বই পরিচিতি/বই রিভিউ

কি পড়ছি, কেন পড়ছি, আর কিভাবে পড়ছি? (১)

কি পড়ছি, কেন পড়ছি, আর কিভাবে পড়ছি? (১)

কি পড়ছি, কেন পড়ছি, আর কিভাবে পড়ছি?

কি পড়ছি? সব! বই, লিফলেট, ইমেইলে পাওয়া এত্তো বড় নিউজ, ফেসবুকের ইয়া দীর্ঘ পোস্ট, তার আরও বড় কমেন্ট, পত্রিকা, ‘হাতে ভাজা মুড়ি’র প্যাকেটের লেখা, টয়লেট ক্লিনারের গায়ের লেখা, সব। অনেক আগে কার যেন একটা লেখা পড়েছিলাম, ইঁদুর যেমন দাঁত ওঠা মাত্র কুটকুট কাটতে শুরু করে দেয়, বিস্কুট, কাগজ, রাবার, ম্যাট্রেস, নির্বিচারে সবকিছু, তেমন নির্বিচারে সব পড়ি।  ছোটবেলায় রান্নাঘরে পাঠালে আম্মু চিৎকার করে মনে করিয়ে দিতেন, ‘চামচটা নিয়েই ফেরত আয়’ অথবা ‘অন্য দিকে তাকাইস না, চুলায় ভাত’! কারণ আমি হয়ত ডানোর টিনে নিউজিল্যান্ড দেখছি, সব ভুলে।

কেন পড়ি? ওই যে, ইচ্ছা করে, তাই।  আমি সম্ভবত খুব দুর্লভ কয়েকটা ক্ষেত্র ছাড়া কখনওই ‘পড়তে হবে’ দেখে পড়ি নাই। ভালো লাগে নাই, পড়ি নাই, ব্যাস। ইন্টারমিডিয়েটে ফিজিক্সের রানা স্যারের বই পড়ি নাই, ভালো লাগে না, তাই। অথচ ফিজিক্সের সাথে আমার সুগভীর ভালোবাসা। অন্য তিন লেখকের বই কিনে অংক করে সাফা করে ফেলেছি। আর এই বিষয়টা জানি দেখেই, বই পড়ার পরিমাণ নিয়ে কখনওই অহংকার আসে না মনে। কারণ, এটা আমার স্বভাব, যেটা তৈরীতে আমার হাত ছিলো না। এমনকি এখনও নেই। এই পাঠকের মৃত্যূ হলে তাকে ফিরিয়ে আনার উপায় জানা নেই আমার।  

কিভাবে পড়ি? এটা হল পোস্টের মূল উদ্দেশ্য।  বেশিরভাগ সময়ই এই প্রশ্নের মুখোমুখি হই। এই যে এত কাজ, দৌড়াদৌড়ি, সংসার-বাচ্চা-চাকুরি-পড়াশুনা করে আবার বই পড়ি কিভাবে? অনেকদিন ভাবলাম এটা নিয়ে। এরপর সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেললাম, সিক্রেটগুলো বলেই দিই। যদি কারুর একটুও কাজে লাগে? না লাগুক, কেউ জিগেস করলেই শর্টলিঙ্ক ধরায় দিব, ‘এই যে লিখে রেখেছি, পড়েন’। 

