বিবিধ

পথ চলতে আনমনে (প্রথম পর্ব )

পথ চলতে আনমনে (প্রথম পর্ব )
খুব হুট হাটের ডিসিশন সব সময় খারাপ না । কাকভোর থেকে রাত নিশুতি পর্যন্ত দৌঁড়ানোর ফাঁকে এক বিকেলে উনি গলা বাড়িয়ে বললেন , পলিরা  (সিস্টার ইন ল)  যাচ্ছে , যাবা ?   ´´ আমি ঝর্না হয়ে গলে যেতাম অমনি পরম সুখে ... ´´লাইনগুলো  ছোটবেলায় বিভিন্ন কম্পিটিশনে অসংখ্যবার  না বুঝে গেয়েছি ।  একটু বড় হয়ে মানুষের অন্তরে এত তৃষ্ণা কেন জমে- কিভাবে জমে বুঝতে চাইতাম , অনুভব করতে চাইতাম । । এক সেকেন্ডের জন্যেও জায়গাটি যেহেতু থেমে থাকে না , তাই  মনের ভেতর বিস্ময়ও ছিল খুব । আমি বললাম , - পাত্তি আছে ? যদি থাকে , তাহলে না যাওয়ার কোন কারণ তো নাই ই বরং ভুল । - অ্যা ...ইয়ে...  সেটা হবে কাচায় কুচায় , কিন্তু আহমাদকে নিয়ে বেশী কষ্ট হয়ে যাবে না ? -শোন , কষ্ট হবেনা আমি এরকম কথা বলব না । আমরা কেউই সুপার হিউম্যান বিইং নই । কিন্তু  নিজেদের স্বার্থে সেই কষ্টকে জয় ব্লা ব্লা ব্লা (একটি মানুষ গেছে চাঁদে টাইপের মোটিভেশনাল লেকচার দিয়ে ফেললাম । ) মোটিভেশনের চোটে তক্ষন ল্যাপটপ খুলে পাত্তির হিসাব , টিকেট দেখাদেখি শুরু হল । ফাঁকে ফাঁকে আমেরিকায়( সিস্টার ইন ল এর বাসা) ফোন । আমি পাসপোর্ট জমা দেয়ার আগেই তল্পিতল্পা নিয়ে ভাবতে বসলাম । কি আছে কি লাগবে এইসব মেয়েলীপনা । এই এপ্রিলের বার তারিখ ওনারা ফ্লাই করবেন । আমাদের টার্গেটও বার তারিখ । আমরা যেহেতু কোন গ্রুপের সাথে  যাচ্ছি না এবং ওখানকার ভাব ধারা কিছুই চিনি টিনি না তাই ওনাদের ধরাটাই স্বাস্থ্যকর  । মার্চের প্রায় শেষ । বার তারিখ টার্গেট তাই খুব অল্প দিনের ভেতর কাগজ পত্র নিয়ে  দৌড়ঝাঁপ থেকে শুরু করে ভ্যাক্সিন , কেনাকাটা একযোগে করে ফেলছি। আর সাথে গ্যদা বাচ্চা  যাবে যেহেতু তাই প্রিপারেশন খুব খিয়াল করে কিন্তু ঢিপিয়ে না -এভাবে নিচ্ছি । দশই এপ্রিল সকালে দেখা গেল ভিসা এখনো আসেনি । আমার পাসপোর্ট বাংলাদেশি হওয়াতে ঝামেলা এবং বিলম্ব দুই ই হচ্ছে ।  মনের ভেতর দুইটি ভাবনা উঁকি দিল । এক ,নিয়ত করেছি , কবুলের মালিক আল্লাহপাক । পাপী তাপী মানুষ আমি , ভিসা নিয়ে একটু ঘুরিয়ে ঘারিয়ে হয়ত পরীক্ষা করতে চাচ্ছেন । দুই , পাসপোর্ট বাংলাদেশী হওয়াতে বহু আগে থেকেই এয়ারপোর্টে কতিপয় ই ইউ পাসপোর্টধারীদের সুপারিওরিটি কমপ্লেক্সে ভোগা সহ্য করছি কিন্তু মাই ব্যাড , এক ফোঁটা ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স তৈরি হয়নি । বরং ভেতর থেকে জার্মান নাগরিক হিসেবে ওথ নেয়ার তেমন কোন তাড়াহুড়াও অনুভব করিনা । এই  বিলম্ব - এই লাইনের একদম পেছনে দাঁড়ানোর রীতি নীতি সবুজ পাসপোর্ট হাতে নিয়েই ভাঙ্গার কল্পনা করি কিন্তু  প্লেনের ল্যাভেটরীতে বিড়ি টেনে ধরা খাওয়া , মাগনা মদ পেয়ে প্লেনের ভেতর মাতলামীর চূড়ান্ত করা দেশী ভাইগুলো কিংবা  