অনির্ধারিত

বিজয়ের চিঠি

বিজয়ের চিঠি

বিজয়ের চিঠ

১৯৭১ সাল। মার্চ ৩০।
ছোট্ট পাড়া গাঁয়ে থাকে হারুনুর রশীদ। ছেলে মেয়ে আর বউ নিয়ে সংসার তার। সেদিন হাট থেকে ফিরবার পথে মুদিখানার রেডিওতে কেমন রক্ত গরম করা বক্তৃতা শুনতে পেয়েছিলো সে। কি জানি গাঁয়ের মোড়লরা প্রায়শই কি সব আলোচনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। হারুন গরীব মানুষ ওসবে কান দেয় না। ঝামেলা ছাড়া খুব শান্তিতে সংসার করে যাচ্ছে সে। ছেলেটা এবার পাশের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। মেয়ে থ্রীতে। সকাল হলে মরিচ ভেজে আলু ভর্তা দিয়ে পান্তা খায়, তারপর ক্ষেতে ছুটে যায়। দুপুর বেলা নিজের জালে আটকা পরা ছোট মাছের চচ্চড়ি, শাক বা সবজি দিয়ে কাঁচামরিচ এর ঝালে ধোঁয়া ওঠা ভাতের সাথে তৃপ্তিসহ খেয়ে নেয়। ফসলাদি ফলায় দুই বিঘা জমিতে। আলুর সময় আলু, ধানের সময় ধান। বাড়ির চারপাশে অনেক সবজি লাগিয়েছে হারুনের বউ। এমন সুখের ঘরে কোনরকম বিপদ আসুক তা কখনই হারুন চায় না।

হাট থেকে বড় ইলিশ মাছ কিনে বাড়িতে ঢোকে হারুন। বউ শ্যামলী এসে সামনে দাঁড়ায় চোখ বড় করে মাছের দিকে তাকিয়ে,
-তুমি ইলিশ কিনার টাকা কই পাইছো?
হারুন দাঁত বের করে হাসে,
-আজ ইলিশ মাছ অনেক সস্তা বেচতাছে বউ তাই কিনছি, খুশি হওনি? কতদিন হয় ইলিশ খাওয়া হয় না কও?
শ্যামলী আনন্দে আটখানা হয় হাত থেকে মাছ নিয়ে কাটতে যায় আর হারুনকে লক্ষ্য করে বলে,
-বাগান থাইকা বেগুন নিয়া আসো! বেগুন আলু দিয়ে ইলিশ মাছের ঝোল রানবো ।
হারুন মহা খুশি হয় বউয়ের খুশিতে। গদগদ হয়ে বেগুন তুলতে যেতে যেতে বলে,
পোলা মাইয়া দুটা টিফিন খাইতে আইসা খুশি হইব কও? .......... থেমে যায় হারুনের কথা। পাশের বাড়ির লিয়াকত আলী পাঁচিলের ওপার থেকে ডাক ছাড়ে,
-হারুন ভাই কই আপনে, গেরামের মাতব্বর সবাইরে ডাকছে জরুরী মিটিং এ।
গলা উচুঁ করে হারুন বললো,
- কি কারণ লিয়াকত ভাই? বুঝতাছিনা তো!
লিয়াকত হারুনের বাড়ির ভিতরে আসে। হারুনের কাছে দাঁড়ায়,
-দেশের অবস্থা অনেক খারাপ ভাই ঢাকায় যুদ্ধ লাগছে। সবার প্রস্তুত থাকা দরকার চলেন।
হারুন বললো,
-আইচ্ছা আসতাছি, বেগুন দিয়া আসি আপনে যান।


হারুন বাড়ি ফেরে রাত তিনটায়। ছেলেমেয়ে গুলোকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে শ্যামলী। রাগে অস্থির হয়ে আছে সে। ওর অবুঝ মন নানা আশংকায় শংকিত। হারুন মাথা নিচু করে,
- বউ মাফ কইরা দেও, তুমি না খাইয়া অপেক্ষা করতাছো, আমি এতো দেরী করলাম। শ্যাম শুনতাছো?
শ্যামলী ঘুমের ভান করে শুয়ে আছে খুব রাগ হচ্ছে ওর। হারুন আবার বললো,
-বউ দেশের জন্যে গাঁয়ের সকলে যুদ্ধ করবো। কাল ভোরে সবাই ট্রেনিং করতে ঢাকার দিকে রওনা দিতাছে। সেই ব্যাপারেই মিটিং হলো। মোড়লরা মিল্যা সবাইরে গোশত খিচুড়ি খাওয়াইছে। তুমি যাইতে না দিলে আমি যামুনা কইয়া আসছি।
শ্যামলি উঠে বসে, আনন্দে চোখে পানি আসে সে বললো,
-তোমার যাওয়া লাগবো না। এহন তুমি দেরী কইরা আসছো, তাই শাস্তি পাইবা সেটা হইলো, আমারে তুমি ভাত খাওয়ায়ে দিবা।
হারুন দুষ্টুমির হাসি হাসে বলে,
-এমন শাস্তি আমি বারবার মাথা পাইতা নিবো!

