সাহিত্য

অবার্চিনার গল্প-২

অবার্চিনার গল্প-২
551532_455753654512912_223215756_n তিন, ব্রোকেন ফ্যামিলি কথাটা আমার পছন্দ না,তাই আমি বলে থাকি,টুকরো ঘর! আমি টুকরো ঘরের মেয়ে,যে ঘরটায় সব মানুষ থেকেও থাকে না,কিংবা ঘরের মানুষ গুলোই আর ঘরে থাকতে চায় না,সেটাই 'টুকরো ঘর'। আমার বাবা থাকেন সূদুর সুনামগঞ্জ প্রায় ৫বছরের বেশি হবে! বাবা আর মায়ের মধ্যে আসলে বোঝাপড়াটা কখনোই ভালো ছিলো না,বিয়েটাও হয়তো নিজেদের ইচ্ছায় ছিলো না! দু'জনেই দু'জনের কাছ থেকে দূরে থাকতে চাইতেন,কি নিয়ে আসল সমস্যাটা ছিলো তা এখন পর্যন্ত জানা হয়নি,বলা যায় জা্নার চেষ্টাই করিনি! শুধু দেখেছি,বাবা-মা দু'জন কখনোই দু'জনকে সহ্য করতে পারতেন না। আর তাই যখন বাবার বদলীর ওর্ডার আসলো তখন সাথে সাথেই মা বলে ফেললেন, -আমি যাচ্ছি না কোথাও,তোমার চাকরী তুমিই যাও! আর নিতু কার সাথে থাকবে তা ওকেই ডিসাইড করতে দাও। ক্লাস এইটে পড়ুয়া আমি তখন কমিকস আর তিন গোয়েন্দার জগত থেকে মাথা বের করে কিছু ভাবার আগেই,দেখি এক সকালে বাবা ল্যাগেজ গুছিয়ে চলে গেলেন। ব্যাস,আমার 'টুকরো ঘরের" জীবনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছিলো সেদিন থেকেই। তবে আমি একটা ব্যাপারে বাবা-মা এর কাছে কৃতজ্ঞ এই জন্য যে,তারা সব সময় চেষ্টা করেছেন আমি যেনো তাদের মধ্যকার ঝগড়া,ক্ষোভ,ঘৃণা থেকে দূরে থাকি! তারা কখনো আমাকে এটা বুঝতে দিতে চাইতেন না,যে আমি তাদের জন্য এই অসম,যন্ত্রণাকর সম্পর্কের মাঝে একটা বোঝা স্বরুপ কেউ! তাই তারা ঝগড়া করতেন আমার অবর্তমানে!সব রকমের সিদ্ধান্ত নিতেন আলাদা ভাবে বসে,আমার সাথে কখনোই কিছু শেয়ার করতেন না। তবে আমাকে এসব দেখতে না দিলেও,সব সময় তাদেরকে আমি দু'মেরুতেই দেখতাম,দেখতাম বছরের প্রায় ৩৬৫ টা দিন,তাদের জন্য একই রকম! ছোট থেকেই আমি সব সময় ডুবে থেকেছি বই এর জগতে। বই পড়তে পড়তে আমি তৈরী করে নিয়েছি আমার নিজের আলাদা একটা জগত!এই জগত থেকে বের হয়ে এসে,বাবা-মায়ের রাগ-ঘৃণা বুঝবার মতো ইচ্ছে কোনদিন ই আমার হয়নি। বাস্তব জগতকে আমি সব সময় হালকা ভাবেই নিয়েছি!বাবা চলে গেছেন?যাক!কি এমন হয়েছে তাতে?বরং ভালোই হয়েছে,ছুটিতে সিলেট বেড়াতে যাবার সুযোগ হয়েছে। মা বাবাকে সহ্য করতে পারেন না?তো কি হয়েছে?সবার সবাইকে সহ্য করতে হবে এমন তো কথা নেই!মা তো আমাকে সহ্য করতে পারেন,এই ই অনেক! কলেজে উঠার পর জানলাম,মা চাইছেন আমি যেনো হোষ্টেল জীবনে অভ্যস্থ হই!উনি উনার মতো করে জীবন সাজাবেন।ব্যাস,শুরু করে দিলাম হোস্টেল লাইফ। সেই যে বাড়ি ছাড়লাম,আর ফিরে যাওয়া হয়নি! এখনো পর্যন্ত কোন ছুটিতে মাঝে মাঝে মায়ের কাছে যাই,মাঝে মাঝে বাবার কাছে কিন্তু এই নিয়ে কখনো আক্ষেপও করিনি। সিলেট যাবার বছর খানেকে এর মাথায় বাবা বিয়ে করেন তার কলেজ জীবনের এক বান্ধবীকে! ভদ্র মহিলার আগে একটা ৪বছর বয়সের ছেলে ছিলো,বাবার সাথে বিয়ের পর তার আরেকটা ছেলে হয়। নিজের কোন মেয়ে ছিলো না,আবার বাবাও আমাকে খুব ভালোবাসতেন বলেই হয়তো,আমি গেলে মহিলা খুব ভালো ব্যাবহার করতেন!