গুয়াংজু এশিয়ান গেমস ভিলেজ থেকে আরেক দেশী ভাইয়ের ইলেকট্রিক মশার কয়েল চুরি , রিসেন্ট খাঁটি সোনার ষোল আনাই মিছে  দৃশ্যপটে এসে ঝামেলা বাঁধায় । বিকেলবেলা পাসপোর্ট ফেরত পেলাম । আল্লাহ চাইলে পরশু দুপুরে ফ্লাইট । -ইজিপ্টের ভিসার জন্য তিন সপ্তাহ লাগবে । মেজাজ গরম লাগতেছে । এদিকে হোটেলও বুকিং দিয়ে ফেলছি । -কি আর করবা । বাদ দাও । আসল জায়গার ভিসা আসছে আলহামদুলিল্লাহ । এখন এই সাতাশ ঘণ্টা এয়ারপোর্টের ভেতর  হোটেল খুঁজে না পেলে মসজিদে কাটায় দিতে হবে । আমার ষোল ঘণ্টার রেকর্ড আছে । এবার ব্রেক হবে। -তুমি তখন একদম একা ছিলা জুম্মি ! আহমাদের অস্বস্তি কান্নাকাটির কথা চিন্তা করতেই হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসল । তাও বললাম , - তুমি সাথে থাকলে পাওয়ার তো আরও বাড়ার কথা , বল , কথা না ? আমার এনালাইসিস হল আমরা প্রথমেই এয়ারপোর্টের ভেতরে হোটেল খোঁজার ট্রাই দিব । খুঁজে না পেলে  কায়রো (আহ কায়রো ) এয়ারপোর্টে অবশ্যই মসজিদ আছে । আমি জানি , কয়েক ঘণ্টা পর অনেক বিরক্ত লাগবে , মাথা  ভন ভন ভন ভন করবে  কিন্তু পারা যাবে ইনশাল্লাহ , সাতাশ ঘণ্টাই তো ... তুমি চিন্তা কর আদনান, আমার পূর্বপুরুষ- তোমার পূর্ব পুরুষ মাসের পর মাস ধরে পায়ে হেঁটে ... ( এনাদার মোটিভেশনাল লেকচার ) -আমাদের কিন্তু সাতটার ভেতর বের হতে হবে , নো ওয়ে । -দুপুরে ফ্লাইট তুমি সাতটায় বের হতে বলতেছ ক্যান? -ফ্লাইট তো বার্লিন থেকে । হামবুর্গে তো ইজিপ্ট এয়ার নাই ।  হাউপট বানহফ ( সেন্ট্রাল স্টেশন) থেকে বাস নিতে হবে । হইছে কাম !  এনাদার ফাইভ আওয়ারস । আল্লাহর কাছে আর্জি , ইয়াল্লাহ , তুমি আমাদের শরীর এবং মনের জোর উভয়ই আনুপাতিক হারে বাড়িয়ে দাও । আমার মেজাজ মর্জি ঠিক রাখ । আমার শিশুরটাও বিশেষভাবে । আর স্ট্রলারের চাকাতে কোনরূপ ডিস্টার্ব দিওনা । শুক্রবার সারাদিন গেল ঘর গুছাতে । আমি সাধারণত কোথাও যাওয়ার আগে বেশ সময় নিয়ে ঘর গুছাই ।  ফ্রিজ ধুই । ফিরে এসে  বিছানায় সটান করে শুয়ে পড়ার লোভে মেহমান আসার আগে বাসা যেমন থাকে তেমন করে রাখতে ইচ্ছুক থাকি । ও বারবার বলছিল লাগেজের জিনিসপত্রের দিকে অধিক মনোযোগী হতে। কোথাও ভুল চুক আছে কিনা চেক করে নিতে । পাত্তা  দেইনাই । পরে হামবুর্গ থেকে দেড়শ কিলোমিটার দূরে যাওয়ার পর  খেয়াল হল পাত্তা না দেয়াটা ঠিক হয়নি । আহমাদের সানগ্লাস মিস্টেক হয়ে গেছে । ছেলেটার ভবিষ্যৎ দশটি দিন ইনশাল্লাহ একটি বেশীই রৌদ্রউজ্জ্বল থাকার কথা । বার্লিন নেমেই সানগ্লাস কেনা যাবে কিনা চিন্তা করতে চাচ্ছি , কন্সানট্রেশন আসছেনা ।  আহমাদ সিট থেকে নেমে হাঁটতে চাচ্ছে । চলন্ত বাসে মোট পাঁচটি দাঁতের বাচ্চারা হাঁটলে যে পড়ে যায় এটা এখন তাকে কে বোঝাবে ? ( চলবে )

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
সম্পর্কিত ব্লগ