খুব ভোরে উঠে হারুন দেখলো বউ ঘরে নেই বাহির বারান্দায় নামাজ পড়ছে। হারুন দাড়িয়ে আছে পেছনে, শ্যামলীর এমন পবিত্রতা মন ছুয়ে যায় হারুনের। শ্যামলি সালাম ফেরায় উঠে দাড়িয়ে বললো,
-জলদি কইরা রেডি হওতো, তোমার কাপড় চোপড় গোছাইয়া দিছি। তুমি ঢাকা যাইবা।
হারুন বিস্মিত কন্ঠে,
-কি!
-হ, যাও কইলাম, ইলিশ মাছের মাথা দিয়া গরব ভাত খাইয়া যাইবা।
-আইচ্ছা। খুশি হয় হারুন। ছেলেমেয়েদের কপালে চুমু দেয়। আর তাতেই জেগে ওঠে ওরা।
দুজনেই সমস্বরে বলে ওঠে,
-আব্বা! কই যাইতেছো?
হারুন চোখের অশ্রু লুকিয়ে ফেলে,
-যুদ্ধ করতে যাই। দেশটাকে স্বাধীন করতে। তোমাগো জন্যে কি আনবো কওতো!
ছেলে বলে ওঠে আব্বা,
-খুব সুন্দর দেইখ্যা ইসকুল ব্যাগ আনবা আমার লাইগা।
-আইচ্ছা বাবু ঠিকয়াছে, এবার মেয়ের দিকে তাকায় হারুন। মেয়ে বলল,
-আমার চুলের অনেক গুলা কিলিপ আনবা, লিপিস্টিক আর জুতা।
-আইচ্ছা মা আনুম।
স্ত্রীর দিকে তাকায়, কিছু না বলেই বেরিয়ে যায় হারুন। শ্যামলিও পিছু ডাকে না। অব্যক্ততা অনেক কিছু বলে দেয়, বুঝিয়ে দেয়।


হারুন যাওয়ার প্রায় নয়মাস পরে একটা চিঠি আসে। হারুনের ছাড়া ছাড়া হাতের লেখা। দুইটা লাইন শুধু -
শ্যাম
"আমি এইখানে অনেক ভালো রহিয়াছি, তুমি ছেলে মেয়ে লইয়া ভালো থাকিও "!
পুনশ্চঃ আমরা দেশ স্বাধীন করিয়াই ফিরিবো।

ইতি - তোমারই হারুন

শ্যামলি চিঠি বুকে ধরে কাঁদে!বিরহের কান্নায়। ছেলে মেয়ে চিঠি পেয়ে খুশি হয়। এরই মধ্যে গ্রামের অনেকেই ফিরতে শুরু করেছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। গ্রামে গ্রামে তখন লাল সবুজ পতাকা পতপত করে বাতাসে উড়ছে। লিয়াকত আসে হারুনের খোঁজ নিতে, শ্যামলি টুল টেনে বসতে দেয়, শাড়ির ঘোমটা টেনে বললো
-ভাইজান আপনার ভাই কি আসতেছে?
লিয়াকত মলিন কন্ঠে বললো,
-ভাবী আমার তো বাঁচার কথাই আছিলো না। হারুন ভাইতো বীর দর্পে যুদ্ধ করছে, চিন্তা কইরেন না, আইয়া পড়বো।
হঠাৎই গ্রামের মোড়ল চিৎকার করতে করতে এগিয়ে আসে,
-আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুনুর রশিদ। তাকে সবাই ফুলের মালা দিয়ে বরন করে নাও ......... ছুটে বেরিয়ে যায় হারুনের ছেলে মেয়ে স্ত্রী ......। যেতে যেতে ছেলেমেয়ে দুটো কথা বলছে, আব্বায় আমার লাইগা অনেকগুলা কিলিপ আনছে ভাই। হ হ ঠিকই কইছস আমার ব্যাগটাও আনছে ..........।
খুব কাছে গিয়ে দেখলো লাল সবুজ পতাকায় মোড়ানো হারুনকে সবাই ফুলের মালা পরিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু সে দাড়িয়ে নেই, হাসিমুখে ছেলেমেয়েকে ডাকছে না নিস্তব্ধ, নিথর শরীরে শুয়ে আছে খাটিয়ায় .....!


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
লেখকের অন্যান্য ব্লগ সবগুলো দেখুন
তিনকোণা শত্রু

তিনকোণা শত্রু

Women Express

৪ এপ্রিল ২০২৩

So, if you wishing...

So, if you wishing...

Women Express

১৫ মার্চ ২০২৩

আবেশ

আবেশ

Women Express

৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৩