বই পরিচিতি/বই রিভিউ

দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস

দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস

নিঃসঙ্গ কবরখানায় দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষের মত আঞ্জুমকে দিয়ে এই মহাঘটনার শুরু। অরুন্ধতি কাকে ঘিরে কেন ঘটনা গোছান সেটা নিশ্চিতভাবে প্রেডিক্ট করা যায়না। দ্য গড অব স্মল থিংস পড়ে সে ধারণার গোড়াপত্তন হয়েছিল। দাম্ভীক স্বাজাতিকতা, বর্ণপ্রথা থেকে বাঁচার জন্য যে ছায়ায় মানুষ যেতে চায়, সেখানেও যে তারা উদার আশ্রয় পায়না অথবা সাম্যবাদেও কেমন করে ভর করে উঁচু নীচু কমরেডতত্ত্ব সেগুলো আইমানামের দুই জমজ এস্থাপেন- রাহেলের (অরুন্ধতি কি নিজেই এখানে লুকিয়ে আছেন?) জীবনের নানান প্রবাহ, সিরিয় খ্রিষ্টান ইপে পরিবারের আম্মুপেন (অরুন্ধতির মা ম্যারি রয়কে এখানে আমি খুঁজে পাই)- নিম্নবর্ণের পারাভান ভেলুথা, ইন্সেন্সিটিভ বেবী কোচাম্মা, দারুণ মেল শ্যভেনিস্ট চাকোর মাধ্যমে অরুন্ধতি রায় পাঠকের হৃদয়ে পৌঁছতে পেরেছেন।  

দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস শুরু করতে গিয়ে পুর্ব অভিজ্ঞতা অনুযায়ী অপেক্ষা করছিলাম যে অরুন্ধতি শুধুমাত্র একজন ক্লীবের জীবন সংগ্রামে আটকে না থেকে ওটাকে কেমন করে, কখন কিভাবে আরও বেশী গণ মানুষের সংগ্রামের কাছে নেবেন।  

পুরনো দিল্লীর খোয়াবগাঁর হিজড়াপট্টিত্যাগী এবং গৃহ...গী আঞ্জুম; যে ছিল উপন্যাসটির প্রথম চরিত্র, জন্মের পরই যার পরিচয় হয় আফতাব। আফতাব একটি প্রচলিত পুরুষ নাম। অথচ আঞ্জুমের লিঙ্গ ছিল অনির্ধারিত। তার মা জাহানারা বেগম এই মহাসত্য লুকিয়ে রাখার জন্য  সদা তৎপর ছিল কিন্তু সময় অবধারিতভাবেই সে সত্যকে লুকিয়ে রাখতে দেয়নি। আফতাব বয়সন্ধিতে এসে  স্বেচ্ছায় আঞ্জুম হয়ে ওঠে; ঠিক আঞ্জুম না। অজ্ঞাতনামা ইংরেজী জানা লোকটাকে সে নিজের নাম বলেছিল আঞ্জুমান, মেহফিল অথবা সম্মেলন।  

 ইন্দিরা গান্ধীর গুপ্তহ...র পর শুরু হল বেশুমার শিখ নিধনযজ্ঞ- আহমেদাবাদের দাঙ্গা। রাষ্ট্রের আদর্শগত অসংবেদনশীলতার পরিচয়  প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছিল। আফতাব কিংবা আঞ্জুম হিন্দুর ছদ্মবেশে দাঙ্গা থেকে পালাতে চাইলো। পালাতে গিয়ে সেই দিল্লীর কবরখানায় এসে নিজের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখতেও চাইলো। তারপর একসময় জান্নাত নামের এক ছোটখাটো আশ্রয়কেন্দ্র খুলে বসলো ওই কবরখানাতেই।

জ্বি, জান্নাত।

অরুন্ধতির গোরস্তানে জান্নাত বানানোর কন্সেপ্টটা পাঠককে ভাবতে বসায়। হোঁচট খেতে বাধ্য করে- চমকে দেয়। জাদুটা এখানে। এই জান্নাতে ঠাই হয় দলিতের, এই জান্নাতে ঠাই হয় পালানো মুক্তিকামীর, ঠাই হয় জাতি- বর্ণের অস্বীকারের, বিকলাঙ্গ- আশ্রয়হীনের কখনোবা বাস্তুহারা প্রানীরও নিরঙ্কুশ ঠাই হয় এখানে। এই চরিত্রগুলোর সাথে জড়িয়ে থাকা আরও আরও চরিত্র নিয়ে, আরও আরও প্রেক্ষাপট নিয়ে, খণ্ড খণ্ড- ছেঁড়া ছেঁড়া গল্প নিয়ে দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস ধীরে ধীরে এগোয়।