এক, ভালো লাগলে পড়ি, নইলে না।  পাঠ্য বা পাঠ্যের বাইরে, বই পড়া আমার নেশা। এই একটা বস্তু, আমাকে বাজে কথা বলে না, না বুঝে অভিযোগ করে না, না জানিয়ে মন থেকে হারিয়েও যেতে চায় না, আমার ওপর নিজের অকারণ আশা চাপিয়ে দিতে আসেনা। সে হল, বই। সুতরাং এর সাথে আমার সম্পর্ক সহজ, সরল, স্বাভাবিক। কাজ বেশি? মাথাব্যথা? খেতে বসেছি? এসএসসি? এইচএসসি? টার্ম ফাইনাল? সমস্যা যত বড়, বইয়ের কলেবরও তত। এইটের বৃত্তি পরীক্ষার ডামাডোলে ‘সাতকাহন’ পড়েছি, দুইটা খন্ডই, আর ‘ভেঙ্গে গেল তলোয়ার’। এসএসসির সময়ে ‘পূর্ব পশ্চিম’। হলে মাত্র গেছি, বিকাল হতেই একা লাগে। রাত বাড়লে বাগানে হাত পা ছড়ায় ক্রস বানাই। নন ডিপার্টমেন্টাল কোর্স ছিলো, সোশিওলজি। ম্যাডাম ম্যাটেরিয়াল দিতেন। এভাবে চামচে করে খাবো না, সিদ্ধান্ত নিয়ে কিনে ফেললাম বই। গ্রেড ভালো হয়েছে, সাথে বোনাস লাভ হল। সোশিওলজির সাথে বন্ধুত্ব হল, প্রগাঢ় সে বন্ধুত্ব, দীর্ঘস্থায়ী। এখনও কোন সোশিওলজী থিওরীর ম্যাটেরিয়াল পেলে পড়ে ফেলি, নিজের ডিসিপ্লিনের সাথে এক ফোঁটা মিল না থাকলেও। কিন্তু একাউন্টিং? একটুও মন লাগাতে পারি নাই। আগে আগে পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে গেছিলাম। গ্রেডও তথৈবচ! কি এসে যায়, আমার তাহাকে ‘ভালো লাগে নাই’, ব্যাস। কোনদিন কোন শখের বই, ‘আহা অমুক বলেছে, পড়ে ফেলি’ বলে জোর করে পড়তে পারি নাই। ভালো লাগলে, তবেই পড়েছি। একটা ব্যপার আছে অবশ্য। শুরু করলে শেষ না করে ছাড়াটা প্রায় অসাধ্য কাজ, এজন্য একটু যাচাই না করে বই ধরি না। আর তারপরেও অখাদ্য কপালে থাকলে আর কি, করলা ত মানুষেই খায়!

দুই,  সব বই একইভাবে পড়ি না। এমনকি একই বইয়ের বিভিন্ন অংশ বিভিন্নভাবে পড়া হয়। কিছু পড়া হয় খাতা-কলম হাতে, শুধু তাই না, পড়া শেষে ও বিষয়ের লেকচার বের করে শুনে, নোটে পয়েন্ট যোগ করি। কিছু বই পড়তে গিয়ে নিজে নিজেই পিঠ সোজা হয়ে যায়, চেয়ারে ঝোলা পা অবশ হয়ে আসে, তবু চোখ সরে না। কিছু বইয়ের প্রতিটা লাইন পড়ি। আবার, কিছুর একেকটা লাইনে কেবল চোখ ছুঁইয়ে যাই। পাশে বসে থাকা আরেকজন বুঝে ফেলেন মাঝে মাঝে, ডাকেন ‘ভার্টিকাল রীডার’। আমি নাকি বাঁ থেকে ডানে না, বই পড়ি উপর থেকে নিচে। লাইনপ্রতি এক অক্ষর। হ্যাঁ, পড়ি আসলেই, যদি মনে হয় এর চেয়ে বেশি প্রয়োজন নাই।  মাসের পড়া আঠারোটা বই দেখে ভাবছেন, ওগুলো আমি আপাপদমস্তক গলধঃকরণ করেছি? ভুল! অনেকগুলোই ‘ভার্টিকালি’ পড়া।

