উইমেন (সামাজিক,মানসিক,সুবিধা বঞ্চিত নারী)

সতীত্ব- একটি বিমূর্ত ধারণা

সতীত্ব- একটি বিমূর্ত ধারণা
মানব সভ্যতার ইতিহাস যতদিনের, নারীর সাথে আচরণের রুপটিও ঠিক ততটাই প্রাচীন। বস্তুগত সভ্যতার এই চরম উৎকর্ষের সময়েও ভিন্ন গঠনবৈশিষ্ট্যের হওয়ার কারণে নারীর প্রতি আচরণও ভিন্নরকম।   সতীত্বের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে উইকিপিডিয়া নিজেই আবার হার মেনেছে। ‘সতীত্ব’ এমন একটি ধারণা, যার অর্থ হল, কোন ‘মানুষের’ এমন একটি অবস্থা যে সে এখনও যৌন সংসর্গে লিপ্ত হয়নি। সংজ্ঞা দেয়ার পরই প্রচলিত ধারণা দিতে বলা হয়েছে, এটি হল বিবাহপূর্ব পবিত্রতা, সম্মান ও মর্যাদার একটি স্মারক, তবে যা শুধু নারীর জন্য। লক্ষ্য করুন, শুধুই নারীর জন্য। যদিও, এখন সমলিঙ্গ বিবাহ, বা অন্য কিছু প্র্যকটিসের কারণে সতীত্বের এ ধারণা ধোপে টিকছে না আর!   সংজ্ঞা দেয়া হয় কিছু নিয়ে ধারণা পরিষ্কার করার জন্য। এই সংজ্ঞা আরও ধাঁধায় ফেলে দেওয়ার মত। যে কাজটিতে নারী পুরুষ উভয়ের ভূমিকাই সমান, বরং পুরুষের ভূমিকা অগ্রগামী সেখানে সে কাজ-পরবর্তী সামাজিক কলঙ্কের চিহ্ন কেন শুধু মেয়েদের গায়েই লাগবে? কেন মেয়েরাই জীবনের এক পর্যায়ে ‘কুমারী’ থাকবে এবং একসময় কৌমার্য্য বিসর্জনের মাধ্যমে তার বিশ্বস্ততার প্রমাণ দেবে?   ধর্ম কি বলে? ধর্মের প্রসঙ্গে আসলাম বাধ্য হয়েই, কারণ, মানুষ তার আচরণকে ধর্ম থেকেই নেয়, সচেতন বা অবচেতনভাবে। এবং পরে, সেই আচরণকে দিয়ে ধর্মকে সংগায়িত করতে চায়। যাক, শরণাপন্ন হলাম উইকিপিডিয়ার।   বৌদ্ধ ধর্মে ভার্জিনিটি নিয়ে কিছু বলা হয়নি, তবু যারা ধর্মের একান্ত সেবক, তাদের ভার্জিনিটিকে চিররস্থায়ী করে দেয়া হয়েছে, এ নিয়মের ক্ষেত্রে অবশ্য এ ধর্মে নারী পুরুষের পার্থক্য নাই।   খ্রিষ্টানরা আবার এই বাবদে একটু রক্ষণশীল, ‘একটু’ শব্দটা মনে রাখেন। এর একটা অর্থ আছে। বিবাহবহির্ভূত সতীত্ব রক্ষাকে সম্মানের চোখে দেখা হয়েছে, কিন্তু এর সাথে জুড়ে দেয়া হয়েহেঃ ‘প্রতিটা মানুষের শরীর স্রষ্টার সম্পদ! শরীরই মন্দির’! আর ভার্জিন মেরীকে কলঙ্ক মোচনের জন্য এক এক মনীষী যীশূর পিতা হিসেবে এক একজনকে প্রস্তাব করেছেন, এমনকি ‘সন্দেহ’ও (!) করেছেন। এখানে একটা জিনিস পেলাম, আগে জানতাম না। কোন পুরুষ জোর করে কোন মেয়ের সতীত্ব হরণ করলে তাকে ওই মেয়েকে বিয়ে করতে হবে এবং যথাযথ পণ পরিশোধ করতে হবে। এই পণের পরিমাণ , মেয়েটি সতী কিনা তার ওপর নির্ভর করে।   