
প্রায় অনেক বছর পর,
বই খুঁজতে যেয়ে বেশ পুরনো অফহোয়াইট মলাটের ডায়রীটা হঠাত হাতে আসল। অনেকদিন হয়ে গেছে,ডায়রি লিখি না,নিজের সাথে নিজে কথাও বলি না! আজকাল কি আসলেই অনেক ব্যস্ত থাকি নাকি ব্যস্ততার মাঝে ডুবে থাকি জানি না,তবে এখন আর ওভাবে নিজের কথা ভাবার সময়ও হয় না!অনেক বদলে গেছে সব কিছু। একটা সময় ছিলো,ডায়রীর পাতায় কালির আঁচড় না বসালে আমার দিন ফুরাতো না! আমার ডায়রী গুলো আমার আমির কথা বলতো...
ভাবতে ভাবতে আনমনে পাতা উল্টাতে উল্টাতে এক পাতায় যেয়ে জুহিদের ঘটনাটা চোখে পড়ল!হঠাত করেই থমকে গেলাম! জুহি...
অনেক দিন পেরিয়ে গেছে,এর মধ্যে বদলে গেছে অনেক কিছু!কেমন আছে এখন জুহিরা? কেমন আছে শিমু ভাবি?
মানুষের একটা স্বভাব হলো,
ব্যস্ততার মাঝেও হঠাত করে যখন কারো কথা মনে পড়ে যায়,তখন কেন জানি অদ্ভুদ অস্থিরতা কাজ করে!মনে হয়,
'ইশ,যদি একটু খোঁজে পেতাম মানুষটার!কেমন আছে,কি করছে এখন? কিছু যদি জানা যেতো!'
এমন হাজারো চিন্তা এসে ভর করে,তারপর এক সময় আবার কাজের ভীড়ে তা হারিয়েও যায়। তবে জুহিদের ব্যাপারটা আমার মাথা থেকে সহজে গেলো না। ইনডেক্স খুঁজে নাম্বার বের করে, রিদু কে ফোন দিলাম,ও এখন আছে খুলনা,বিসিএস দিয়ে ওখানেই জয়েন করেছে এক কলেজে। এতো বছর পর হঠাত জুহিদের খবর জানতে চাওয়ায় বেশ অবাক হলো রিদু! তেমন কোন খবর অবশ্য ও দিতে পারলো না,শুধু জানালো জুহি পড়াশুনা করতে গেছে ইউএস এ,সম্ভবত ওখানেই স্যাটেল হয়েছে।
কেমন আছেন তাহলে শিমু ভাবি এখন?উনিও কি এখন উনার শ্বাশুড়ির মতো একলা দিন কাটাচ্ছেন? কে জানে! হয়তো!
আসলে জীবন কখনো স্বাভাবিক ভাবে,কখনো বা অদ্ভুদ ভাবে বদলে যায়! সেটা মানুষ চায় কি না চায়। আজ হয়তো শিমু বুঝতে পারছেন, নিজের ভুল গুলো,হয়তো...
সময়ের সাথে সাথে আমিও বদলে গেছি! মানুষকে বুঝতে শিখেছি,বাঁচতে শিখেছি মানুষের মাঝে,একা একা নয়। বদলে গেছে বাবা,বদলে গেছে মা ও।
কনভোকেশন প্রোগ্রামের দিন আমার রেজাল্টে খুশী হয়ে বাবা জিজ্ঞেস করেছিলেন,
-কি চাসরে মা?বলে ফেল।
আমি জীবনে প্রথম বাবা কে অবাক করে দিয়ে বলেছিলাম,
-বাকী জীবন,তোমাকে আর মা কে নিয়ে একসাথে থাকতে চাই!
অনেকটা সময়ের জন্য বাবা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। আমার অশ্রু ভরা চোখের দিকে তাকিয়ে নিজের ঢেকে রাখা অসহায়ত্ব কে বুঝাতে চাইছিলেন। আর মা?