আর আমি নিজের মতো থাকতাম,কোন উচ্চ-বাচ্চ করতাম না বলে তিনি বেশ শান্তি পেতেন। তবে মা নিজের মতো করে থাকতে চাইলেও বাবার মতো নতুন জীবন শুরু করতে পারেননি। মায়ের এক দুঃসম্পর্কের কাজিন মা কে খুব পছন্দ করতেন,মা চেয়েছিলেন তাকেই বিয়ে করতে কিন্তু ভদ্রলোক তার কথা রাখেন নাই। আর তাই চাকরী আর আমাকে নিয়ে একাই আছেন এখনো। আমি এখনো যখন ছুটিতে বাবা-মায়ের কাছে যাই,দু'জনেই প্রতিবার জিজ্ঞেস করেন,'কোন কষ্ট হচ্ছে না তো তোর?' আমি দৃঢ় ভাবে মাথা নাড়িয়ে না করি!নাহ, কোন কষ্টই হচ্ছে না আমার! আর হবেই বা কিভাবে? আসলে আমি তো কোনদিন জানার চেষ্টাই করিনি,যে আমি কিসে কষ্ট পাচ্ছি আর কিসে সুখ!বেঁচে আছি যে সূস্থভাবে এই তো আমার জন্য অনেক!খাচ্ছি,পড়ছি,ঘুমাচ্ছি ব্যাস। এর বাইরে আর কি ই বা আমার চাওয়ার থাকতে পারে? আর দশ জন কি করে আমার জেনে কি হবে?আমার জীবনটা আর দশ জনের মতো যখন না,তখন খামোখা ওসবের আফসোস করার মানে নেই! এভাবেই আমি ভাবতাম,এই বোধ নিয়েই নিজেকে তৈরী করে নিয়েছিলাম। তবে কলেজে থাকা অবস্থায় একদিন আমার রুমমেট তরু ওর বাবা-মায়ের ডিভোর্সের খবর শুনে সারা রাত যখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলো,তা দেখার পর আমি অনেক গুলো রাত ঘুমাতে পারিনি! কি এক যন্ত্রণা আমার ভেতরটা যেনো কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিলো,কিন্তু কাউকে বলতে পারিনি... আমি ছেলে না হয়ে মেয়ে হওয়াতে আমার বাবা-মা বোধকরি অনেকটা নিশ্চিন্ত ছিলেন!যাক,অন্তত নেশা-টেশা করে বখে যাওয়ার ভয় তো নেই!কিন্তু ঐ দিন গুলোতে আমার খুব ইচ্ছে করতো,এমন কিছুতে ডুব দেই,যাতে করে আমি ভুলে যেতে পারি বাবা-মায়ের মুখটা! খানিকটা সময়ের জন্য ভুলে যাই আমি কে!তবে হ্যাঁ,আমি আমার জগতে সব সময় একলা থাকতেই পছন্দ করতাম,আর কাউকে সহ্য করতে পারতাম না,সে জন্যই বোধ করি,বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে বখে যাওয়ার পথটা খোলা হয়নি কখনো। কলেজ বন্ধু তিয়াসী কবিতা লিখতো বেশ! একবার একটা কবিতা লিখে আমার টেবিলের দেয়ালে সাঁটিয়ে রেখেছিলো, তারচেয়ে একটা স্বপ্ন দেখি চল...তুই আমি হেঁটে চলেছি সবুজ বুনো ঘাস ছুঁয়েপ্রিয় লাল অথবা নীল অথবা শুভ্র সাদার আবেশ জড়িয়েকাশফুলের ভীড়ে,কোনদিন না হারাবার সুখ নিয়ে...নাহ,স্বপ্ন বোধহয়  বেশীই দেখা হয়ে যাচ্ছে,এত স্বপ্ন দেখার কষ্ট স্বপ্ন ভাঙ্গার কষ্টের চেয়েও কখনো অনেক বেশী মনে হয়...     চার, রিদুদের এই এলাকার বেশ প্রভাবশালী পরিবারের নাতনী জুহি কে পড়াতাম আমি। জুহির বাবা ব্যবসায়ী,আর মা পেশায় এডভোকেট,দু'জনেই আবার পলিটিশায়ন। আমি যখন পড়াতে যেতাম,তখন বাসায় থাকতো জুহি আর ওর দাদী,কাজের লোক। প্রথম প্রথম আমি ওকে পড়িয়েই চলে আসতাম,কিন্তু ধীরে ধীরে এক সময় ওর দাদীর সাথে খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে গেলো। ভদ্রমহিলা আমার সাথে অনেক গল্প করতেন,জীবনের গল্প তার সংসারের গল্প,ইচ্ছে-অনিচ্ছার গল্প। তার একাকী দিন গুলোর গল্প! আমি খুব আগ্রহ নিয়ে শুনতাম। যেদিন তিনি জানলেন,আমার বাবা-মা আলাদা থাকেন,সেদিন তিনি খুব অবাক হয়ে বলেছিলেন, -তোমাকে দেখলে কখনোই বুঝা যায় না,যে তোমার ভেতর কোন কষ্ট আছে!