  

আঞ্জুমের জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকে তার ক্লীবত্ব আবিষ্কারের পর ছয় রকমের প্রতিক্রিয়ার ঘূর্ণিপাকে পড়ে যাওয়া মা, পিতা হাকিম মুলাকাত আলী; যিনি আপ্রাণ বিশ্বাস করতেন যে কবিতা আরোগ্য দিতে পারে- উপশমের ক্ষমতা কবিতার আছে অথবা পুলিশ বাহিনীর হাতে নিহত পিতার ছেলে সাদ্দাম যাকে আঞ্জুম অচ্ছ্যুত দলিতের বদলে বরং মর্গে কাজ করা চামার ডাকতেই পছন্দ করত। চামার সাদ্দাম আবার জয়নবকে পছন্দ করে। এই জয়নাবকে কুড়িয়ে বুকে তুলে নিয়েছিল আঞ্জুম।   

আঞ্জুম তৎকালীন দিল্লীতে চলমান দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে থমকায়। সে উপলব্ধি করে এ আন্দোলনে গণমানুষের ভাগ নেই। সাম্যের অস্তিত্ব বড় মরণাপন্ন সেখানে। সেখানে অসংখ্য অনেকে নেই। রাষ্ট্রের হাতে নিপীড়িতরা নেই, তার মত ক্লীবেরা নেই। মিডিয়া যেভাবে যে আদলে দেখাতে চায় ভারত মাতাকে, ঠিক সেভাবেই বাছাই করে করে ঢেলে সাজাচ্ছিল গোটা আন্দোলন।      

সে আন্দোলনে ভূপাল গ্যাস লিক ভিক্টিমরা গৌণ থাকে। কাশ্মীরী নিহত- অপহৃত মানুষগুলোর  স্বজনদের হাতের স্বজন হারানোর সঙ্খ্যাতত্ত্ব সেই সাথে গণতন্ত্রকে উন্মত্ত দানব আখ্যা দেয়া ব্যানার- প্ল্যাকার্ডের জায়গা ওখানে হয়না। ভারতীয় গণমাধ্যমের ফ্রেমে এঁটে যাবার মত উদারতা তারা পায়না।    

আন্দোলন, মিছিল- মিটিং এর ভেতর জেবিন দ্য সেকেন্ডকে পাওয়া যায়। জেবিন দ্য সেকেন্ড হচ্ছে কমরেড রিভাথির শিশু কন্যা। শিশুর পিতা কে, তা নির্দিষ্ট নয় কারণ কমরেড রিভাথি একটা গুপ্তদলের সদস্য থাকার অপরাধে ছয় জন পুলিশের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছিল। অর্থাৎ রাষ্ট্র দ্বারা ধর্ষিত হয়েছিল কমরেড।   

দিল্লী প্রতিবাদে জড় হওয়া প্রতিবাদ মুখরিত জনতার মাঝে শিশুটির আশ্রয়স্থল দেখতে পেয়েছিলেন অনশনরত ডঃ আজাদ ভারতীয়া। জন্তরমন্তর প্রসঙ্গ এই নামগুলো আর ঘটনাগুলোর সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে সম্পৃক্ত। 

জেবিন দ্য সেকেন্ডও জান্নাতে ঠাই পাওয়া, আঞ্জুমের ডানায় আগলে থাকা একজন ছোট্ট মানুষ।  জেবিন দ্য সেকেন্ডের গল্পে তিলো বা তিলোত্তমার আগমন। এই তিলোর ভেতর ব্যক্তি অরুন্ধতি র অল্প একটু ছায়াও হয়ত পাঠক পেলে পেতে পারেন। কাশ্মীর স্বাধিকার আন্দোলনকারী এবং  রাষ্ট্রদ্রোহী মুসার সাথে তিলোর প্রেম হয়। তিলো আর মুসা একসময় সহপাঠী ছিল। তাদের সাথে স্থাপত্য পড়ার সময় সহপাঠী ছিল বিপ্লব দাশগুপ্ত, ছিল  সাংবাদিক- টক  শো করা নাগারাজ হারিয়ানা। এই তিন পুরুষই তিলোর প্রতি অনুরক্ত ছিল।  

মুসার স্ত্রী আরিফা, কন্যা জেবিন দ্য ফার্স্ট আন্দোলন চলাকালীন সময়ে সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হয়। মুসা আরও দৃঢ়- আরও রহস্যময় হয়ে পড়ে। তিলো মুসাকে মানসিক শক্তি যোগাতে কাশ্মীর যায়। এরপর ঘটনার জের ধরে কাশ্মীরের ভয়ঙ্কর নরঘাতক আর্মি অফিসার আমরিক সিং এর হাতে তিলোত্তমা ধরা পড়ে, কিন্তু পালাতে পারে মুসা।  