প্রাচীন গ্রীসে, নারীদের যেখানে পূর্ণাঙ্গ মানুষই মনে করা হত না, সতীত্ব হারানোর অপরাধে অভিযুক্ত মেয়েটিকে জ্যন্ত কবর দেয়ার বিধান ছিলো।   হিন্দু ধর্মের ব্যপারটা বেশ অদ্ভুত; প্রাচীন ভারতে সতীত্ব কেন্দ্রীক সামাজিক বিধিনিষেধ ছিলো না। পরে একে বিয়ের কণের জন্য অবশ্য লক্ষ্যণীয় শর্ত হিসেবে দেখা হয়েছে। তার মানে হল, বিবাহপূর্ব (বিবাহবহির্ভূত নয়) সতীত্ব রাখতেই হবে।   আমার খুব জানতে ইচ্ছা করছিলো, যে মেয়েটা, পরিস্থিতির শিকার হয়ে ‘সতীত্ব’ নামক সামাজিক বস্তুটিকে খুইয়ে বসে,  আনন্দ লাভের কোন উদ্দেশ্য থেকেই নয়, তাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য সমাজ বা ধর্ম কোন ছায়া তৈরী করেছে কি না! যে ছায়ার আড়ালে থাকলে সে ‘পবিত্র’ই থেকে যাবে, তার উদ্দেশ্যের সততা তাকে তার সম্মানের আসন থেকে বিচ্যূত করবে না!   একদম থিওরিটিক্যাল দৃষ্টি থেকে দেখলে অবাক হতে হয়। বৌদ্ধ বা খৃষ্টান সমাজে এই রকম মেয়েদের স্থান নেই। হিন্দু ধর্মে মনে হয় যেন কী একটা ফাঁক আছে, কিন্তু সেটা এতো সংকীর্ণ, যে তার মধ্য দিয়ে যাওয়া স্বয়ং সীতার পক্ষেই সম্ভব হয়নি। আজকের এই সমাজে কোন মেয়েকে যদি সতীত্ব প্রমাণের জন্য ‘অগ্নিপরীক্ষা’র সম্মুখীন হতে বলা হয়, সম্ভবত সে এই সমাজের মুখেই পদাঘাত করে বলবে, “থাকলাম আমার অসতীপনা নিয়ে আমি, যাও!’’ এখানে অবশ্য আরও বড় হেঁয়ালী আছে একটা। সীতাকে প্রমাণ দিতে হয়েছিলো, তিনি সতী ছিলেন। কিন্তু এমন যদি হোত, রাবণ রাজা তাঁর সম্মান নষ্ট করেছে, কিন্তু তাঁর অমতে? তাহলে? রাম কি করতেন? হাহ! তাহলে মনে হয় সমাজ সীতাকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে দেয়ার সম্মানটাও দিতো না।   ইসলামে এই রীতিগুলোর পরোক্ষ সমাধান আছে। কিন্তু এর অনুসারীরা সেসব ঘেঁটে দেখার কষ্টখানা করে কি না আমার জানা নাই। কারণ সমাজে সেসবের প্রয়োগ নেই, এর চরম অন্যায়ের মুখেও এর প্রতিবাদ নেই।   উদাহরণ দিই; দেখেন। ১। মনে করেন, একটি মেয়ে, বিয়ের পর কোন কারণে স্বামীর ঘর থেকে ফেরত এসেছে। সমাজ শতমুখে বলতেই পারে, আহা, বেচারী! কিন্তু কোন পুরুষ কি স্বেচ্ছায়, বিনা চাপে এই মেয়েটিকে স্ত্রী হিসেবে নেবেন? মেয়েটি, হোক সে ষোড়শী, তার জন্য বীভৎস অসুন্দর সব প্রস্তাব আসতে থাকে। এ ব্যপারে আমরা আবার ‘মধু খাওয়া মূসলমান’, অর্থাৎ কি না ‘কুমারী মেয়ে বিয়ে করা আল্লাহর রাসুলের(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সুন্নাহ’!! নামাজের সুন্নাহ ছেড়ে দিচ্ছি প্রতিদিন ১৬ রাকায়াত, তাতে কি? রাসুলের সুন্নাহ বলে কথা!!   ২। আবার মনে করেন, খুব সাবধানে পড়বেন, আমার লেখার চাপে আপনার ঠুনকো মুসলমানিত্ব ভেঙ্গে যায় না যেন! একটি মেয়ে, জোর করে তার অসম্মান করেছে কেউ, জীবনের চরমতম অপমানের সাক্ষী মেয়েটার মন। অবিবাহিতা, কিন্তু উইকিপিডিয়ার সংজ্ঞায় সে ‘কুমারী’ নয়, পারবেন সে মেয়েটিকে আপনার ছেলের বউ বা আপনার ভাইয়ের বউয়ের মর্যাদা দিতে? পারবেন, দীর্ঘ বৈবাহিক জীবনে তাকে কোন খোঁটা না দিয়ে আর দশটা মেয়ের মত আচরণ করতে? অনেক আগে একটা ভারতীয় বাংলা সিনেমা দেখেছিলাম। হানিমুনে গিয়ে নির্জন সৈকতে স্ত্রীটিকে প্রচন্ড অসম্মান করে কিছু বখাটে, স্বামী বেচারা তার পিতার অমতে মেয়েটিকে নিয়ে আলাদা হয়ে যান, কারণ পিতা বউকে অপবিত্র বলে ছেড়ে দিতে বলেছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পর মেয়েটি সন্তানসম্ভবা হলে মাতাল পুরুষটি স্বরুপে আবির্ভূত হন, মেয়েটি সংসার ছেড়ে চলে যায়। বহুদিন পর, মেয়েটি তার ‘রাতের বিল’ চাইতে আসে তার পরিত্যক্ত স্বামীর কাছে, কারণ সে তদ্দিনে খারাপ হয়ে গিয়েছে। অথচ, যে অন্যায়ের দায় পুরুষেরও, তার গায়ের দাগটি সমাজ সযত্নে মুছে দিলেও, মেয়েটির দাগটি তখন স্কুলে যায়, অবিকল পিতার চেহারা তার।   কি জবাব দিবেন আপনি? আপনার সমাজের ধর্মীয় মুরুব্বীরা ‘অবক্ষয়, অবক্ষয়’ বলে হাত ধুয়ে ফেলেছেন, কিন্তু এ অবক্ষয়ের অসহায় শিকারটির কোন স্থান কিন্তু তাঁর ঘরে নেই।   আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মত লম্বা জামা পরে চোখে সুরমা দেয়া মুরুব্বী, একটু জানাবেন কি? আপনার রাসুল যখন একাধিক বিধবাকে বিয়ে করেন যাঁর আগে দুইবার বিয়ে হয়েছে, এমন কোন মহিলার জানাযা পড়ান, যে ব্যভিচারীণী ছিলো এবং স্বেচ্ছায় দোষ স্বীকারের কারণে যাকে রজমের শাস্তি দেয়ায় তাঁর মৃত্যূ হয়, তখন কি সুন্নতের বাধ্যবাধকতা আপনাকে আর কিছু শেখায় না? নাকি সৎ কাজের আদেশ আর অসৎ কাজের নিষেধের বেড়াজালে আপনি আয়নায় দাঁড়াতে ভুলে গেছেন? সমাজ আপনার কাছে বড় হয়ে গেছে সুন্নাহর চেয়ে? তাহলে মনে রাখবেন, ইসলাম যে ইনসাফভিত্তিক সমাজের কথা বলে, সেটা আপনার হাত দিয়ে আসবে না, শায়খ! সরে দাঁড়ান পথ ছেড়ে। শূণ্যতা তৈরী হোক, আর কেউ উঠে আসুক। ‘আমার বেণী তেমনি র’বে, চুল ভেজাবো না’র দলে ভিড়ে থাকা জ্ঞানপাপীদের দিয়ে সমাজের পরিবর্তন আসেনি কোনদিন, আসবেও না!

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
সম্পর্কিত ব্লগ