সাহিত্য

অবার্চিনার গল্প-৩

অবার্চিনার গল্প-৩
551532_455753654512912_223215756_n পাঁচ, আমার মাঝে মাঝে মনে হয়,আমি মানুষটা একটু বেশিই আত্নকেন্দ্রিক! মানুষকে আমি আমার কাছে ভীড়তে দেই না!আর তাই কারো সাথে আমার অন্তরঙ্গ বা আত্নার সম্পর্ক হয় না,আমি মানুষকে বুঝলেও মানুষ বুঝতে পারে না আমাকে,বুঝতে পারে না,যে আমিও তার প্রতি আন্তরিক!দাদীও বোধহয় সে জন্যই আমাকে সেদিন আপন ভেবে দাবী খাটিয়ে বলতে পারেননি,'আমায় একটু বাসায় নিয়ে চল'! এই প্রথম আমার মনে হচ্ছিলো,আমি বোধহয় চাইলে পারতাম আমার বাবা-মা কে একসাথে ধরে রাখতে!আসলে আমার বাবা-মা আমাকে অনেক ভালোবাসেন,কিন্তু আমি তাদেরকে একদমই ভালোবাসি না,কোন দিন বাসিও নাই! বাবা-মা কে আমি যতটা স্বার্থপর ভেবেছিলাম,আজ মনে হচ্ছিলো আমি নিজে তার চেয়েও অনেক বেশি স্বার্থপর! কোনদিন ভালোবাসা নিয়ে,বাবা কে ডাকিনি,মা কে জড়িয়ে ধরিনি! জানি উনারা আমাকে ভালোবাসলেও একে অন্যকে ভালোবাসতেন না,কিন্তু আমি তো তাদের কাউকেই ভালোবাসিনি! বরং তাদের ব্যাবধানের কারণেই হোক,আমার এই ছন্নছাড়া জীবনটাকেই আমি অসম্ভব ভালোবেসেছি। আর কোন কিচ্ছু নিয়ে ভাবিনি কখনো,কাউকে নিয়ে না। কোন দিন অভিমান নিয়ে বা অধিকার নিয়েও বাবা-মা কে বলিনি, -তোমরা আমার জন্য হলেও একসাথে থাকো,আমাকে আর দশটা স্বাভাবিক মানুষের মতো বাঁচতে সাহায্য কর!' জীবনে প্রথম আমার ইচ্ছে হলো,একটু বাবা-মায়ের সাথে কথা বলতে!তাদের কন্ঠ শুনতে!বড্ড অবেলায়। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন দিলাম বাবা কে,বাবা তখন ব্যাস্ত রাতের খবর দেখা নিয়ে। আমার কল দেখে অবাক হলেন!অনেকবার হ্যালো হ্যালো করলেন,কিন্তু আমি এপাশ থেকে কান্নার দমকে কিচ্ছু বলতে পারলাম না! এরপর মা কে ফোন দিলাম,কিন্তু মায়ের সাথেও কথা বলতে পারলাম না! অনেকক্ষন একা একা কাঁদলাম...অনেকক্ষন! বোধহয়,জীবনে প্রথম আমার মনে হলো,আমি একলা একটা মানুষ!সবার জন্য অনেকেই আছে,সবাই অনেকের জন্য থাকে,কিন্তু আমি কারো জন্যই নই,ছিলাম ও না কোনদিন! আমার বিশাল সার্কেল আছে বন্ধুদের,কারণ,আমাকে সবার ই দরকার হতো কিন্তু আমার সেভাবে কাউকেই দরকার হতো না!আমি কাছের বন্ধু আমি কাউকেই বানাইনি,আমার জগতটাতে কাউকেই ঢুকতে দিতে চাইতাম না বলে!তারপরেও কিছু বন্ধু ছিলো যারা সারাক্ষন আমার জন্য ভালোবাসা,মায়া নিয়ে অপেক্ষা করতো। কলেজ ছেড়ে যখন চলে আসি,তখন আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু রিজ্জু,তিয়াসী ছলছল চোখে বলছিলো, -দোস্ত,তুই কি আমাদের সাথে দেখা করার জন্য কখনো রাজশাহী আসবি না? আমি কঠিন স্বরে বলেছিলাম, -নাহ!