দেয়ালে হেলান দিয়ে আমার মাথায় শুধু হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। দু'জনে এর বেশি আর কিছুই বলেননি।আর ঐদিনের পর আমিও আর কিছু ভাবিনি। কিছু অসম্পূর্ণতা নিয়েই তো জীবন,এই আধেক সুখ-দুঃখ গুলোই অনুভূতির ভারসাম্য।
তারপর একে একে অসংখ্য সিঁড়ি পেরিয়েছি। 'টুকরো ঘরের' মেয়ে হয়েও অনেক ঘর জুড়তে সাহায্য করেছি,ঐ হাসি-আনন্দ গুলোর মাঝেই নিজের আধেক গুলো পুরো করেছি।
বাসায় ফিরে,নিজের রুমে যাবার আগে দেখে নিলাম পুরো বাসাটা,মা তার রুমে কলেজের খাতা চেক করছেন! মাঝে মাঝে বাবা বেড়াতে আসেন আমার এখানে! তখন মা সহজে রুম ছেড়ে বের হোন না। নাহ,কোন কালেই এদের দূরত্ব আর কমানো গেলো না।
অবশ্য এখন আমার ও নিয়ে আফসোস কম। আমি শুধু অপেক্ষায় থাকি,কবে ছুটিতে বাবা আসবেন,ক'টা দিন তখন আমি রোজ সকালে উঠে,আর রাতে ঘুমাতে যাবার আগে যে,বাবা-মায়ের মুখটা দেখতে পারি,আমার জন্য এই ই তো অনেক!
মায়ের সাথে থেকে আমি বুঝতে শিখেছি,একাকীত্ব কত কষ্টের! যদিও এখন আর জ্বর হলে আমাকে একা একা প্যারাসিটামল খেতে মাথায় পট্টি দিতে হয় না,একা একা কুলফি খেতে হয় না। তবুও বুঝতে পারি,মা এর কষ্ট টা। কিছু করার নেই আমার,এই জীবনটা ই হয়তো তিনি চেয়েছিলেন,অথবা এমন জীবন ই তার প্রাপ্য ছিলো।
খুব বেশি না হলেও একটি-আকটু বুঝতে পারি,বাবা-মায়ের মাঝে সন্তান হচ্ছে খুব শক্ত একটা বাঁধন। এই বাঁধনটার অনেক শক্তি আছে,বছরের পর বছর দু'টো মানুষকে এক করে রাখার শক্তি। এই বাঁধনটা যদি ঢিলে হয়,ছিঁড়ে যায় তাহলে বাবা-মা দু'টো সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ হয়ে যেতে একটুও দেরি হয় না। সব সময় যে,বাবা-মা কে ই এই বাঁধন শক্ত করতে হবে এমনটা না,কখনো কখনো সন্তানও পারে।
জুহির দাদীর সেই একলা দিন গুলো আমাকে শিখিয়েছে,বাবা-মায়ের সন্তানকে ছাড়া একলা থাকতে কতো কষ্ট হয়! কত কষ্ট হয় দিনের দিনের পর দিন সন্তানের মুখের ডাক না শুনে থাকতে!আর এখন মা-বাবা কে দেখে শিখেছি,নিজেদের মধ্যে যাই কিছুই থাকুক না কেন,সন্তানের জন্য আসলে আলাদা জায়গা থাকেই,কখনো আবার সেই জায়গা টাই নতুন সুযোগ দেয় আবার কখনো বছরের পর বছর ঐ জায়গাটা বিরান ই থেকে যায়। আর তাই,আমি সারাক্ষন চেষ্টা করি,এই দুই মেরুর মানুষ দু'জন কে সঙ্গ দিতে,তাদের একাকীত্বের ভাগ নিতে।
তিয়াসী এখনো কবিতা লেখে। মাঝে মাঝে মেইল করে,সুযোগ পেলে মুঠো ফোনে ম্যাসেজ করে। আজকাল ঘুরে ফিরে মাথায় তিয়াসীর লেখা কবিতার কিছু লাইন মাথায় ঘুরে,
'আমার সুখ খোঁজার বেলা কই?
যখন আপনাতেই ডুবে রই!
আমার একলা থাকার দুঃখ কই?
যখন এপাড়-ওপাড় থৈ থৈ!
এবার বেলা পড়ে এলো বলে
সঙ্গী তবে হোক সময়,
সুখে-দুঃখের সব জানালায়
চির বসন্তের বাতাস বয়।'
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)