সাহিত্য

মেয়ে পক্ষ!

মেয়ে পক্ষ!
531142_441630559205339_121838385_n ''প্রত্যেকেরই উচিত নিজের সীমার মধ্যে থাকা,সীমা অতিক্রম করলে ঝামেলা হবেই...'' কথাটা শুনে আমি বাইরে থাকা আমার দৃষ্টিটা ঘুরিয়ে যে এই কথা বলল তার দিকে তাকালাম,কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে নিচে দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। মাঝে মাঝে মানুষ এমন সব কথা বলে যা সে কখনো ঠিক  না,কখনোই আসলে মানে না...এই মাত্র যিনি এই কথাটি বললেন তিনি তেমনি একজন। হৈ চৈ কিছুটা কমেছে মনে হল,এমন সময় রেহানা আন্টি আমাকে বললেন,'কাজি সাহেব আসছেন,তোমরা ঠিক-ঠাক হয়ে বসো।' আমরা দ্রুত সব ঠিক করে দিয়ে এক পাশে সরে আসলাম। একটু দূরে একটা চেয়ারে বসতে যাবো,ওমনি ভাবি ডাক দিলেন,ইশারায় বুঝালেন আমি যেনো তনুর পাশে বসি,আমি আবারো এসে তনুর পাশে বসলাম। হঠাৎ তনু শক্ত করে আমার হাতটা ধরল,আমি ওর দিকে তাকালাম,চোখে অশ্রু টলমল করছে,আর আমার হাতে রাখা ওর হাতটা কাঁপছে। আমি আবারো একটা নিঃশ্বাস ফেলে ওর হাতের উপর চাপ দিলাম,মুখে হাসিও ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলাম,তবে ফুটেছিল কি না জানিনা! খানিক বাদে ওর কানে কানে বললাম,''দোস্ত,একদম পারফেক্ট,এর বেশি পানি চোখে আনার চেষ্টা করিস না,তাহলে কাজল ছড়িয়ে যাবে!,এখনো কিন্তু মুনির ভাইয়ের সাথে ছবি তোলা বাকী আছে!ওকে?''তনু আমার দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলো,কিন্তু ওর ও আমার মতোই হাসি ফুটে উঠলো না। আজ তনুর বিয়ে,আমার অনেক দিনের পুরনো বান্ধবী। অনেক বছর আমরা একই এলাকায় ছিলাম,আব্বু আর আঙ্কেল একই ব্যাঙ্কে চাকরী করেন,পরিচয়টা এই সুবাদেই। আঙ্কেল ঢাকার বাইরে বদলী হয়ে যাবার পর তনুরাও চলে যায়,প্রায় আট বছর পর আবারো ঢাকায় ফিরে আসে ওরা। বিয়ের কথা অনেক দিন ধরে চললেও ঠিক হলো খুব অল্প সময়ের মধ্যেই,অনেক তাড়াহুড়ার ভেতর আয়োজন করতে হচ্ছিল আমাদের কে,বলতে গেলে প্ল্যান ছাড়া প্রোগ্রাম! গায়ে হলুদের আগের দিন ফুলের ওর্ডার দিয়ে শাহাবাগ থেকে আসার সময় আমি তনুকে ক্ষেপানোর জন্য বলেছিলাম,''শোন,তুই কিন্তু বিয়ের দিন একদমই মন খারাপ করবিনা,জোরে কথা বলবি না,আস্তে আস্তে হাসি মুখে সবার সাথে কথা বলবি!লজ্জাবতি বউ টাইপ! আর কাজি যখন আসবে তখন জাস্ট চোখে পানি টলমল করবে,বাট বাইর হবে না,ওকে?তবে প্লিজ যাওয়ার সময় হাউমাউ করে কাঁদবি কিন্তু,নাহলে খবর আছে...!'আমার কথা শুনে তনু বিরস মুখে বলেছিল,''তুই ই কাঁদিস হাউমাউ করে!আচ্ছা দোস্ত,আমার কি সত্যিই বিয়ে হচ্ছে??আমার মাথা তো পুরাই ফাঁকা লাগতেছে!!তুই কি বলছিস,কিছুই মাথায় নাই...!আমার মনে হচ্ছে,আমি শূণ্যে ভাসতেছি আর চোখে অন্ধকার দেখতেছি!!!'' আমি ওর কথা শুনে 'ধুর' বলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলাম! আমি খুব অনুষ্ঠান প্রিয় মানুষ হলেও আজকাল বিয়ের অনুষ্ঠানে যেতে আমার খুব্বই কষ্ট লাগে...!!