বই পরিচিতি/বই রিভিউ

জল অরণ্য- আল মাহমুদ

জল অরণ্য- আল মাহমুদ

বুক রিভিউ
উপন্যাস:জল অরণ্য
কবি ও কথাসাহিত্যিকঃ আল মাহমুদ
মিজান পাবলিশার্স
প্রকাশকাল: ২০০৮

প্রিয় কবি -কথাসাহিত্যিক আল মাহমুদের উপন্যাস পর্যালোচনা করার দুঃসাহস করছি না,পাঠক হৃদয়ের অভিব্যক্তি তুলে ধরতেই এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।উপমহাদেশ, অর্ধেক মানবী,ডাহুকী,নিশিন্দা নারী,আগুনের মেয়েসহ অসাধারণ উপন্যাস লিখে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে অনবদ্য ভূমিকা পালন করেছেন কবি আল মাহমুদ। কবির পরিচয় তো সর্বজনবিদিত, ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।১৯৬৩ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ "লোক-লোকান্তর" প্রকাশিত হয়, আজ অবধি বাংলা ভাষা সাহিত্যে নিরন্তর সাধনা অব্যাহত রয়েছে।সর্বশেষ ২০১৮ সালের বইমেলায় " জীবন যখন বাঁক ঘোরে" উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়।গত মাসে কবির তিরাশিতম জন্মবার্ষিকী ছিলো,দীর্ঘ এ জীবনে প্রিয় মানুষ সুস্হতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি,বাংলা সাহিত্যকে আরো সমৃদ্ধ করে বিশ্ব দরবারে বাংলা ভাষাকে সুউচ্চস্হানে নিয়ে যান।
জল অরণ্য উপন্যাসটি রচনা করেছেন রাজনৈতিক ক্ষমতার অপ্যব্যবহার করে, জনগনের অধিকার হরন করে একজন নেতা কেমন করে অত্যাচারী হয়ে উঠে,শোষক ভূমিকায় রূপ নেন। উপন্যাস রচনার আলেখ্য হচ্ছে কবির চিরচেনা তিতাস নদী-ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলাকে ঘিরে আর্বতিত হয়েছে উপন্যাসের পট।উপন্যাসের বিস্তার, অন্যান্য লেখার চেয়ে কম হলেও,ঘটনার নাটকীয়তা-পরিণতি একে সার্থকতায় রূপ দিয়েছে।
উপন্যাসের শুরুতেই আমির মোহাম্মদ যে কি না জনগনের মতামতের প্রতিভূ, বা গনতন্ত্রের প্রতীক জলমহালের একমাত্র নেতা, তাঁকে ক্ষমতায় থাকা স্হানীয় এমপির প্ররোচনায় গ্রেফতার করা হয়।এতে জনগন একাত্ম হয়ে তার মুক্তির সপক্ষে ঐক্যমত গড়ে তোলে।তাছাড়া,সাহসী যৌবনদীপ্ত আমির মোহাম্মদ স্পষ্টবাদিতা-দৃঢ়তায় পুলিশ হকচকিয়ে যায়।রীতিমতো জামিন পেয়ে আমির সম্মানে ছাড়া পেয়ে, গ্রামে হাজার হাজার মানুষের শ্রদ্ধায় সিক্ত হয়।
মরিয়াম:উপন্যাসে লেখক নারী চরিত্র উপস্থাপনায় অনবদ্য দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন।
মরিয়াম আবহমান বাংলার সাহসী-সংগ্রামী মহিলাই নন,আমির মোহাম্মদের উপযুক্ত জীবনসঙ্গীনি রূপে পরিপূর্ণভাবে বিরাজ করেছিলো।সাধারন জেলে,চাষী, নিপীড়িত মানুষের ভরসা ছিলো,আমির মোহাম্মদ দৃঢ় নেতৃত্বের এক নিগূড় রহস্যের পিছনে ছিলো এই মরিয়াম।শক্তি,বুদ্ধি,চিন্তায় সে উতড়ে যেতে পেরেছিলো সকল বাধা।
