বই পরিচিতি/বই রিভিউ

বই পর্যালোচনা : মুহম্মদ আসাদের মক্কার পথ

বই পর্যালোচনা : মুহম্মদ আসাদের মক্কার পথ

ঊনবিংশ শতাব্দীর একদম শুরুর কথা। তখন পোল্যান্ড ছিল অস্ট্রিয়ার অংশ। সেখানকার লেম্বার্গ শহরে লিউপোলড উইসের জন্ম হয়। পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য ছিল ইহুদী রাব্বীর দায়িত্ব পালন। তার পিতামহ ছিলেন জার্নোবিৎসের কট্টর ইহুদী মোল্লা। পারিবারিক ঐতিহ্যের অনুসরণ হোক সেটা লিওপোলডের পরিবার চাইতেন। দীক্ষা দেয়া হল হিব্রু ধর্মের ইলম। শৈশবেই তার হিব্রু ভাষার বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের ওপর একটা মজবুত ভিত্তি তৈরি হতে থাকে। তিনি ওই বয়সেই অনর্গল হিব্রু জানতেন। জানতেন আরমায়িক ভাষা। ইহুদীদের সর্বোচ্চ শরীয়তী গ্রন্থ তালমুদে তার একটা বেশ ভাল দখলও চলে এসেছিল। তালমুদের মিশনা- জেমারা অর্থাৎ মূলপাঠ এবং তাফসির বুঝতেন তিনি। বেশ আত্মপ্রত্যয়ের সাথে আলোচনা করতে পারতেন জেরুজালেম এবং ব্যাবিলনের তালমুদের পার্থক্য নিয়ে।

তবে কৈশোরেই ইহুদীবাদে অনাস্থা চলে আসায় ধর্মচর্চা জীবন থেকে বাদ দিয়ে দেন এবং ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পকলা ও দর্শন পড়ার সময় বস্তুবাদী জীবনদর্শনের প্রতিও চরম বিরক্ত হন। ফ্রয়েডিয় সাইকোঅ্যানালাইসিসে নিমগ্ন ভক্তকূল পরিবেষ্টিত অবস্থাতে তিনি ইউরোপীয় আত্মায় দৈন্যতা খুঁজে পান। যেটাকে তিনি আধ্যাত্মিক নৈরাজ্যবাদ (Spiritual nihilism)  হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। 

সময়টা ১৯২২। সফর করেন মিশর, ফিলিস্তিন, ট্রান্স জর্ডান, ইরাক- আফগানিস্তান, সিরিয়া। জেরুজালেমে অবস্থানকালীন সময়ে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছিলেন আরব মুসলমানদের জীবন চর্চা। তার কাছে মনে হয়েছিল যে, বিশেষত আরব বেদুঈনদের আচার আচরণের ভেতর যতটুকু হিব্রু নবীদের প্রচারিত শিক্ষার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়, যাইওনিস্টদের ভেতর সেটা একেবারেই অনুপস্থিত। আবার ইউরোপে ফেরার পর হৃদয়ের অনিশ্চয়তা এবং আত্ম অবিশ্বাসের প্রচণ্ড টানাপোড়েন থেকে মুক্তি পেতে কার্যত সমাধান হিসেবে ইসলামের দারস্থ হলেন ১৯২৬ সালে।

পরের বছর ইউরোপ থেকে আবার মধ্যপ্রাচ্যে যাবার তাগীদ অনুভব করেন মূলত হজ্জ এবং মুসলিম বিশ্বের সাথে বিশদভাবে পরিচিত হবার জন্য। দ্য রোড টু মক্কার প্রেক্ষাপট ছিল ইতিহাস খুঁজে ফেরার এই যাত্রা। সৌদি বাদশাহর সাথে সুসম্পর্কের সূত্র ধরে প্রতিনিধি হিসেবে সৌদি ইখওয়ান বিদ্রোহ এবং লিবিয়ার সেনুসি বিদ্রোহের মত ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানেও অংশ নেন।

মুহম্মদ আসাদ হিসেবে লিওপোলড উইসের নতুন আত্মজিজ্ঞাসা এবং জ্ঞান অনুসন্ধানের জীবন শুরু হল। ইসলাম এবং আন্দোলন কে আত্মস্থ করছিলেন প্রচুর পড়াশোনা এবং পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। কালজয়ী লেখাগুলোও লিখছিলেন পাশাপাশি। কবি ও দার্শনিক আল্লামা ইকবালের পরামর্শে ভারতের পাঠানকোটের দারুল ইসলামে ১৯৩২ সালে বসবাস করা শুরু করেন।