অনেকটা না গেলেই নয় হলে যাই,আর না হলে পালাই! তবে কাছের জনদের বিয়ে হলে তো আর না যেয়ে পারা যায় না,কোন না কোন দরকারে আমাকে তাদের লাগবেই,সো আমি পালিয়ে থাকলেও লাভ নাই,যেমন তনুর বিয়ে থেকে পালাতে পারিনাই! কাজ করতে সময় আমার নানুর কথা খুব মনে পড়ছিল!আমার অবস্থা নানুর ভাষায়,[si]''তুই গাছের উপরে উঠ আর মাটির নিচে ঢুক,তোরে যদি পাইছি তাইলে তোরে খাইছি!!''[/si] আহ!ছেলে হলে কতো ভালো হতো,কোন বন্ধুর বাসায় যাওয়ার নাম করে বাসায় নাক ডেকে এখন ঘুমাতে পারতাম! পার্লার থেকে তনুকে নিয়ে এসে ওকে স্টেজে বসিয়ে একটু দূরে চেয়ারে বসে হাই তুলতে তুলতে এসব কথাই ভাবছিলাম! এমন সময় তনুর কাজিন সুরাইয়া আপু  আমার পাশে বসে বলল, ---আচ্ছা,ও বাসা থেকে কালকে যে ল্যাগেজ পাঠানো হয়েছে তুমি জিনিস গুলো দেখছিলা না? --হুম,কি হইছে? --কয়টা শাড়ি ছিল সেখানে? আমি উঠে নিজের শাড়ি ঠিক করতে করতে বললাম, --সব কিছু তো পাঠায় নাই,শুধু বিয়ের শাড়ি,জুতা,আর কিছু টুকটাক জিনিস। --জুতার গায়ে কি প্রাইজ ট্যাগ লাগানো ছিল? --হুম,১০৭৫টাকা দাম,কেন কি হইছে আপু? --কিছু হয় নাই,তবে কথা হচ্ছে ওপাশে কিছু,তাই জিজ্ঞেস করলাম! বলে উনি উঠে চলে গেলেন,আমার কপালে কিছুটা ভাঁজ পড়ল!ঘটনা কি?ওপাশে কে কথা বলছে এসব নিয়ে! তনুদের পরিবারকে আমি জানি,তারা ওমন মানুষিকতার না,এখন পর্যন্ত বিয়ের আলোচনায় তারা একবারো কেউ কিছু নিয়ে উচ্চবাচ্চ করেননি,না মোহরানা নিয়ে,না গয়না-পোষাক নিয়ে,তনুর বাবা এক কথায় বলে দিয়েছেন,''ছেলে তার সামর্থ্য অনুযায়ী যা যেভাবে দিয়ে দিবে আমাদের তা নিয়ে কোন আপত্তি নেই। আমরা তো বেঁচা-কেনা করতে বসিনি,আমাদের ছেলে-মেয়ে সুখে থাকুক এটাই আসল কথা।'' তাহলে এখন কথা বলছে কে?! যদিও ঐ বাসার পাঠানো জিনিস পত্র দেখে আমার যথেষ্ট খটকা লেগেছে...!গিফট থেকে শুরু করে বেশির ভাগ জিনিসের সাথেই প্রাইজ ট্যাগ লাগানো ছিল!যেটা খুবই দৃষ্টিকটু!আমি অবাক হয়েই গিফট নিয়ে আসা মুনির ভাইয়ের ভাবিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, --ভাবি,এগুলো র‍্যাপিং কে করেছে? --কেন আমরাই! --না মানে,ট্যাগ লাগানো যে তাই ভাবলাম,বাইরে থেকে করে এনেছেন কি না! ভাবি আর কিছু বললেন না! আমি মনে মনে সুধাইলাম,''পাতিলের ভাত একখান ধরলেই বুঝা যায়,পাতিলের ভেতরের কি অবস্থা!'' ভাবির সাথে উনাদের এক চাচী না কে যেনো এসেছিলেন,তিনি বারবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে জানতে চাইছিলেন,মেয়ের সাথে আন্টি কি কি দিচ্ছেন! আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন ছেলে পক্ষের পাঠানো জিনিস গুলো নিয়ে আমাদের কোন অভিযোগ আছে কি না,কোনটার দাম-কম বেশি কি না ইত্যাদি। আন্টি সব বুঝেও না বুঝার ভান ধরেছিলেন,আমি তা ঠিকই দেখছিলাম। আসলে মানুষের মানুষিকতার মিল খুঁজে পাওয়া খুবই দুষ্কর!