ছাড়লাম দেশের আবার মায়া কি? -তোর কি আমাদের দেখতে ইচ্ছে করবে না কখনো? -শোন,আমি এসব ইচ্ছে এর মূল্য জীবনে দিতে শিখি নাই!তাই আমাকে এসব নিয়ে ভাবতে বলিস না। আমার একলা থাকতেই ভালো লাগে,জানিস ই তো! আমি সেদিন মিথ্যে বলেছিলাম!এই এতো গুলো বছরে প্রায় রোজই ওদের কথা অনেক মনে পড়েছে,অনেকবার দেখতে ইচ্ছে হয়েছে,অনেকবার। প্রচন্ড ঝাল মিশিয়ে ফুচকা খাওয়ার সময় অথবা পরীক্ষার সময় পড়ার চাপে মনের ভুলে মরিচ বেশি দিয়ে ভর্তা বানিয়ে ভাত খাওয়ার সময় মনে হতো,এখন যদি সেই সময়ের মতো বলা নেই হঠাত কুলফি আর পানির বোতল হাতে রিজ্জু এসে হাজির হতো! কিংবা জ্বরের ঘোরে কাঁপা হাতে প্যারাসিটামল খেয়ে,মাথায় পট্টি দিতে দিতে,অথবা বৃষ্টিতে ভিজে হাঁচি দিতে দিতে মনে হতো,এখন যদি হুট করে এককাপ কড়া লিকারের আদার চা কিংবা প্রিয় খিচুড়ী প্লেটে নিয়ে তিয়াসী হাজির হতো! হাতে টাকা নেই,কিন্তু বই কেনার নেশা চেপেছে তখন খুব মনে হতো,এখন যদি সেতু এসে হাতে একগাদা নতুন বই ধরিয়ে দিয়ে বলতো,'নে ধর,পড়ে বিদ্যান হয়ে আমাকে লেকচার দিস!' কিংবা ক্লাস শেষে সাইকেলটা রেখে যেয়ে বলতো,'সন্ধ্যায় উড়তে বের হইস,তবে চাকা পাংচার যেনো না হয়!' শহরের ব্যস্ত গলিতে হাঁটতে হাঁটতে যখন বেলী ফুলের মালা খুঁজতাম তখন খুব মনে হতো,পিয়ালী যদি এখন ওর গাছের ফুল ছিঁড়ে মালা বানিয়ে আমার হাতে জড়িয়ে বলতো,'নেরে সখী,ভালোবাসা নে...তুই ই সব নে,আর কাউকে লাগবে না!' খুব মনে পড়তো ওদেরকে,সময়ে-অসময়ে,চলতে পথে অনেকবার... কতোভাবেই না ওরা আমাকে খুঁজতো!কখনো ফোনে,কখনো সোশ্যাল সাইটে,কখনো আত্নীয়-বন্ধুদের অনুষ্ঠানে। তিয়াসী কতো করেই না রিকোয়েস্ট করেছিলো,ওর বিয়েতে যাবার জন্য! আর রিজ্জু? মেইলের পর মেইল করেছিলো,দেশ ছেড়ে যাবার আগে যেনো একটাবার দেখা করি! আমি ভেবেছিলাম,আমার এসব কীর্তির পর ওরা আমাকে আর কখনোই মনে করবে না!ঘৃণা করবে! কিন্তু মানুষ গুলো বড্ড বেশিই পাগল! তাই এখনো প্রতি জন্মদিনে মা ফোন দিয়ে বলে, -তোর জন্য পার্সেল এসেছে,কাবার্ডে রেখে দিলাম,এসে দেখিস! দিন দিন আমি অপরিচিতদের জন্য যতটা না পরিচিত হয়েছি,তার চেয়ে বেশি অপরিচিত হয়েছি পরিচিতদের জন্য। আজ এতো বছর পর এসে,তাদেরকে যতটা না অপরাধী মনে হচ্ছে,তার পাশে নিজেকেও অনেক অপরাধী লাগছে! ছয়, দাদির মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ পর একটা অদ্ভুদ খবর আমার কানে আসলো! জুহির মা আমাকে ডেকে নিয়ে খবরটা দিলেন। আর সেটা হলো, দাদী তার নিজের নামের একটা ফিক্সড ডিপোজিট নাকি আমাকে দিয়ে গেছেন!!! খবরটা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে শিমু ভাবির দিকে তাকিয়ে রইলাম!! কিন্তু তার পরের খবর শুনে আরো হতভম্ব হলাম!যখন শিমু ভাবি আমাকে বললেন, -শোন মেয়ে,আমার শ্বশুড় এই টাকা আমার শ্বাশুড়ি কে দিয়ে গিয়েছিলেন,নিয়ম অনুযায়ী এই টাকা জুহির বাবার!কিন্তু হঠা করে একটা বাইরের মেয়ে এসে আম্মাকে পটিয়ে সেই টাকা নিয়ে যাবে,এটা তো আমরা মানতে পারছি না!জানি শেষের দিকে তুমি মা কে অনেক সময় দিয়েছো কিন্তু তাই বলে... ভাবির কথা শুনে আমার মনে হলো,আমি কোন বাংলা সিনেমার দৃশ্য দেখছি!আর না হলে কোন বঙ্গীয় সিরিয়াল! আরে আগে তো ব্যাপারটা আমাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলবে,তারপর তো জানতে চাইবে আমার মতামত! তা না করে সে কি বলে যাচ্ছে!টাকার জন্য উনারা আমাকে যা খুশী ভাবছেন,এক ঝাটকায় আমাকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন! অথচ আমি তো ভাবছি ঐ মানুষটার কথা,যিনি জীবনের শেষ দিন গুলোতে কতটা একলা আর অসহায় ভাবতেন নিজেকে!যার জন্য আমার মতো ক'দিনের পরিচিত মানুষের সঙ্গ পেয়ে এতোটাই খুশী হয়েছিলেন,যে নিজের অর্জিত অংশের একভাগ আমাকে দিয়ে গেছেন!আর এদিকে তার ছেলে-বৌ তো অনেক কিছুই ভেবে বসেছে! মানুষের কাছে টাকা টা এমন করে 'এতকিছু' কেন হয়ে যায়?যে সে সব কিছু ভুলে যায়! আজকের দিন টা চলে যাবে,কাল আমিও চলে যাবো,আস্তে আস্তে দিন,মাস,বছর চলে যাবে। কিন্তু থেকে যাবে এই কথা গুলো! আর ক'বছর পর যখন জুহির মা ও ঠিক একইভাবে দাদীর মতো একলা হয়ে যাবেন,তখন কি বুঝবেন তার শ্বাশুড়ির কষ্টটা? তার কি তখন মনে পড়বে আমার কথা? নাকি তখনো তার মনে পড়বে এই টাকা গুলোর কথা। আজকের পর জীবনের বাকীটা সময় আমার দাদীর কথা খুব মনে থাকবে,মনে থাকবে তার অসহায় দিন গুলোর কথা,আর রেখে যাওয়া দুঃখ গুলোর কথা। এরপর থেকে ও বাসায় যাওয়া আমি বন্ধ করে দেই। শিমু ভাবি মানে জুহির মা তবুও সেদিন রিদু কে ডেকে নিয়ে আমার নামে অনেক গুলো কথা শুনিয়েছেন!জুহির মা যখন আমাকে শক্রু ভাবতে শুরু করেছেন তখন আর এই এলাকাতেই আমার থাকার মতো অবস্থা নেই,তাই এখান থেকে চলে যাওয়াই উত্তম।

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)