ইউরোপীয় হয়েও ইসলামী আন্দোলনে এরকম সরাসরি সম্পৃক্ততা ব্রিটিশ অথোরিটির পছন্দ হচ্ছিল না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হবার দ্বিতীয় দিনেই তিনি গ্রেফতার হন এবং ছয় বছরেরও বেশী সময় ধরে কারাবন্দী থাকেন। তাঁর ইহুদী পিতা সহ বেশ কিছু নিকট পরিজন হলোকাস্টে নিহত হন । 

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে তিনি বিভিন্ন সরকারী দফতরে ইসলাম নিয়ে গবেষণা সংশ্লিষ্ট কাজে নিয়োজিত হন। তিনি ছিলেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দফতরের মধ্যপ্রাচ্য বিভাগের প্রধান। পাকিস্তান সরকার তাকে নিউইয়র্কে পাঠায় সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের প্রতিনিধি হিসেবে। সে দায়িত্বে ইস্তফা দিয়ে তিনি এই The Road to Mecca লেখায় পুরোপুরি নিজেকে ঢেলে দেন। তার বক্তব্য অনুযায়ী বইটি লেখকের নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া আনুষঙ্গিক কোন অবিস্মরণীয় অভিযান কাহিনী না। বিশ্বাস সঙ্ক্রান্ত আত্মপ্রচেষ্টার বর্ণনাও না, কারণ লেখকের জীবনে বিশ্বাস এসেছিল অর্জনের চেষ্টা ছাড়াই। বরং মক্কার পথ হল একজন ইউরোপীয়র ইসলাম আবিষ্কার এবং মুসলমান সমাজে বিলীন হবার অনাড়ম্বর গল্প।

মুহম্মদ আসাদ দুটি ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল- আবহের সাথে পুরোপুরিভাবে পরিচিত হবার একটি অনন্য অবস্থানের ভেতর ছিলেন। তিনি ছিলেন পশ্চিমের প্রজন্ম এবং জীবনের একটা পর্যায়ে এসে মুসলিমদের জীবনাচরণের ভেতর মিশে যান। যার কারণে লেখকের আত্মবিশ্বাসের ছাপ পাওয়া যাবে তার উভয় সংস্কৃতিরই বুদ্ধিবৃত্তিক ভাষা বুঝতে পারা এবং বলতে পারার ভেতর। সেই সঙ্গে তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন পাঠকদের যে মুসলিম ব্যক্তিরা চেষ্টা চরিত্র করে তাকে ইসলামে আনেনি, বরং ইসলামের প্রতি তার আন্তরিকতা এবং  ভালবাসা তাকে একের পর এক মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে জীবন যাপন করতে উদ্বুদ্ধ করেছে।

মোট ৫৩৩ পৃষ্ঠার অনন্য এই বইটিকে আসলেই লেখকের জবান অনুযায়ী আলাদা করে ভ্রমণ কাহিনী বা ইতিহাস গ্রন্থ অথবা ঠিক ঠিক আত্মজীবনীর ছকে ফেলে দিতে পারিনি। মুহাম্মদ আসাদের বর্ণিল জীবনের প্রথম ৩২ বছরের নানান রকমের দেখা এবং অনুভূতির সমন্বয় বইটিতে পাওয়া যাবে।

অদ্ভুত এক উপলব্ধি ঘিরে ছিল বর্ণনার নানারকমের পর্যায়ে। তৃষ্ণা অধ্যায় পড়ার সময় আমিই যেন তায়েমার কুয়া দেখার জন্য আড়াআড়ি ভাবে নুফুদ পাড়ি দেয়ার দুঃসাহস  করছিলাম। পড়ে থাকা লাভা মৃত্তিকা পাশ কাটিয়ে অফুরন্ত বালিয়াড়ির মাঝেই ছায়াবিথী খেজুর গাছ, সেখানে ছোট্ট পল্লী। কুয়ার ওপর কাঠের চাকার একটানা সঙ্গীতে আচ্ছন্ন মুসাফির দলে লুকিয়ে ছিলাম আমিও। বালিয়াড়ির ওপাশ থেকে আকাশের দিকে লতিয়ে উঠতে থাকা রক্তিমতা ছিল মরুঝড়ের প্রথম চিহ্ন। উপত্যকা ছেদ করে ফেলার মত সঞ্চিত শক্তি নিয়ে ঝড়ের ঘূর্ণিপাকে মরুভূমি আচ্ছাদিত হয়। এরপর কিভাবে সন্ত্রস্ত মানুষ এবং উট মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ফিরে আসতে পারে পড়তে গেলে শিউড়ে উঠতে হয়।

