
এক,
-চুপ থাকাটা কোন সমস্যার সমাধান না,জানো তো?
-জানি।
-তাহলে কেন চুপ করে আছো?
আমি সাথে সাথে কিছু বলতে পারলাম না। খানিক টা সময় পর বললাম,
-চুপ থাকাটা যেমন কোন সমাধান না,তেমনি কথা বলাটাও কখনো সমস্যা বাড়িয়ে দেয়,তাই চুপ করে আছি।
আমার কথা শুনে রিদু আর কিছু বলল না,খানিকক্ষন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল! তারপর বলল,
-বাসায় জানিয়েছো?
-নাহ
-জানাবে না?
-আপাতত ইচ্ছে নেই!পরে বাসায় যেয়ে সামনা-সামনি বসে বলবো। এখন মাথায় জাস্ট একটাই চিন্তা,এই জায়গাটা বদলাতে হবে,দ্রুত অন্য কোথাও শিফট হতে হবে।
-কোথায় যাবে?
আমি আবারো তাৎক্ষনিক কোন জবাব দিতে পারলাম না। কি বলবো?আসলেই তো!কোথায় যাবো আমি? মাসের আজ ১৮তারিখ,এই সময় বাড়ি ছাড়া সম্ভব না,আবার নতুন কোন এলাকায় যে যাবো সেটাও পারবো না,তাহলে কি করবো? ছোট খালার বাসায় যাবো?কিন্তু সেখানে তো বড়জোর ২দিনের বেশি থাকা যাবে না,খালু হাজারো প্রশ্ন শুরু করে দিবে! আমার চিন্তা করা দেখে রিদু বলল,
-শোন,আমার মনে হয় তোমার একবার শিমু ভাবির সাথে কথা বলা উচিত,উনাকে বুঝিয়ে বলা উচিত,আমার মনে হয় কথা বললে অনেক কিছুই সলভ হবে।
-আর যদি সলভ না হয়?যদি আবার নতুন কোন ঝামেলা শুরু হয় তখন?বাদ দাও রিদু!উনাদের যা খুশী করতে দাও,বেটার আমি আমার মতো চলে যাই এখান থেকে।
রিদু হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গিতে আমার দিকে করুন চোখে তাকিয়ে রইল। আর আমি? আমার মনে তখন রাজ্যের দুঃশ্চিন্তা আর কষ্ট এর চাইতে ক্লান্তি এসে ভর করেছে!অনেক দিনের পুরনো ক্লান্তি...
দুই,
মফস্বল শহর ছেড়ে যখন আমি পড়াশোনার জন্য এই শহরে আসি,তখন আমার মাথায় এক পড়াশুনা ছাড়া আর কোন চিন্তাই বলা যায় ছিলো না। ডায়েরীর পাতায় লুকিয়ে লেখা কিছু স্বপ্ন আর তারুণ্যের উচ্ছ্বাস ছাপিয়ে আমার কাছে শহরটাই মুখ্য ছিলো। এক ফুপি,এক খালা,দুই চাচা যে শহরে আছেন সেখানে থাকা নিয়ে আমার তেমন কোন সমস্যা হবে এটা আমরা কেউ ই ভাবিনি। তাই,এক বিকেলে ল্যাগেজ আর বই এর বোঝা নিয়ে মামার হাত ধরে সোজা চলে এসেছিলাম ফুপির বাসায়। পরের দিন থেকে ভার্সিটির ক্লাস শুরু,নতুন জায়গা,নতুন বন্ধু আর অনেক অনেক কিছু শেখার আনন্দ নিয়েই শুরু হয়েছিলো আমার শহর জীবন। ক্লাস,পড়া,টিচারের কাছ থেকে 'ভেরিগুড' শোনা,বন্ধুদের সাথে আড্ডা আর বিকেলে চা খেতে খেতে ফুপি-বোনদের সাথে গল্প করা। ব্যাস,চলে যাচ্ছিলো দিন দারুন ভাবেই।
কিন্তু মাস ছ'য়েক যাবার পর আমার মনে হলো,ফুপা আমার এখানে থাকাটা একদমই পছন্দ করেন না! যদিও আমার থাকা বাবদ,আমার স্কুল টিচার মা ফুপির কাছে প্রতিমাসেই কিছু টাকা দিয়ে যান,কিন্তু তবুও আমার মনে হচ্ছিলো,ফুপা খুব বিরক্ত আমার উপর! ফুপাতো বোন মৌ কে আসার পর থেকে আমিই পড়াতাম,কিন্তু হঠাত বলা নেই,ফুপা ওর জন্য নতুন টিচার ঠিক করলেন,সামনে মৌ এর পিএসসি পরীক্ষা,তাই ওর নাকি ভালো গাইড দরকার! ফুপি কিছু বলতে পারলেন না। তবে আমাকে শুধু বললেন,হলে সীট পাওয়া যায় কি না দেখতে! এর ক'দিন পর হলে সীটের জন্য এপ্লিকেশন করে খালার বাসায় এসে উঠলাম। কিন্তু সেই সময় হলে সীট পেলাম না,ওদিকে খালার বাসাতেও বেশিদিন থাকা সম্ভব না,খালার শ্বাশুড়ি পছন্দ করেন না। খুব্বই খারাপ অবস্থায় পরে গেলাম!না পারছি বাসায় কিছু বলতে,না পারছি কোথাও যেতে তার উপর ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষার ডেট দিয়ে দিয়েছে!
এমন সময় এক ক্লাসমেটের মাধ্যমে পরিচয় হলো সোশ্যাল সাইন্সের রিদুর সাথে। ও আর ওর কয়েক ক্লাসমেট মিলে ভার্সিটির কাছেই একটা ফ্ল্যাট নিয়ে থাকে। যদিও রিদু কে খুব একটা চিনতাম না,তবুও উপায় না দেখে আল্লাহর উপর ভরসা করে চলে আসলাম ওদের ফ্ল্যাটে। বাবা-মা প্রথমে শুনে অবাক হলেও,পরে আমি পড়াশুনায় সুবিধা হওয়ার অজুহাত দিয়ে ম্যানেজ করেছিলাম। দিন গুলো মন্দ যাচ্ছিলো না আমার। রিদুদের এখানে আসার পর ২/৩টা টিউশনী পেয়ে যাই। ক্লাস,টিউশনী,সপ্তাহে নিয়ম করে রান্না করা,অনেক রাত পর্যন্ত রুমমেটরা মিলে গল্প করা এই সব মিলিয়ে এই অচেনা শহরেও বেশ সুন্দর কেটে যাচ্ছিলো আমার দিন গুলো। দেখতে দেখতে সেকেন্ড ইয়ার পার করলাম। ইচ্ছে আছে,গ্রাজুয়েশন টা শেষ করেই,চাকরী একটা নিবো,এর মাঝে বিসিএস হয়ে গেলে তো ভালোই,চলে যাবো কোন এক অচেনা শহরে,দিন কাটাবো একদম নিজের মতো করে। কিন্তু সময় গুলো এভাবে যে বদলে যাবে বুঝিনি!
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)