বিবিধ

ঘাসফুল

ঘাসফুল
imagesCAMKVBQH এবার দেশে গিয়ে কিছু মানুষকে চিনতে পারিনি । এদের ভেতর একজন হল মাহফুজ । মাহফুজের সাথে আমাদের পরিচয় আট ন বছর আগ থেকেই , যখন সে কাগজে কাগজে নিজের নাম লিখে বেড়াতো ,  ‘মাফুজুল রমাহাম ’  । সে যে স্কুলে পড়ে সেখানে দু একটা বড়লোকের ছেলেও আসে । তার বোন যে কলেজ থেকে এবার এইচএসসি দিল সেখানেও তাই । অর্থাৎ সে আর তার বোন খুব বেশী নিম্নবিত্তের প্রতিষ্ঠানে পড়েনা । ছেলেপেলে ‘লষ্ট’ হয়ে যাবে সে কারনে বস্তিবাসী হয়েও... নিখাঁদ বস্তিবাসীদের স্কুলে মা পাঠায়নি । মাহফুজের বাবা একজন রংমিস্ত্রী । একসময় মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন । ভাগ্যের ফেরে মানুষের বাড়ি ঘর রঙ করতে করতে এখন বিছানায় পড়েছেন । মা চাকরিজীবী । আরেক চাকরিজীবী মহিলার বাসায় দু বেলা ডিউটি দিয়ে যাচ্ছে গত নয় বছর  । ঘর ঝাড়ু দেয় , থালাবাটি ধুয়ে দেয় , শাক সব্জি , গুঁড়া মাছ কিনে আনে , বেছে দেয় । এক সন্ধ্যায় ডোরবেল বাজল । দরজা খুলে দিয়ে বললাম , -আপনি কে ? কাকে চান ? -ঝুম্মি আপু , আসসালামু আলাইকুম ।আমি মাহফুজ , ভাল আছেন  ? চিনতে পারেন নাই না ? আহারে ! তিন বছর আগেও মায়ের হাতে থাপ্পড় খেয়ে বারান্দায় বসে থাকত ছেলেটা ! মা মানুষের বাসায় কাজ করে করে মাস্টার রেখেছে তবু পড়তে শুনতে চায়না । আমরা দুই বোন ওর মাকে থামাতাম ! বিজ্ঞের মত বলতাম , 'আহ ! কি করতেছেন ? মারেন ক্যান ?  মেরে ধরে কি পোলাপান পড়তে বসানো যায় ? (নিজেদের জীবন থেকে নেয়া পরামর্শ )' -মাহমুদায় তাও  ঝুম্মি -নাজমী আংটির কাছে পড়তে বহে , এই ছ্যামড়া ডারে বহাইতে পারলামই না । হ্যার মায়ের কি সামের্থ আছে মাস্টার রাইখা পড়ানের । হ্যারপরেও আমি চাইরশ টাকা দিয়া পাশের ঘরের বাবুরে ঠিক করছিলাম । হেই বাবুরে এই মাথা দিয়া আইতে দ্যাখলে হেই মাথায় দৌড় । অই ছ্যামড়া , তুই যদি রিসকাই চালাইবি তয় আমি খাটনি করি কিত্তে – মাইনষের বাড়ি চারকানীর কাম করি কিত্তে - কিত্তে ? এবার ধুম ধুম ধুম ধুম পিঠে বাড়ি । অতঃপর মা ডাইনিং রুমে উপুড় হয়ে কাঁদত , ছেলে কাঁদত বারান্দায় , মেয়ে চোখ মুছতে মুছতে নাজমী আপুর দেয়া ট্রাঞ্চুলেশন করত । সেই মাহফুজ এখন টিং টিং এ লম্বা , মাথায় টুপি , গালের দাড়ির আভাস । -তুমি অনেক বড় হয়ে গেছ মাহফুজ । কিভাবে চিনব? লজ্জার হাসি দিয়ে একটু পর বলল , -আপু , মুন্না ভাই আছে ? মুন্না ছিলনা । কম্পিউটারে কি একটা দরকার । জানালো নাজমী আপু হলেও হবে । ড্রয়িংরুমের একদম কোণার সোফায় আড়াল হয়ে বসেছে  । মুগ্ধ হলাম । বেশ সহবত শিখেছে দেখছি ।  আমি বাবুর জন্য জাউ বানাচ্ছি রান্নাঘরে , মাহফুজের মা বানাচ্ছে চা । নাজমী কি সব ঘেঁটে টেটে একটু পর বলল , -আসলেই তো ! অনেকেই তো বলতেছে যে এইটা সত্যি ! ওর মা অস্থির হয়ে পড়ল, - তুই কি এডি পিরিন্ট করবি না লেইখ্যা লবি ? কি করবি তুই ? `কিসের পিরিন্ট বুয়া ? ` এমনিতেও টিউব লাইট আমি । আর হঠাৎ পিরিন্ট বিষয়টা বুঝলাম না । `বুয়া প্রশ্নপত্র প্রিন্টের কথা বলছে , বুঝছ !