তৃষ্ণা অধ্যায় থেকেই শাম্মার বংশের লড়াকু সন্তান লেখকের সহচর জায়েদ কে মাঝে মধ্যে পাওয়া যাবে। সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা কিং আব্দুল আজীজ ইবনে সৌদের সাহচার্যের পটভূমি, সৌহার্দ নিয়ে লেখা হয়েছে বেশ কিছু ঘটনা। সেই শাহী পুরুষের ব্যক্তিত্ব এবং সক্ষমতার শক্তিতে যেভাবে শূন্য থেকে সৃষ্টি হয়েছিল একটি রাষ্ট্র তার কিছু না কিছু পাওয়া যাবে প্রতিটি অধ্যায়েই।

তৃষ্ণার পরে একের পর এক পথের শুরু, হাওয়া, কণ্ঠস্বরের জাদুতে আচ্ছন্ন হওয়া। লিওপোলডের আসাদ হবার পেছনের গল্পগুলো একটু একটু করে বিবৃত হয় পথের শুরুতে। এখানে চৌদ্দের কিশোর বয়স বাড়িয়ে- মিথ্যে নামে- ইস্কুল থেকে পালিয়ে অস্ট্রীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিল। ভিয়েনায় মনোবিকলন তত্ত্বে অতৃপ্তি, বোহেমিয়ান জীবন এবং চলচ্চিত্র প্রযোজক এফ ডবলু মার্নোর সহকারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ, মাদাম গোর্কির বর্ণনায় লিওপোলড তুলে আনেন রাশিয়ার দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ চিত্র - এরপর সাংবাদিকতার জীবনের সূচনা।

জাহাজের রেলিং ধরে অতীত খুঁজে আনা, দমকা বাতাসের গুহা, ফাদার ফেলিক্সের সাথে নির্বাণ, সন্যাস কিংবা আদিপাপ নিয়ে কথোপকথনের অবকাশে আসে স্রষ্টায় বিশ্বাস আর উপলব্ধির পাঠ। যাইওনিজমের অসারতা নিয়ে লেখকের অভিমত রয়েছে এই হাওয়া পর্বে। দৈনিক ফ্রাঙ্কফুর্টার যাইটুং এর সংবাদদাতা হিসেবে জেরুজালেমে বসবাস করেন বেশ কয়েক বছর। যাইওনিস্ট নেতা এবং পরবর্তীতে ইসরায়েলের স্টেটসম্যান চাইম ওয়াইজমানের সাথে এক মুখোমুখি আলোচনায় তৎকালীন আধুনিক যাইওনিজমের তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি এভাবে বলেন যে যদিও ইহুদীতত্ত্ব তার নিজস্ব বিষয় ছিল তবুও শুরু থেকেই শুধুমাত্র ইহুদী পরিচয়ের কারণে অভিবাসী এসে দেশটিতে ধর্মীয় সঙ্খ্যাগরিষ্টতা অর্জন করার প্রক্রিয়া এবং দেশের জনগণকে সেই ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে বহিরাগত করে ফেলার মানসিকতা এবং পদক্ষেপ অত্যন্ত আপত্তিজনক বলে মনে হয়েছে তার কাছে। যার কারণে, ইহুদী- আরব প্রশ্নে তিনি আরবদের পাশে দাঁড়াবেন বলে অঙ্গীকার করেন।