আফজাল চৌধুরী:অত্যাচারী,লোভী,লাঠিয়াল বাহিনীর নেতা ছিলেন আফজাল শেখ।ক্ষমতার অন্ধতায় কখনো সে জনগনের নেতা হতে পারেনহ,অন্যায়ভাবে মাঝি-জেলেদের জীবিকা রেখে নিয়ে নিজের আখের গোছাতে মরিয়া হয়েছিল।নারীদের প্রতি কোন সম্মানবোধ ছিলো না,কামনার ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে,সে নার্স বাসনার উপর হামলে পড়েছিলো।কিন্তু,জনমতের কাছে তার অত্যাচারী খোসল ভেঙ্গে চূর্ন-বিচূর্ন কাচের টুকরোয় পরিণত হয়েছিলো।
ইদু শেখ:উপন্যাসের অন্যতম গুরুত্ব চরিত্র,যে কিনা আফজাল শেখ ও আমিরের মাঝে আলোচনা-সমঝোতার মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে।জীবিকার তাগিদে সে, আফজালকে নানা কূটনীতিক পরামর্শ দিয়ে আসলেও শেষ পর্যন্ত সত্য দিকে নাও ভিড়িয়েছিলো।মাঝে মাঝে নিদারুন সত্য কথা বলে,আফজালকে বিবেক কাঠগড়ায়ও দাড় করিয়েছে সে।
উপন্যাসে আমির মোহাম্মদ, মরিয়াম,আফজাল চৌধুরী,ইদু শেখ ছাড়াও মাওলানা মাসুক,অবিনাশ-কুন্তি,নার্স বাসনা মল্লবর্মন/মহিমের চরিত্রের সৌন্দর্য আমরা উপলব্ধি করতে পারি।
উপন্যাসের নায়ক আমির মোহাম্মদকে ঘিড়েই জল মহালের হাজার জেলে-মাঝিদের স্বপ্ন,বেঁচে থাকার লড়াই।তাঁর পাশে উত্তম সঙ্গীনি হয়ে মরিয়ামও জীবন অনবরত সংগ্রামে লিপ্ত হয়।বুদ্ধিদীপ্ত মরিয়াম শত বাধার মাঝে কলেজে পরীক্ষা দেয়,তারপর আইন পরীক্ষায় পাশ করে অ্যাডভোকেট হয়।
জল-মহালে জনগনের কর্তৃত্ব আদায়ে সে লড়াই করে,ক্ষমতাধর আফজালের সকল লোভের হাত গুড়িয়ে দেয়,আমির -মরিয়াম।
উপন্যাসে আমির-মরিয়ামের বেঁচে থাকার মাঝে অ্যাডভেঞ্চার খুঁজে পাওয়া যায়।আফজালের লোকজন বেশ কয়েকবার তাদের জানে মেরে ফেলার ব্যবস্হা নেয়।নদীতে তাদের নৌকার ইঞ্জিন বিকল করে,দিয়ে তার পাচাটা লোকদের রামদা নিয়ে ছুটিয়ে দেয়,আমির-মরিয়ামকে শেষ করে তিতাসে ফেলে দিতে।কিন্তু, ভাগ্যের খেলায় আমির মরিয়াম, আফজালেরই নৌকায় ফিরে আসে বাড়ি,নৌকা বেধে রেখে যায়,আফজালেরই ঘাটে।
চেষ্টায় বিফল হয়েও আফজাল, আরো হিংস্র হয়ে ওঠে আমিরের ঘরে অগ্নি সংযোগ করে জীবন্ত পুড়ে ফেলার প্রয়াসী হয়,অনুগত বিশ্বস্ত মানুষের গোপন সংবাদ পেয়ে তারা,দূরে আশ্রয় গ্রহন করে।এ চেষ্টাও ব্যর্থ হয়ে যায়,বরং জনমত আরো আমিরের দিকেই যেতে থাকে।নেতার জন্য সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার পূর্বে তারা নতুন ঘর তুলে পাশে দাড়ায়।
এতেও কি শান্ত হতে পেরেছিলো,হায়েনার দল?আমিরকে নারীকেলেঙ্কারীতে ফাসানোর মতলব করে ব্যর্থ হয়।