`  নাজমী বুঝিয়ে দিল । -আম্মা , আম্নে উল্ডা কতা কইয়েন না তো ! আমি প্রশ্ন প্রিন্ট করতে আহিনাই । আমি আইছি ঘডনা সইত্য কিনা চেক করতে ।  আম্নের কি মাতা মুতা গেছে ? আমি প্রশ্ন দেইখ্যা লামু হ্যারপর পরীক্ষা দিমু , এই চিনছেন আমারে ! আল্লায় দ্যাখতাছেনা ! -হগলে এডি আতে পাইবো । জাইন্যা শুইন্যা পরীক্ষা দিব , তুই যদি পাশ না করছ , আব্বা ? -আল্লাহ ভরসা আম্মা , আম্নের খাটনি হারাম করতে পারুম না আমি ।  অহন ঘরে যাইতাছিগা ... রিভিশন দিমু বাকিডি । আমি অবাক হয়ে সেই রমাহাম মাফুজুলের প্রস্থান দেখছিলাম । চলে যাওয়ার পর বুয়াকে জানালাম , -আপনার ছেলে মানুষ হয়েছে বুয়া , আপনার কষ্ট সার্থক হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ ।তাকে উল্টা বুদ্ধি দিয়েন না আর , কষ্ট হলেও দিয়েন না । দেখবেন এই ছেলে অনেক দূর যাবে ! -তুমি জানো না , মাহফুজ অনেক অন্যরকম । সে জামায়াতে নামাজ পড়ে , কোরআন শুদ্ধ করে পড়তে পারে। পথে ঘাটে দেখা হলেই সালাম দেয় । -হ , মাহমুদারে ফজর অক্তে ঠেলতে থাকে , কয় ` মাহমুদারে উঠ , ঘুম হইতে নামাজ উত্তম , উঠ বইন !`` আমি পাওয়ের ব্যাদনায় একদিন শুইয়া রইছিলাম , পরে দিয়া ট্যার পাইছি পাওয়ের তলায় কেডা আত দিছে । চউখ টিপ টিপাইয়া দেহি মাফুজুল ... গিলিসেরিন মাইখ্যা দিতাছে পাওয়ের তলায় ... ............... জেএসসির রেজাল্টের সময় দেশেই ছিলাম । আমাদের মাহফুজ পাশ দিয়েছে তাই তার মা পাটিসাপটা পিঠা বানিয়ে আমাদের মিষ্টিমুখ করালো । মাহফুজ একটু পর নিজে এসে জানালো ৪.১৯ পেয়ে পাশ করেছে । সন্ধ্যা হয়েছে অনেক্ষন । ডাইনিং রুমের আলোটা নেভানো । বুয়া এখনো বাসায় যায়নি । এক কোণায় সিজদায় উপুড় হয়ে পড়ে আছে । তার যাবতীয় কান্নাকাটির জন্য এই স্থানকেই কেন সে  বারবার বেছে নেয় , কে জানে ? এই মায়ের খাটনি , এই মায়ের প্রতিটি রক্ত বিন্দু সেদিন খাঁটি প্রমাণ করে দিয়েছিল তার ছেলেটি । অথচ এদের কথা রাঘব বোয়াল কে চিন্তা করছে ? বস্তির স্কুলগুলোর ছিরিছাঁদের কথাই বা কোন ক্ষমতাবানের মাথায় ? সেগুলোকে ঢেলে সাজানোর কথা না ভেবে কর্তৃপক্ষরা নব্বইভাগের দিকে মন লাগিয়েছেন । আকাশে বাতাশে প্রশ্ন ছিটিয়ে শিক্ষার মান বাড়াচ্ছেন । এই ছেলেটির মা বাড়তি টাকা গুনে একটু ভাল স্কুলে দিয়েছিল ছেলে মেয়েদের । তাদের বাবা মায়ের প্রফেশন জেনে সহপাঠীরা নাক সিঁটকাবেনা , জাতিগত ভাবে এখনো এতটা উদারতা আমাদের আসেনা । এইসব উঁচু নীচু বিভেদ বিভক্তি সহ্য করে তারা মায়ের কষ্টটাকে উপলব্ধি করতে শিখেছে । ‘ আল্লাহ সব দেখছেন’ এই অমোঘ সত্যের মর্ম বুঝতেও শিখেছে । এই দুর্দিনে আবার তোমায় মন থেকে দোয়া করি মাফুজুল ! আল্লাহ তোমাকে জীবনেও ত্রিশ শতাংশ থেকে যে করেই হোক নব্বই শতাংশে ওঠানোর ক্যালকুলেশন করার মানসিকতা না দিন । শুদ্ধ হয়ে বড় হয়ে ওঠ ! জানি তোমার ভাত নাই , তবু এ জাতির সুস্থতা ফিরিয়ে আনার জন্য শুদ্ধ মানুষ হওয়া ছাড়া বিকল্প কিছু ভাবা যাবেনা ।

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
সম্পর্কিত ব্লগ