তিন। আমার বই পড়ার অবসর অখন্ড না। খাবার সময়, যা বড়জোর দশ মিনিট, বাসে কিছুক্ষণ, বাচ্চাদের স্কুলে অপেক্ষা করার সময় কিছুক্ষণ, চুল আঁচড়ানোর সময় একটু, আবার রাতে ঘুমানোর আগে হয়ত কিছুক্ষণ। সময়গুলো এতো আঁটোসাঁটো যে, একদম সামনেই একটা বই না থাকলে অন্য রুম থেকে এনে পড়তেও যে সময় যাবে, সেটা নাই। তো কি আর করা। ভাগ ভাগ অবসরে বইও থাকে ভাগে ভাগে। মানে কি? বেডরুমে একটা বই চলে, ড্রেসিং জাতীয় কাজের সময় পড়ার জন্য। পড়ার টেবিলে আরেকটা, কারণ খাই এখানে। সবাই মিলে খেতে বসা দিনে একবার, সকালে, সেসময় কথা হয় বেশি, কিংবা পত্রিকা। একটা কথা বলে রাখি। পত্রিকা একেকদিন কেবল ছুঁয়ে যাওয়া টাইপ পড়া হয়, তাও ফেসবুক আর নিউজ পোর্টালের কল্যাণে সকালের খবরই বেশ বাসী লাগে। তবু তিন বছর আগে আমরা ভেবেছিলাম, আমাদের বাচ্চারা নিউজপ্রিন্টের এই অদ্ভুত সংবাদ মাধ্যমটি না দেখে বড় হোক, আমরা চাই না। আলিফ লায়লার গল্পে এক এক শাহজাদীর আয়ু যেমন এক রাত্রেই ফুরিয়ে যেতো, আর এই করে করে শেহেরজাদ হাজার রাত্রির আয়ু বাগিয়ে নেয়ার বুদ্ধি করেছিলো, এই এক দিন মেয়াদী পত্রিকাও বাচ্চাদের অনেক কিছু শেখায়, জানায়, খবরকে ছুঁয়ে দেখতে দেয়। ওরা নিজেরাই মজার গল্প কাটে, এমনকি একটা বিজ্ঞাপন কিভাবে দিন দিন বদলাচ্ছে তাও খেয়াল করে।

যা বলছিলাম, ওই হিসেবে মতেই, অফিসে একটা বই থাকে। আর রাস্তায় পড়ার জন্য পিডিএফ। সেটা ফোনেই মজুদ। অফিস ছুটির দিনে আম্মুর বাসায় এক বেলা খাওয়া হয় মাঝেমাঝে।  তখন ছোট ভাইয়ের স্টকে হাত দিই। সে বেচারাও মানুষ ভালো, ‘না জিগেস করে নেয়া’র ঢালাও অনুমতি দেয় কোন কোন বইয়ের ক্ষেত্রে। ‘ভাত খাওয়ার বই নাই!’ - অনুরোধ আঁকা আমার চেহারা দেখেই হয়ত।

চার। সব শেষে, আমার একটা ‘গিফট’ আছে, আলহামদুলিল্লাহ। আমি খুব দ্রুত পড়ি। দ্রুত মানে খুবই দ্রুত। আর এতোই দ্রুত যে, কিছু বই মাস দুয়েকের মধ্যে প্রচ্ছদ, চরিত্র গল্পশুদ্ধা বেমালুম গিলে ফেলি। এজন্য ‘জাবর কাটা’ ব্যপারটা বেশ কাজে লাগে। আমার পড়া বেশিরভাগ বইই একাধিকবার পড়া। তবে এটা ঠিক, আমি একাধিকবার পড়ি এজন্য না যে, ‘ভুলে যাচ্ছি, ঝালাই করা দরকার’। পড়ি, কারণ ওই যে, ভালো লাগে।

শেষ কথা। আমার কন্যার বয়স আট পেরিয়ে নয়। আলাদা বিছানা দেয়া হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে। মাসখানিক হল ভাইবোনকেও আলাদা করে দিলাম, যদিও একই ঘরে। আমার মেয়ে তার ছোটমামাকে ভজিয়ে একটা ক্লিপওয়ালা ল্যাম্প জোগাড় করেছে। নানুর দেয়া নতুন খাটের শিয়রে সেই ক্লিপ আটকে দিয়ে একটা শাড়ির বাকসে কমিকস, ফিকশন মিলিয়ে কয়েকটা বই বালিশের পাশে রাখা হয়েছে। ‘কেন এখনও লাইট জ্বলে’, রেগে আগুন হয়ে এই কৈফিয়ত নিতে গিয়ে দেখি ক্লান্ত হাতে চশমা খুলে বাকসের ওপর রেখে বাঁ হাতে লাইটটা টুক করে টিপে দিয়ে অফ করে দিচ্ছে। আমার চোখে শুধু একটা হারিয়ে যাওয়া শৈশব ভাসে, আর ভাসে আরেকজন প্রবাদতুল্য মানুষের বেডল্যাম্পওয়ালা বইবোঝাই শিয়রের ছবি।

‘আমার সন্তান যেন থাকে জ্ঞানের সাথে, বেছে নিতে নিজেই শিখে, সবচে ভালোটা, হয়ত আমিও যা খুঁজে পাইনি, হয়ত খুঁজিই নি’।


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)