মরুভূমির নিঃশ্বাস মানুষের কণ্ঠস্বরে ধরা পড়ে সুর হয়ে। সুরগুলো হাজার বছর ধরে তৈরি হয়েছে মরুর মানুষ, বহু কবিলা আর যাযাবর জীবনের ছন্দ থেকে। কায়রোর বারাঙ্গনা পল্লী থেকে ভেসে আসা মিলিত কণ্ঠের আওয়াজ কানে এলে লেখক পশ্চীমা চোখে আরবদের লঘু এবং ভাসা ভাসা অস্তিত্ব নিয়ে ভেবেছেন। আবার তার ঘরের খুব নাগালে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট মসজিদের মিনার থেকে যে কণ্ঠস্বর ভেসে আসত, সে কণ্ঠস্বরে অনুভব করেছেন সম্মিলিত অন্তরের ঐক্য এবং বিচ্ছেদের রেখার কৃত্রিমতা।

এভাবে একে একে আত্মা এবং দেহের যোগসূত্র- বৈপরীত্য, স্বপ্ন থেকে অন্তর্দৃষ্টি খুঁজে পাওয়া। মধ্যপথের প্রাচ্যীয় অলি-গলি, সাপ ও জিনের কাহিনী, খ্যাপাটে আলী আগার পরিপাটি শিকস্তা হরফে লেখা পারস্যের চিঠির পর বালুচ পুলিশের টেলিগ্রাফের তার খুঁজে পাওয়া, তারপর উর্দি পরা রিজা শাহ অথবা বলশেভিক বিপ্লব পরবর্তী দৃশ্যপটে একজন রিজা খানের অবিস্মরণীয় উত্থান। শায়খ ইবনে বুলাইহিদের দজ্জাল জিজ্ঞাসা এবং লেখকের শেষ পদক্ষেপের পর আসবে সাইরেনিকা থেকে খু...ে গ্রাৎসিয়ানী- সেই সঙ্গে মুজাহিদীনের সংগ্রামের খণ্ডচিত্র। পথের শেষে দেখা মিলবে স্ব গৃহে প্রত্যাবর্তন। সমুদ্রের মত উদ্বেলিত জনতার ভিড়। তখন একজন মানুষের কণ্ঠ থেকে আল্লাহু আকবার ধ্বনিত হবার পর মুহূর্তের ভেতর একের পর মানুষ গোত্রীয় চিৎকার ছেড়ে ঈমানের ধ্বনি তুলেছিল। 

বইটি সন্দেহাতীতভাবে অনবদ্য। লেখকের গভীর জীবনবোধ পরতে পরতে স্পর্শ করে পাঠককে। কথাশিল্পী এবং চিন্তাবিদ অধ্যাপক শাহেদ আলীর উঁচু দরের অনুবাদ বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের কাছে মক্কার পথকে পরিপূর্ণ সাহিত্যমান সাথে নিয়ে উপস্থাপন করতে পেরেছে বলে আমার ব্যক্তিগত অভিমত।

অনুবাদক যথার্থই চেষ্টা করেছেন মূল গ্রন্থের নির্যাস অক্ষুণ্ণ রাখতে। রচনাশৈলী ঠিক রেখে কোন সৃষ্টিকে ভাষান্তর সহজ কোন বিষয় নয় তবু সৃজনধর্মী রচনার প্রতি অনুবাদকের টান এবং ইসলামী জীবন দর্শনের প্রতি আশৈশব ভালবাসা এক্ষেত্রে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাকে সহায়তা করেছে বলে অনুবাদক মনে করেন।

 অধ্যাপক আব্দুল গফুর ছিলেন তৎকালীন ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের প্রকাশনা পরিচালক এবং এই গ্রন্থের প্রকাশক। ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত হওয়া মক্কার পথ কে তিনি নিছক অনুবাদের বদলে বাংলা সাহিত্যের একটি অভিনব সংযোজন বলতে পছন্দ করেছেন ।

মুহম্মদ আসাদের অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞান সমৃদ্ধ জীবনের দিকগুলো ভাবিয়েছে বারবার। চিন্তা করতে শিখিয়েছে মানুষের অন্য ভূবনে বসতি গড়ার পরেও প্রত্যাবর্তন করা নিয়ে, মানুষের নিজেকে বারবার এভাবে অনুসন্ধান করা নিয়ে। হতে পারে এটাই ফিতরাত, এটাই সহজাত প্রবৃত্তি।

    বি: দ্র:

    (৫০৬ নম্বর পৃষ্ঠায় আমার বিরল নামের ইতিহাস নিয়ে সম্যক আলোচনা ভাল লেগেছে, তাই পাতাটি বিশেষ দ্রষ্টব্য হিসেবে থাকুক।)


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)