এক পক্ষ ভাবছে এসব দেখানো জিনিসে কি আসে যায় তো আরেক পক্ষ ভাবছে এসব কিছুতেই সম্পর্ক মাপতে হয়! এক পক্ষ ভাবছে,বিয়ে হলো দু'পরিবারের মধ্যে আত্নার সম্পর্কের মাধ্যম তো আরেক পক্ষ ভাবছে বিয়ে হলো পন্য বিনিময়ের মাধ্যম! কেউ ভাবছে,দু'জন মানুষের সুখের কথা তো কেউ ভাবছে সমাজের মানুষদের সু'মন্তব্যের কথা! রীতিনীতি মেনে চলা এক ব্যাপার আর নীতির আধিখ্যেতা দেখানো আরেক ব্যাপার,কেউ একেবারে নীতির বিরুদ্ধে তো কেউ নীতির উর্ধে!কি এক ব্যালেন্সহীন অবস্থা! বিয়ে ব্যাপারটাই এখন হযবরল হয়ে গেছে যেনো!! যার যেভাবে মনে চাইছে করছে,ভাবছে...! --কিরে?তোর ক্ষুধা লাগেনা? রাখির কথা শুনে চমকে ওর দিকে তাকালাম! --ক্ষুধা কি জিনিস দোস্ত?জীবনে দেখিনাই!আর তোর এখন ক্ষুধা লাগে কেন?বিয়ে হয়েনিক তারপর খাওয়া,তার আগে না... কথা শেষ করতে পারলাম না,খুব হৈচৈ শুনতে পেলাম ছেলেদের হল থেকে!! বেশ উচ্চস্বরেই কথা হচ্ছে!আমি উৎকন্ঠা নিয়ে একবার তনুর দিকে তাকালাম!দ্রুত পায়ে ওদিকে গেলাম,বেশ গরম অবস্থা। যেয়ে দেখলাম ছেলের মামা আর তনুর খালুর মধ্যে চরম তর্কাতর্কি হচ্ছে! তনুর খালু বলছে, --আপনি ছেলে পক্ষ হয়েছেন বলে সীমা ছাড়িয়ে কথা বলতে পারেন না,আমরা চুপ করে আছি তার মানে এই না,যে আপনি যা খুশী বলবেন... --আরে থামেন সাহেব,মেয়ে বিয়ে দেবার যোগ্যতা নাই আপনাদের!থাকলে ছেলের মামার সাথে এভাবে চোখ গরম করে কথা বলতে আসতেন না! আমাদের ছেলে ভেসে আসেনি... --তো আপনি কি বলতে চান আমাদের মেয়ে ভেসে আসছে?!আপনি সেই তখন থেকে খোঁচা মেরে কথা বলেই যাচ্ছেন!আপনাদের যদি বিয়েতে কোন দাবী থেকে থাকে তাহলে আগে কেন বলেননি,এখন সবার সামনে বারবার ছেলেকে কিছুই দেয়া হয়নি বলে কেন কথা শুনাচ্ছেন?এটা কোন ধরনের ভদ্রতা?কেমন মুরুব্বি আপনি?যে ভাতিজার বিয়েতে এসে সিনক্রিয়েট করেন... --আপনাদের কাছে কোন দাবী করা হয়নি বলে যে আপনারা কিছুই দিবেন না এটা কেমন ভদ্রতা?আমাদেরকে নিয়ম শেখান?আমরাও ছেলে-মেয়ে বিয়ে করিয়েছি,সমাজে আমরাও বাস করি,আপনাদের মতো অসামাজিক মানুষ না!! আমি নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যেন!!আশে-পাশে সবাই হতভম্ব হয়ে বসে আছে!!হল ভর্তি মানুষজন একে অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে,একটু দূরে স্টেজে বসে থাকা মুনির ভাইও অবাক হয়ে আছেন। এমন একটা অবস্থা কি করে হলো!তনুর বাবা কিংবা মুনির ভাইয়ের বড় ভাই কেউ কি খেয়াল করেনি?! আমি খেয়াল করলাম,ততোক্ষনে ভেতরে মহিলাদের মধ্যেও গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে, কেউ বলছে,'ঠিকই তো,মেয়ের বাবা-মায়ের কেমন আক্কলে!কিছু দেয়া-নেয়া ছাড়াই মেয়ে বিয়ে দিচ্ছে!' কেউ বলছে,'কেমন শিক্ষিত পরিবার এরা?বিয়ের আসরে দেয়া-নেয়া নিয়ে তর্ক করে,আর নিজেরা কি এমন দিয়ে নিচ্ছে মেয়েকে শুনি!