উইমেন (সামাজিক,মানসিক,সুবিধা বঞ্চিত নারী)

“পাকিস্তানী নারীঃ ৬ টি গল্প লজ্জার, লাঞ্চনার আর যুদ্ধ করে টিকে থাকার।”-৫

“পাকিস্তানী নারীঃ ৬ টি গল্প লজ্জার, লাঞ্চনার আর যুদ্ধ করে টিকে থাকার।”-৫

Image may contain: 1 person, standing, plant, outdoor and nature

হাসীনা বানু ৫৩
আমার জীবন বদলে গিয়েছিল আমার বাবা যখন ৩০ বছর আগে অপহৃত হয়েছিলেন।তিনি একজন ধনী ও সফল ব্যবসায়ী ছিলেন। আমরা একটি সম্পদশালী পরিবার ছিলাম।কিন্তু  কে জমানো টাকা, গহনা সবকিছু তার একাউন্ট থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিলো। ব্যাংক কতৃপক্ষ  জানায় তার সমস্ত টাকা দান করা হয়েছে দরিদ্র জনগোষ্ঠি কে। তখন খুব শিঘ্রই আমরা দারিদ্রের কবলে পড়ে গেলাম।সেই ঘটনার পর আমরা আমার মাকে হারিয়ে ফেললাম। তার ব্লাড প্রেশার বেড়ে গিয়েছিলো। তিনি তার ১২ জন ছেলেমেয়েকে কষ্টে ভাসিয়ে চলে গেলেন। বড় মেয়ে হওয়ায়, বাড়ির সমস্ত দায়িত্ব আমার দুর্বল কাধে এসে জমলো।

আমি যখন ১৭, আমি আলীর প্রেমে পড়ে যাই। আমরা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করি। আমরা একসাথে সুখি ছিলাম, কিন্তু ওর বাবা-মা ওকে জোর করেই আমাকে ডিভোর্স দেয়ায়।আলীর পরে আমি ফজলকে বিয়ে করি এটা এরেঞ্জ ম্যারেজ ছিলো।আমরা ইরানে চলে যাই, সেখানে আমাদের পাচজন সন্তান হয়েছিলো।আমরা সুখি ছিলাম। আমি ভাবতাম আমাদের সবকিছু আছে, কিন্তু ফজলের তা মনে হয়নি। একদিন সে আমাকে বললো, আমার বোন মারা গেছে। সেই মুহুর্তেই আমি করাচিতে ফিরে আসি।যখন পৌছলাম দেখলাম আমার বোন ভালো আছে, এবং সুস্থ আছে, আমি তখন বিভ্রান্ত হলাম। ফজল আমাকে কথা দিয়েছিলো সে আমাকে দুই সপ্তাহের ভেতরে নিয়ে যাবে।কিন্তু সে কখনো আসেনি;বরং একটি তালাকনামা পাঠিয়ে দিয়েছিলো। সে সন্তানদেরকে নিজের কাছেই রেখেছিলো। খুব কমবয়সী এক মেয়েকে বিয়ে করে, খাতিজা, যে মেয়েটি আমাদের ইরানের বাড়িতে ঘন ঘন আসতো, আমাদের বন্ধুর মতো ছিলো; আমি কখনো ভাবিনি সে আমাকে এভাবে ঠকাবে।

ফজলকে হারানোর চেয়েও সন্তান হারানোর কষ্ট আমি সহ্য করতে পারছিলাম না।সে ঘটনার পর আতংক, হতাশা আমাকে ঘিরে ধরে, আর সন্তানদের জন্য সবসময় কান্না আসতো। আমি দু বছর এক নিম্নমানের মানসিক হাসপাতালে ছিলাম, প্রথমে আমি রোগী হিসেবেই ভর্তি ছিলাম পরে সুস্থ হলে সেখানে কাজ পেয়ে যাই। সুযোগ-সুবিধা তেমন ছিলো না সেই হসপিটালে। অন্য এক রোগী কাঠের লাঠি দিয়ে আমাকে খুব মেরেছিলো, আমার নাকে অনেক বেশি ক্ষত হয়েছিলো।

সে সময় আমার বড় ছেলে শাহীদ আমাকে দেখতে আসে। ফজল তাকে থামাতে চেয়েছিলো; কিন্তু সে যে কোন উপায়ে চলে এসেছিলো, তখন আমি খুব অসুস্থ ছিলাম। আমি যখন তাকে দেখলাম, সে ইংলিশে কথা বলছিল;আমি তার সব কথা বুঝতে পেরেছিলাম।আমি কখনো আমার নিজের সন্তান থেকে দুরত্ব অনুভব করিনি। সে আমাকে পোশাক কিনে দেয়, টাকা দেয়, চিকিতসা করায়। সে আমাকে সাহায্য করে আর বলে তার সাথে যেতে। আমি কিভাবে ইরানে ফিরে যেতে পারি? তার বাবার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই!বরং আমি ওকে আমার কাছে থাকতে বলেছিলাম, কিন্তু আমার কোন অর্থ বা কোন বাড়ি ছিলো না যেখানে আমি ওর জন্য কিছু করতে পারি। আমার কাজের জায়গাটায় আমার বাড়ি।

সে সময়,আমি ভালোভাবে কাজ করতে পেরেছিলাম কেউ একটু সাহায্য করলেই। আমি শিশুদেরকে দেখাশুনা আর পরিচ্ছন্নতার কাজ করতে পারতাম। যেখানেই কাজ করেছি,ভালোবেসে খুব যত্নের সাথে করেছি, আর আমিও ভালোবাসা পেয়েছি যা আমি আমার পরিবার থেকে পাইনি।আমার কলিগরা নতুন কাপড় কিনে দিতো, তাদের ছেলেমেয়েদের সাথে আমি নিজের সন্তানের মতো আচরণ করতাম, আর আমাকে একটি নিশ্চিন্ত জায়গা দিয়েছিলো যেখানে আমি শান্তিতে রাত্রিবেলা ঘুমাতে পারতাম।যখন তাদের বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান হতো আমাকে নতুন জামাকাপড় কিনে দিতো আর অনুষ্ঠানে আমার সাথে এমন আচরণ করতো যেন, আমি তাদের খুব কাছের কেউ।

আমি এখনো ভালোবাসা খুজি।যদিও আমি এখন ৫০ এর দশকে। আশা করতাম এমন কেউ আমার জীবনে আসুক যাকে নিয়ে আমি বুড়ো হয়ে যাব। অনেকটা বছর একাকী কাটানোর পর এমন অনুভুতি হয়েছে।আমি টাকা জমাতাম, আর ভাবতাম, একটা নিজের বাড়ি হবে,যেখানে আমার সন্তানরা আমাকে দেখতে আসবে।যদি আমার চাওয়াটুকু সত্যি হয়ে আসে তাহলে আমি জানি আমি শান্তিতে মরতে পারতাম।


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
সম্পর্কিত ব্লগ