
বাচ্চাদের খাওয়াচ্ছি, এমন সময় তীব্র ‘টক্কক্কক্কক্কড়ড়ড়’ শব্দ দুপুরের নিরবতাকে খানখান করে দিলো।
-হাসিব, কী রে এটা?
-কক্কা
-কীই?
-চিনেন না? অই যে টিকটিকির মত, গায়ে অনেক আঁচিল, সাইজেও বড়। গোয়াল ঘরের টিনের নিচে আছে কয়েকদিন ধরে।
বলে নির্বিকারচিত্তে খাওয়া শুরু করে দিলো আমার ভাতিজা, বয়স আমার তিনভাগের এক ভাগ! বর্ণণা শুনে আমার বইপড়া জ্ঞানের সাথে মিলিয়ে মনে হল, প্রাণীটা গিরগিটি। দেখার জন্য গত তিনদিন ধরে লোক হাসাচ্ছি, পাজি গিরগিটি তার আস্তানা ছেড়ে বেরই হয় না। আর আমি ছেলেমেয়ে নিয়ে অধীর আগ্রহে তার ডাক শুনি, আর ফোন হাতে গোয়ালঘরের দরজায় পাহারা দিই।
ঈদে বাচ্চাদের নিয়ে ওদের দাদাবাড়ি এসেছি। বাচ্চারা একটু বুঝতে শিখছে, ওদের সাথে আমিও ‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর’ বলে নিত্যনতুন আবিষ্কারে মেতে উঠি।
বারান্দায় বসে বাচ্চাদের ফুটবল খেলা দেখছি, রাগী গলার ‘ঘ্র্যাঁঘোত’ শুনে তাকিয়ে দেখি কাপের সমান একটা প্রাণী, লাফিয়ে লাফিয়ে আসছে আমার দিকে। আমি তিনহাত লাফ দিয়ে উঠলাম, পাশের আরেকজন দর্শক মহাবিরক্ত,
-কি হইসে?
-মা, ঘরের ভেতর ব্যাঙ ক্যন?
-তো কই থাকবে?
আমি বোকা হয়ে যাই, বলে কি রে!!
বাসায় বাচ্চাদের খাওয়ানোর উপকরণ হল আমার ডাউনলোড করা বাংলা, আরবী, ইংলিশ রাইমস আর ভিডিওর সুবিশাল কালেকশন। কিংবা ছাদে গিয়ে গল্প বলা। সে আরেক কাহিনী। গল্পের বৈচিত্র্য এখানে বাধ্যতামূলক, শ্রোতারা বেশ মনযোগী, এক দিনের পুরানো হলেই আর সে গল্প শোনা যাবে না। হয় চরিত্র বা গল্প, যে কোন একটা বদলে দিতে হবে। তো, আমাকে নামতে হয় সত্যজিতের ভূমিকায়, লাইভ। আজকে কুমির আর শেয়ালের গল্পকে কালকে বোয়াল মাছ আর ইঁদুরের, আজকের কচ্ছপের নাম ‘গোলটু মিয়া’ হলে কালকের কচ্ছপের নাম ‘আলসে বুড়ো’!
আজ পাঁচদিন, আমার মুখ আর মাথা বেশ বিশ্রামে আছে। কারণ এইখানে গল্পের নায়কেরা স্বমূর্তিতে বর্তমান। অর্ধেকটা তেলাপোকা মুখে পালাতে থাকা টিকটিকি দেখিয়ে দ্বিগুণ ভাত খাওয়ানো যায়। নতুন কেনা মুরগীটার সাময়িক আটকাবস্থা (পোষা হয়ে যাবার অপেক্ষায় বেঁধে রাখা) বিকেলের ঘুম থেকে ওঠার পরের কান্নাটাকে গিলিয়ে দেয় অনায়াসে। উঠানে কাপড় মেলতে গিয়ে দেখি, তারের ওপর সারে সারে ফড়িং। চিৎকার করে উঠতে গিয়েও গিলে নিয়ে এদিক ওদিক তাকাই, ক্ষ্যাত হবার ভয়ে। মেয়েকে ডেকে দেখাই, ব্যাস পরের বেলা ঘুমানোর সময় আমিই গল্প শুনলাম, কিভাবে একটা ফড়িং ওর আম্মুকে না বলে বাইরে গিয়ে কি কি বিপদে পড়েছে...!
ইটকাঠের ঢাকায় এমন এক জায়গায় থাকি, ঘুম ভেঙ্গে আড়মোড়া ভাঙ্গার আগেই দেখি সিটি সেন্টার আর বাংলাদেশ ব্যংক ভবন। কাঠখোট্টা হবার জন্য এই কি যথেষ্ঠ না? তবু নিজে প্রকৃতির যা জানি, বাচ্চাদের তাই শেখানোর লোভে অনেককে অনেক অনুরোধের পর ছাদের দিকে একটা ছোট্ট দরজা করেছি। সাড়ে চার বছরের মেয়েটা যখন অনেক দূর থেকেই শুধু লেজ দেখেই দোয়েল বা বুলবুলি চেনে, আত্নপ্রসাদ আসে বৈকি।
আর এখানে, প্রকৃতির কোলে, প্রকৃতি তার সাবলীল ভঙ্গিতেই পরিবেশন করে যাচ্ছে তার অপার ঐশ্বর্য্য। প্রতিবার সুবহানাল্লাহ আর আলহামদুলিল্লাহ বলতে গিয়ে থমকে যাই। একটা সদ্যোজাত শিশুর ফুটো হওয়া পিঠের ছবি থমকে দেয় সব ইচ্ছাগুলোকে। সান্তনা একটাই, সাধ্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছি। আল্লাহর দেয়া নিয়ামতের কানায় কানায় পূর্ণ পাত্র থেকে আমার পাওনাটুকু নিচ্ছি শুধু, কারও পাওনা মাড়িয়ে না দিয়ে, কোন বিলাসিতায় ডুবে না গিয়েই।
''এখানে রাতের ছায়া ঘুমের নগর,
চোখের পাতায় ঘুম ঝরে ঝরঝর।
এইখানে খেলাঘর পাতা আমাদের,
আকাশের নীল রং ছাউনিতে এর।
পরীদের ডানা দিয়ে তৈরি দেয়াল,
প্রজাপতি রং মাখা জানালার জাল।''
--আহসান হাবীব
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)