্বাশুড়ি রুটি খান না,তার জন্য আলাদা করে সবজি-খিঁচুড়ি তৈরী করে কিচেনে থাকা অবস্থাতেই বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরী হলো নাতাশা! পেটে ক্ষুধা জানান দিলেও এই মুহুর্তে মুখে দেয়ার মতো সময় নেই,ফ্রিজ থেকে একটা আপেল নিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে দ্রুত বের হয়ে আসার সময় মনে পড়লো,মেয়েটা কে ঔষুধ খাওয়ানো হয়নি,গত ২টা রাত মেয়েটা জ্বর-পেটের অসুখের কারণে নিজেও ঘুমাতে পারেনি,সাথে নাতাশাও! জা'কে ডেকে ফলের জুস আর ঔষধ বুঝিয়ে দিয়ে অনুরোধ করলো,মেয়েটা উঠলেই যেনো একটু জোর করে হলেও খাওয়ায়,আর কষ্ট করে যেনো সবাই একটু নাশতাটা করে নেয়। বলেই দ্রুত বেরিয়ে পড়লো,৯টার ক্লাস শুরু হতে বেশি সময় বাকী নেই বলে! রিকশায় বসে আপেল টা খেতে খেতে মনে হলো, ছেলে-মেয়ে দু'টো ফুপি-চাচীর হাতে নাশতা খাবে তো? শরীফ যদি নিজে খাওয়ার সময় সাথে নিয়ে একটু আদর করে খাইয়ে দেয় তাহলে অনেকটা নিশ্চিন্ত হওয়া যেতো,কিন্তু শরীফের বাচ্চাদের সাথে বসে ওদের খাওয়ানোর মতো ধৈর্য্য খুব একটা নেই,আর তারউপর এখন বাচ্চা গুলো অসূস্থ,ওদের মুড তো আরো খারাপ! বড় বড় করে বার কয়েক নিঃশ্বাস নেয় নাতাশা,মাথাটা হালকা করার জন্য! স্কুলে ঢুকা মানে এ আরেক দুনিয়া,এখানে সংসার নিয়ে মাথা ঘামানোর সুযোগ নেই! বছর পাঁচেক হয়ে গেলো স্কুলে চাকরীর কিন্তু এখনো এমপিও ভুক্ত হতে পারেনি,অনেক কষ্টে নিবন্ধনটা করেছে তবুও হই হই করেও হচ্ছে না!ভালোলাগে না আর এভাবে! খাঁটুনি ঠিকই করছে কিন্তু ফল তেমন পাচ্ছে না,চাকরি টা যে ছেড়ে দিবে তারও উপায় নেই! সংসারের যা খরচ তার উপর শরীফের কোম্পানী প্রায় মাসেই বেতন আটকে দেয়,সে দিক থেকে সংসার চালাতে তার এই এই ৭হাজার টাকা অনেক কিছু। রোদের পুড়ে বাসায় ঢুকে ডায়নিং এ ব্যাগ রেখে ২গ্লাস পানি খেয়েই সোজা কিচেনে ঢুকলো নাতাশা। কিচেনে কোন বাজার না দেখে কপাল কুঁচকে উঠলো!শরীফ কি বাজার করেনি??!! আশ্চর্য তো!! বেড রুমে এসে দেখলো বাচ্চারা বিছানা-মেঝে একাকার করে রেখেছে,শরীফ সম্ভবত বাথরুমে গেছে গোসলের জন্য। শ্বাশুড়ির রুমে দেখলো ননদ এর সাথে গল্প করছেন,ড্রয়িং রুমে টিভি দেখছে বাকীরা! নাতাশা ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো! কি করবে বুঝতে পারছে না,এদিকে খুব ক্লান্ত লাগছে,আবার ক্ষুধাও লেগেছে! ভাবতে ভাবতে ডায়নিং টেবিলের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো!!! দ্রুত হাতে সেগুলো খুলে বিস্ময়ে-আনন্দে চোখে পানি চলে আসলো নাতাশার! ৩টা টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি খাবার রান্না করে পাঠিয়েছেন আম্মু! পোলাউ,দু'রকমের মাংস,সবজি-ফিরনি সবই তৈরী করে দিয়েছেন! কিন্তু কখন পাঠালেন এগুলো?!! বেডরুমের বাথরুমের দরজা খোলার আওয়াজ পেলো,নাতাশা আরো অবাক হলো,ভেবেছিলো বাথরুমে শরীফ ঢুকেছে এখন দেখলো না আম্মু ঢুকেছিলো! ওকে দেখে মায়া ভরা হাসি দিয়ে বললেন, -এসেছিস? জলদি হাত মুখ ধুয়ে ক'টা মুখে দিয়ে বাচ্চাদের গোসল করা,ঐ যে আমি খাবার নিয়ে এসেছি। আবেগে কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে আসছিলো যেনো!