আমিরও তাট জেদ, দৃঢ় অবস্হান প্রকাশে আফজালের বাড়ি হামলা করে,আফজালকে বেধরক মার দেয়।কিন্তু,অন্দর মহলে কারো প্রতি অন্যায়ের হাত তোলেনি,সম্মানে জেনানাের মর্যাদা রক্ষা করে।উপরন্তু,আইনী লড়াইয়ে বিজয় লাভ করে মরিয়াম।সাথে সাথে আফজালকে অর্থনৈতিকভাবে দূর্বল করে দিতে বোরো ধানের দখল নেয়,জলমহালের সাধারন জনগন,
লিজের টাকা আমির মোহাম্মদ তাদের সমিতিতে জমা রাখে।এতে আফজাল আরো ক্রোধে ফেটে পড়ে,আইনী লড়াই-এ না পেরে এবার সে বাঁকা পথ ধরে।সন্তানসম্ভাবা মরিয়ামকে হাইকোর্ট থেকে তুলে নিয়ে গুম করে,আমিরের উপর চাপ সৃষ্টির অপচেষ্টা করে।কিন্ত,সে চেষ্টাও একপর্যায়ে ব্যর্থতায় রূপ নেয়।
সংসদ নিবার্চনে আমির তাঁর স্ত্রীকে আফজালের বিপক্ষে দাড় করায়,জনমত গড়তে আফজালের স্ত্রী জাহানারা এলাকায় বংশীয় প্রভাব বিস্তারে মাঠে নেমে পড়ে।যুদ্ধের ময়দানে যেন সমানে সমান,আমির মোহাম্মদও শত্রুর ঘাটিতে পাল্টা হানা দিয়ে আফজাল শেখের স্ত্রীকে তুলে আনে,কিন্তু আমির মোহাম্মদের মাজে ছিলো অভূতপূর্ব সংযম নারীর সম্ভ্রমের প্রতি সম্মানবোধ।প্রতিপক্ষ এতে আলোচনার মাঠে আসতে একমত হয়,আফজাল মুখোমুখি হতে চায় অ্যাডভোকেট মরিয়ামের।কিন্তু সেখানে আলাদা কোন নিরাপত্তা ব্যবস্হা কিংবা অন্য কারো প্রবেশের অধিকার ছিলো না।
ক্ষমতা-অর্থের মাঝেও আফজাল শেখ যে ঘাটতি ছিলো সেটা হলো সন্তানের, পিতৃত্বেরর হাহাকার।মরিয়ামের কাছে সে আমির মোহাম্মদের ঔরসের সন্তান কামনা করে,সে জানে আমির রক্তে আছে বীরত্ব,বীর্যবান তেজী সাহস।অশ্রুসিক্ত মরিয়াম বেরিয়ে আসে,আফজালের বাড়ি থেকে কেউ জানতে পারে না তাদের কথোপকথন।অত্যাচারী হায়েনা চূড়ান্ত বাড় বেড়ে যায়,নার্সকে তুলে নিয়ে আসে
মরিয়াম-আমিরের সন্তান আমির মাহমুদকে তুলে নিয়ে আসতে,যে কিনা নতুন জলমহালোর নেতা হওয়ার জন্য জন্ম হয়েছে।কিন্তু,সে কি পেরেছিলো তাঁকে গ্রাস করতে,তিতাসই তার বুকে অত্যাচারীর ব্যর্থতার শেষ নিশ্বাস এঁকে নিয়েছিলো।অবশেষে,সত্য-সুন্দরের বিজয় প্রতিস্ঠা পেলো,তিতাসের চারদিকের জনপদে।
এ উপন্যাসে পাঠক বড়ো সে শিক্ষা পাবে সেটা হলো,অন্যায়কে রুখে দাড়ানোর শিক্ষা,অন্যায়ের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিরোধ, প্রতিশোধের নেবার মানসিকতা,তবে সেটা উত্তম আচরণ,উদারতা,সাহস,ধৈর্য্যের মাধ্যমে।অসাধারন এ উপন্যাসে আবার মানুষ বিশ্বাস ফিরে পাবে সততা,নৈতিকতা, সংযম,জনগনের মতামত উপর।জল অরণ্য উপন্যাস সেই সাথে সুখপাঠ্যও বটে।

লেখার সময়কাল:১৮-১১-২০১ঈসায়ী


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)