সাহিত্য
তরুর একদিন

দরজা খুলে জামাল বিরক্ত গলায় বলল, 'দেরী করলে কেন ? প্রায় ১১টা বাজে।' বলেই গুন গুন করে কি বলতে বলতে ভীতরে গেল। তরু কিছু বললো না। দরজার সবুজ রংয়ের পর্দাটা সরিয়ে ভীতরে এলো। পর্দার একপাশ ময়লা হাতের ছাপ পড়ে কালো হয়ে উঠেছে। গানের কথা ভেসে আসছে ভীতর রুম থেকে। তরু একটু কান পাতলো। হুম যা ভেবেছে, শ্রেয়া ঘোষাল। বেশির ভাগ সময় হিন্দিই শুনে জামাল। মাঝে মাঝে মমতাজ আর কুমার বিশ্বজিৎ। তরুর সব গান ই প্রায় মুখস্ত। প্রতিদিন শুনে। জামালের গান শুনার সখ। প্রায় ই বলে বড় একটা সিডি কিনবো। কিন্তু কিনে না।
জামাল চাকুরী করে। কি অফিস তরু জানে না। জানতে চায় নি। জামাল ও বলে না।
তরু সাবধানে হাতের চুড়ি খুলে রাখে। কাজের সময় পানি লাগলে রং নষ্ট হয়ে যাবে। ওয়ার্ডরোবার উপর ফ্রেমে কতগুলো ছবি। পারিবারিক আনন্দের মুহুর্তগুলো ফ্রেমবন্ধী করে রাখা হয়েছে। তরুর ভালো লাগে দেখতে।
'আজকে ঝাল কম দিয়ে রাধো। এসিডিটি হচ্ছে রাত থেকে।' জামাল বিছানায় শুয়ে আছে কাত হয়ে। সামনে পেপার।
এই বাসায় বুয়া আসে একটা সকালে। আজ আসেনি মনে হয়। বাসার ফ্লোরে কালকের বাসি কিছু জিনিস এদিক ওদিক পড়ে আছে। জামালকে কিছু জিজ্ঞাসা করলো না। তরু কিছু জানতে চায় না। জামাল মাঝে মাঝে মুড থাকলে গল্প করে। হিন্দি ছবির নায়িকাদের নিয়ে বেশি গল্প করতে পছন্দ করে। এটা তরু খেয়াল করেছে। তবে আরো কিছু নিয়েও কথা বলে। বাড়িওয়ালা। সামনের বাসার বশির সাহেব, শেয়ার বাজার..।
তরু শুনে যায়। কোন শব্দ না করেই। জামাল খেয়াল করে না তরু শুনছে কি শুনছে না।
ভালো রাধুনী তরু না। ভর্তাটা ভালো করে।
'এক কাপ চা দাও, সকালে কিছু খাইনি,মাগী বুয়াটা আসে নাই।' জামাল হালকা গলা তুললো।
তরু ছোট্ট নিশ্বাস ফেললো। চা বানাতে যেয়ে দেখে চিনি নাই। বয়মের গায়ে গায়ে কিছু লেগে আছে। গরম চা বয়মে ঢেলে চা করলো। রংটা তত ভালো হয় নি। চিন্তা করলো চা দেখে জামাল বিরক্ত হবে।
জামাল খেয়াল করলো না। মোবাইলে কাকে ধমকাতে ব্যস্ত।
বুয়া কেন আসেনি তরু আন্দাজ করতে পারে। বেতন বাড়াতে চাইছে গত মাস থেকেই। তরুকে কয়েকবার বলেছে।
'আফা, মামারে কন, বেতুন বাড়ান লাগবো নে। সংসার চলে না। হাফিজের বাপের এখন রিসকা নাই। আমার টাহায় সংসার চলে।'
তরু জামালকে বলেনি।
তরুর বাবা যখন পঙ্গু হয়ে বিছানায়, তখনকার কথা। তরুর মা আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় যেয়ে ঘন্টাখানিক কেঁদে কিছু টাকা নিয়ে আসত। নাইনে উঠা তরুর স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। তরুর ছোট শহীদ খুব স্কুলে যেতে চাইত। তরুর এক মামা নিয়ে নেয় শহীদকে। এখন রাজশাহী থাকে। প্রায় ন'মাস হলো তরু দেখে না ভাইকে। চাইলে ফোন করতে পারে। করে না।
দুপুরটা নিঃশব্দে এলো। জামাল ডাকছে। হিন্দি গান বাজছে। এখন তরু তাই শুনবে। খুব মনোযোগ দিয়ে। প্রতিটি লাইন। প্রতিটি শব্দ। কিন্তু কানে আসে জামালের ফোঁস ফোঁস শব্দ।
তরুর বলতে ইচ্ছে করে নাআআআ। কিন্তু বলে না।
জামালের ঘামে ভেজা পিচ্ছিল শরীরটা একসময় সরে যায়।
'লেবু দিয়ে এক গ্লাস সরবত দাও। বরফ দিও বেশি।' জামাল তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে। তরু সরবত হাতে আবছা গলায় বলে, 'আজ একটু তাড়াতাড়ি যেতে চাইছিলাম।'
উত্তরা থেকে শুত্রুাবাদ যেতে সময় লাগবে। তরু তাড়াতাড়ি হাটে। বাসে ঢুলতে ঢুলতে আসে। শুক্রাবাদ আসতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। বাসার সামনে পৌছে কোন আলো দেখতে পায় না। বুঝলো হারিকেন জালানো হয় নি। নিশ্চয় কেরোসিন নেই। ক্লান্ত পায়ে ঢুকলো তরু। মনিরকে দেখতে পেলো না অন্ধকারে পরিস্কার। তবে বুঝলো বিছানায় পড়ে আছে।
'তুমি আসছো ?' মনিরের ভাঙ্গা আওয়াজ। 'বাড়িওয়ালী খালা তোমাকে দেখা করতে বলছে, দুপুরে আসছিল।'
'তুমি খাইছ ?' তরু আস্তে করে বলে।
'হুম ! কেরোসিন নাই।' মনিরের ভাঙ্গা গলা স্তিমিত হয়ে আসে।
তরু হালকা পায়ে বের হয়ে আসে। কেরোসিন লাগবে। রাতের রান্নার তরকারি। ভাঙ্গা রাস্তায় সাবধানে হাটে। স্যান্ডেলের ফিতা যেন না ছিঁড়ে। হাতে মুঠ করে ধরা জামালের দেয়া এক হাজার টাকা।
রাতটা পুরো নীরব থাকে না। রাস্তায় মানুষের আওয়াজ। তরুর কেঁপে কেঁপে উঠা শরীরে মনির রোগা হাতটা মায়ায় রাখে।
কাঁদে না ...কাঁদে না...
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)