অনেক কষ্টে নাতাশা বলল, -তুমি এগুলো কখন করলে? সেই উত্তরা থেকে এই মিরপুর তুমি কার সাথে আসলে? -কাল রাতে তুই যখন বললি,আজ স্কুল খোলা-বাজারও করা নেই,তখন ঠিক করলাম,সকালে উঠে বাসার সবার জন্য রান্না করে,তোর জন্য খাবার নিয়ে ১০টার দিকে আসলাম,নিয়াজ সিএনজি ঠিক করে দিলো। এসে তো দেখি পুরো বাসা অগোছালো,তোর শ্বাশুড়ি-ননদরা রাগে ফুলে একাকার,বাচ্চারাও কিচ্ছু খায়নি,শরীফ ঘুমাচ্ছিলো! পরে আমি এসে নানুমনিদের খাওয়ালাম,ওদের কে টেবিলে নাশতা দিলাম,তোর শ্বাশুড়ির সাথে কথা বলে তার অভিযোগ-রাগ হালকা করলাম,সব কিছু গোছগাছ করলাম! এখন শরীফ বাজারে গেছে,এসেই আবার নামাজে যাবে,এবার তুই ঝটপট কিছু খেয়ে নিয়ে কাজে নেমে পর,আমি আবার বিকেলে চলে যাবো। বলতে বলতে মা নাতাশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বাচ্চাদের রুমের দিকে চলে গেলেন। নাতাশা আর নিজেকে সামলাতে পারলো না,টেবিলে মাথা রেখে হু হু করে কেঁদে ফেলল! এই না হলে মা? কেমন করে,কতো সহজেই সব কিছু ম্যানেজ করে ফেললেন। সেই কোথা থেকে মেয়ের জন্য রান্না করে নিয়ে এসেছেন,মেয়ের অগোছলো সংসার সামলেছেন! শুধু মাত্র রাতে ফোনে মেয়ের মুখ থেকে একটু শুনেই বুঝে গেছেন,তার মেয়ের জন্য আজকে সব কিছু ম্যানেজ করতে কতো ঝামেলা হবে! মাঝে মাঝে নাতাশার আফসোস লাগে,শ্বাশুড়ি যদি ওর কষ্টের একটু ভাগ নিতেন,কিংবা শরীফ যদি আরেকটু সাহায্য করতো,তাহলে কতো কিছুই না সহজ হয়ে যেতো! প্রথম প্রথম নাতাশা কিছু হলেই মা কে ডাকতো সাহায্যের জন্য,কিন্তু যখন দেখতো তার নিজের মা তার বাসায় এসে মেঝেতে বসে বসে পেঁয়াজ কাঁটে আর শ্বাশুড়ি পাশেই চেয়ারে বসে পান খেতে খেতে তার নামে অভিযোগ করেন,অন্যদের বদনাম করেন তখন অসম্ভব খারাপ লাগতো নাতাশার! মনে হতো,এভাবে ও নিজের মা কে নিজেই অপমান করছে! তারপর থেকে আর মা কে ডাকে না,সমস্যা হলেও বলে না। বরং সমস্যার সমাধান করে সেটার গল্প মা কে শোনায় তাতে মা ও আনন্দ পায় নিজের কাছেও শান্তি লাগে। নাতাশা জানে,মা আসলে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কেন চলে গেলেন,কারণ তার চোখও ভিজে উঠেছিলো,আর তা আড়াল করার জন্যই চলে গেছেন! কলিংবেলের শব্দ পেয়ে দ্রুত চোখ মুখে দরজা খুলে দিলো,শরীফ বাজার করে এসেছে,ওকে দেখে বলল, - এই নাও,তোমার সংসার! কিছু কি বাকী পড়লো নাকি তা পরে দেখো,এখন আগে আমার পাঞ্জাবি বের করে বিছানায় রাখো,নামাজের সময় বেশি বাকী নেই,মসজিদে যেতে হবে। বাজার গুলো কিচেনে রাখতে রাখতে নাতাশা শুনতে পেলো শ্বাশুড়ি বলছেন, - ও বউ,পোলাটা বাজার থেইকা আইলো,এক গ্লাস শরবত বানাই দিছোনি? আনমনে একটা হাসি ফুটে উঠলো নাতাশার ঠোঁটে! তাতে বুঝি কিছুটা তাচ্ছিল্যো আর গর্বও মেশানো ছিলো! সমাজ আসলে বদলায় না,আজো ছেলের মা,মেয়ের মা বলে কিছু আলাদা রূপ সমাজে এখনো আছে,যার কাছে শহুরে-গ্রাম,শিক্ষিত-অশিক্ষিত বলে কিছু নেই! কি অদ্ভুত একটা বৈপরিত্য! একদিকে তার মা বনাম তার শ্বাশুড়ি,আরেক দিকে শরীফের মা বনাম শরীফের শ্বাশুড়ি!এর আগে দেখেছে নিজের দাদী আর নানীকে,দেখেছে তার শ্বাশুড়িকে তার ননদের শ্বাশুড়িকেও! পরিবারে-সমাজে মা'দের এই ভিন্ন ভিন্ন রূপ আর পার্থক্য-বৈপরিত্য কতো অদ্ভুদ ভাবে মিশে থাকে যুগের পর যুগ।

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
লেখকের অন্যান্য ব্লগ সবগুলো দেখুন