বইটা পড়ার সময় পাশাপাশি অরুন্ধতির আরেকটি কালজয়ী সৃষ্টি লিসেনিং টু  গ্র্যাসহপার্স পড়ছিলাম। গণতন্ত্রের ওপরে লেখা কতগুলো ফিল্ড নোটস। ভারতীয় গণতন্ত্রের হাল হাকীকত- পরিণতির নানা ইস্যুর পাশাপাশি কাশ্মীর এবং আজাদী বিষয়ে রাষ্ট্রের অবস্থান, প্ররোচনা, গণহ...য় রসদ জোগানো এবং তার উদযাপনের অভিযোগে এত সাহসের সাথে কোন ভারতীয়কে লিখে যেতে অন্তত আমার চোখে পড়েনি। অন্য কোন দিন লিসেনিং টু  গ্র্যাসহপার্সের দিকে যাব। তিলোত্তমাদের দিকেই বরং দৃষ্টি ফেরাই।    

তিলো কেন আশ্রয়ের খোঁজে বাঙ্গালী বিপ্লব দাশগুপ্তের বদলে  তামিল- রাজপুত মিশ্র রক্তের নাগা হারিয়ানার হাত ধরলো, সেখানে ভালবাসা ছিল কি ছিলনা সেটার এক জটিল চিত্রায়নের মধ্য দিয়ে সংঘাত, খু...ের পর খু..., রাষ্ট্রীয় হ...যজ্ঞ এগোতে থাকে। ঘটনার পটভূমি খোয়াবগাঁ-  দিল্লী- কাশ্মীর পার করে ক্যালিফোর্নিয়া চলে যায়। দেশ পালানো খু...ী মেজর আমরিক সিং কে সব হারানো মুসা ছেড়ে দেবে কি দেবে না সে সংশয়ের ভেতরেও উঠে আসে রাষ্ট্র তার পোষা খু...ীর প্রতিও অকৃতজ্ঞ হয়, তাকে ব্যবহারের পর কেমন নির্দয় অস্বীকারকারী হয়ে ওঠে।

অন্যদিকে জাতপাতের বাছ বিচারে আক্রান্ত জনপদে নিজ দলের লোক অন্য দলের লোককে হ... করতে করতে একসময় নিজে মরে গেলেও অসম্মানিতই হয়। সাউথ ইন্ডিয়ান কম বয়সী সেনাটি কাশ্মীর ইস্যুতে প্রাণ হারায় এবং সেনাবাহিনী কর্তৃক ঠিকই শহীদী মর্যাদা পায় কিন্তু তার গ্রামে তার স্মারক ভেঙ্গে ফেলা হয় বারবার। কারণটা উঁচু নীচু জাতের সাথে সম্পর্কিত। এবং অরুন্ধতি "ইন সাম কান্ট্রিজ, সাম সোলজার্স ডাই টোয়াইস" কথাটির মাধ্যমে কেমন এক বেদনার আরও গভীরে পাঠককে পৌঁছে দেয়ার ক্ষমতা রাখেন।     

রাষ্ট্রের আদর্শিক চ্যুতি অথবা নিজের; নিজেকে কোথায় নিয়ে যায়, অথচ কোথায় তার যাবার কথা ছিল, অরুন্ধতি সেটা দেখাতে চেয়েছেন। তাকে অনেকাংশে সফলও বলা যায়।  রাষ্ট্রের স্বার্থ কোথায় তার ভুল ব্যাখ্যা রাষ্ট্রই যখন শেখে এবং দমন যখন প্রধানতম অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায়,  অল্প অল্প করে গন্তব্য তখন হয় ধ্বংসস্তূপ। আদর্শিক মরণ হয় গণতন্ত্রের, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের তারপর গোরস্তান ছাড়া আর কোন গতি থাকেনা। এটা সকল আদর্শ, সকল মতবাদের জন্য প্রযোজ্য, স্বতন্ত্র যে কোন  ব্যক্তিসত্ত্বার জন্যেও প্রযোজ্য।  

অথচ অনাহূত কেউ পেরে যায় তখন সম্ভাবনার শেষ আলোর চিহ্নটুকু জিইয়ে রাখতে। পুরোপুরি নিঃশেষ হতে দেয়না। ভাল থাকা- ভাল রাখার বর্ণ গোত্র জাতিভেদহীন জান্নাত গড়ে যায়। হৃদয় দিয়ে- হৃদয়ের গভীর দিয়ে।    


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)