কি হাসি-খুশী থাকো সারাক্ষন! আমি হেসে বলেছিলাম, -দুঃখ তো কম বেশি সবারই আছে দাদী,কিন্তু সেটা নিয়ে বসে থাকলে কি আর দিন যাবে?আমি ওভাবে আসলেই ভাবি না,আপনিও ভাববেন না,ওকে? দাদী স্নেহের হাঁসি দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন। এভাবেই বেশ ভালো একটা সম্পর্ক হয়ে যায় দাদির সাথে আমার। মাস কয়েক আগে জুহির দাদী কে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসেন জুহির মা-বাবা। জুহি সপ্তাহে একদিন ওর দাদীর সাথে দেখা করতে যেতো,প্রথম কয়েক দিন ওর মা/বাবা সাথে গেলেও,সপ্তাহ কয়েক পর আমাকেই যেতে হতো। আমার কখনোই যেতে খারাপ লাগতো না,বরং জুহির দাদীর মতো মানুষের সাথে সময় কাটিয়ে আসতে ভালোই লাগত। প্রতিবার দেখা করে আসার সময়,জুহির দাদী আমার মাথায় হাত রেখে প্রাণ ভরে দোয়া করে দিতেন। মাঝে মাঝে সেই দোয়ার লোভেই যেতাম,আবার কখনো ঐ একলা মানুষটার খুশীর কথা ভাবতাম। আমরা গেলে তিনি অসম্ভব খুশী হতেন,বলা যায় সারা সপ্তাহ তিনি আমাদের জন্যই অপেক্ষা করতেন। শেষ বার যখন দেখা করে আসি,ফেরার সময় আমার মনে হলো দাদী খুব দুর্বল হয়ে যাচ্ছেন!আগের মতো নেই!আসার সময় আমার হাত টা শক্ত করে ধরে রেখেছিলেন,আমি যখন বললাম, -দাদী,আপনি কি অসূস্থ?এখানকার ডাক্তার কি ভালো ট্রিটমেন্ট দেয় না?তাহলে জুহির আব্বুকে বলেন,ভালো ডাক্তার দেখাতে! উনি মলিন একটা হাঁসি দিয়ে বললেন, -নারে বোন,এখানকার সবই ভালো!অসুখ তো হলো আমার মনে!তুই আবার জুহিদের বাসার কাউকে কিছু বলিস না,ওরা সবাই অনেক ব্যস্ত,খামোখা আমার জন্য কাজ ছেড়ে আসবে! আমি জোর গলায় বললাম, -মায়ের জন্য সময় বের করতে আবার খামোখা কি?আপনি কি তাদের জন্য করার সময়,অতো সময়ের হিসেব করেছেন?আমি আজই বলবো,না হয় আপনি ক'দিন বাড়ি থেকে ঘুরে আসবেন। -না না,তুই কিছু বলিস না,ওরা রাগ হবে অনেক!বুঝিস না কেন?তুই বাইরের মানুষ,তোর কাছ থেকে মায়ের খবর শুনলে ওদের মাইন্ডে লাগবে! আমার তখন বলতে ইচ্ছে হলো, দাদী,আমি জানি আপনার ছেলের সময় হয় না,আপনার খবর নেবার!তারচেয়ে বরং চলেন,আমি ই না হয় আপনাকে নিয়ে যাই! কিন্তু পারলাম না বলতে। তবে সেদিন ফিরে আসার পর থেকে,আমার ভেতরে ভেতরে খুব আফসোস কাজ করছিলো!ঠিক করলাম,পরের সপ্তাহে যেয়ে দাদীকে বাসায় নিয়ে আসবো,না হয় দু'টো কড়া কথা বলবে জুহির মা! কিন্তু আমার আর পরের সপ্তাহে দাদীকে দেখতে যাওয়া হয়নি,বরং দাদী নিজেই সেখান থেকে বাড়ি চলে এসেছিলেন একেবারে! ১ম পর্ব লিংক- https://womenexpressbd.com/shuknopata/literature/%E0%A6%85%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%9A%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%97%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%AA-%E0%A7%A7/

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)