হুহ'' তনুর এক মামী বলছেন,''সোজা কথায় বললেই পারে এরা যৌতুক চায়!কি এমন হীরা-জহরত দিয়ে ছেলে বিয়ে করাচ্ছে শুনি?দেখতে তো ভালো পরিবারই মনে হয়েছিল'' ও দিকে ছেলের এক ফুফু বলছেন,''এতো গয়না,দামী জিনিস দিয়ে বউ নিচ্ছে অথচ ছেলেকে কিছুই দেয়ার কথা ভাবল না মেয়ে পক্ষ!!এমন গাধা কেন এরা?!'' কথায় কথা বেড়েই চলছে!কি এক অবস্থা!!  সামান্য কিছু বিষয় নিয়ে বিয়ের আসরে মুরুব্বিরা এভাবে সিনক্রিয়েট করতে পারে?!! রাগে মুখ শক্ত করে তনুর পাশে যেয়ে বসলাম। তনু আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো,আমি বললাম, --তেমন কিছু না,তুই ওদিকে ধ্যান দিস না --হয়েছেটা কি? --এতো কথা শুনতে চাচ্ছিস কেন?ঐ মুরুব্বীদের মধ্যে একটু কথা কাটাকাটি হয়েছে আরকি! তুই ওদিকে কান দিস না। তনু চিন্তিত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। বেশ কিছুক্ষন পর পরিস্থিতি শান্ত হলো। মুনির ভাইয়ের এক বন্ধু আর সুরাইয়া আপুর স্বামী দু'জনে মিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে এনেছেন। এবং সব শেষে তনুর খালুর পক্ষ হয়ে তনুর বাবা ছেলে পক্ষের কাছে মাফ চেয়েছেন!অন্দর মহলেও একই হয়েছে,তনুর মা আর ভাবি মিলে মুনীর ভাইয়ের মা আর চাচীর কাছে সব কিছুর জন্য মাফ চেয়েছেন! শত হলেও তারা মেয়ে পক্ষ!দোষ থাকুক আর না থাকুক সব সময় তাদেরকেই মাফ চাইতে হবে! হায়রে সমাজ!যতোই মুখে সবাই বুলি ছাড়ুক না কেন,সময় মতো ঠিকই নিজেদের আসল চেহারা দেখিয়ে ছাড়ে!মুখে বলবে,'কিছুই চাই না'আসলে সবই চাই। ছেলের দরকার নাই,ছেলে পক্ষের দরকার আছে! ছেলের বাবা-মা চায়নি তো কি হয়েছে আত্নীয়-স্বজন আছেন না! আর সব শেষে? দোষ যেই করুক,প্রথা অনুযায়ী সব মেয়ে পক্ষের ঘাড়েই আসবে! চুপ করে মেয়ে পক্ষকেই কথা শুনতে হবে! মাফ ও তাদেরকেই চাইতে হবে! কারণ তারা তো মেয়ে পক্ষ! বিয়ে পড়ানো হয়ে গেছে,মুনাজাতের জন্য সবাইকে হাত তুলতে বলা হলো,আমি একবার চারপাশে চোখ বুলালাম। আন্টি,ভাবি এমনকি আমার আম্মু সবার মুখে কিছুটা স্বস্তির হাসি,তবে  চোখে ঠিকই দুঃশ্চিন্তার ছায়া!তনুর দিকে তাকালাম,কি এক ভয়ে কেমন তটস্থ হয়ে আছে যেনো! নতুন জীবনের শুরুটা এমন হবে তা যদি বেচারী জানতো...!আর বাকী সবাই যেনো একই কথাই বলছে,'যাক,বিয়ে তো হলো,এখন সামনে কি হবে কে জানে!!' আমি কেন জানি অর্থহীন একটা হাসি হাসলাম! একটা নিঃশ্বাস ফেলে মুনাজাতের জন্য হাত তুললাম... সব বিয়ের মতো এই বিয়েতেও দোয়ায় হুজুর বলছেন, ''হে আল্লাহ,তুমি এদেরকে হযরত আলী আর ফাতিমার মতো সুখী করো...'' আমীন বলতেই আমার চোখ থেকে অজান্তেই অশ্রু গড়িয়ে পড়ল... আল্লাহ নিশ্চয়ই এখানকার সবার না বলা কথা গুলো শুনছেন,অন্তত তনুর মনের কথা গুলো,আর কিছুই চাই না,তিনি যেনো ওর দোয়া শুনেন...  

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)