আমার যখন বিয়ে হয়েছিলো, আমি জানতাম আমার উপর আমার শাশুড়ির খেদমাত করা ফরজ নয়, এমন কি বলতে গেলে এটা আমার দায়িত্ব ও নয়। তারপরো আমি আমার সাধ্যমত তাঁদের খেদমাত করেছি। শাশুড়ির পছন্দে রান্নাকরা সহ তাঁকে নিজহাতে গোসল করিয়ে দেয়া, তাঁর উকুনবেছে চুল আঁচড়ে দেয়া, নখকেটে দেয়া সবকিছুই করেছি আমার সাধ্যের ও বাইরে গিয়ে।
শুধু শাশুড়ির-ই নয়, আমার ননদরাও বয়সে আমার মা'য়ের সমবয়সী ছিলেন, তাঁরা বেড়াতে এলে আমার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে তাঁদের সেবা করার চেষ্টা করেছি। আজ সময়ের ব্যবধানে আমরা কেউ আর কাউকে একটি নজর দেখার ও সুযোগ পাচ্ছি না। সে কষ্টের দিনগুলো (যেহেতু আমি বাবার বাসায় কোনো কাজ-ই করতামনা, তাই আমার জন্য ঐ দিনগুলো ছিলো খুবই কষ্টের!) হয়তো হারিয়ে গেছে কিন্তু যা রয়ে গেছে তা হচ্ছে দুয়া ও ভালোবাসা।
মনে আছে একদিন আমি রান্নাঘর থেকে ফিরে দেখি আমার দুই ননদ কিছু একটা নিয়ে হাসছেন। আমি জিজ্ঞেস করতেই বড় আপা সরল উত্তর দিলেন, " শুনেছিলাম শিক্ষিত মেয়েরা বেয়াদব হয়, শশুর শাশুড়ির খেদমাত করেনা, বড়দের সন্মান করেনা। কিন্তু তুমি সেরকম না"!
আমি তো লা জবাব! কী বলবো !! যা বলবো তা বলতে গেলে যদি কোনো কষ্ট দিয়ে ফেলি?! শুধু বললাম , "সত্যিকারের শিক্ষা তো মানুষ কে বেয়াদব করেনা, বরং আরো বেশি বিনয়ী করে.."
আরেকদিনের ঘটনা, আমার বিয়ের পরপরই; আমার হাসব্যান্ড আমার জন্য ঢাকা থেকে একটা গিফট নিয়েছিলো (সম্ভবত স্কার্ফ ) , আমার শাশুড়ি তখন বাসায় । আমি অবাক হয়ে গেলাম যে আমার জন্য একটা গিফট আনলো অথচ মা'য়ের জন্য আনলো না, (মানুষ টাকে তো আমি তখনো চিনিনি যে একেকবার একেকজনের জন্য এনে অন্য দেরকে "সর্যি, তোমাদের জন্য এবার কিছু আনলাম না" বলাই ওর স্বভাব!এবং এখনো ও' এরকমই!?) এরকম টা আমার মামা/চাচা/বাবাদের বেলায় কল্পনাও করা যায় না! আমি ওকে বল্লাম, আমি এটা এখন পারবো না, আগে মা'য়ের জন্য আনো...""- আমার নিজেকে তখন অপরাধী মনে হচ্ছিলো। আমি জানিনা ঘটনাটা ওর মনে আছে কি না, ওর অন্যদিকে ফিরে চোখ মোছাটা কিন্তু আমার দৃষ্টি এড়ায় নি!!..........
আমি বিয়ের পর যখন প্রথম স্কলারশীপের টাকা পাই, তখন সম্পূর্ণ টাই শাশুড়ি ও অন্যদের জন্য খরচ করি, গিফট করি। উনারা বললেন ,"তোমার বাবা মা তোমাকে পড়িয়েছেন, তাঁদের-ই তো হক্ব বেশি, আমি বললাম ,"উনাদেরকে তো আগেও দিয়েছি, আপনাদেরকে দেয়ার জন্য আর পাবো কি না তা তো জানি না.."
সেই শাশুড়ি আমার এখন আর বেঁচে নেই, আমার ননদের ও এখন আর আমার বাসায় আসার সময়/সুযোগ নেই। যেটা আছে, সেটা হচ্ছে ভালোবাসা, ভালো ধারনা! মাঝে মাঝে মনে হয় আমার শাশুড়িকে বোধহয় আমার মায়ের চেয়েও বেশি ভালোবাসি । আজো মুনাজাতে এ চোখের পানি ফেলে তাঁর জন্য দুয়া করি। ঐ সামান্য খিদমাতের বিনিময়ে যে ভালোবাসা পেয়েছি, তা-ই হয়তো এখনো আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। মনে আছে যখন প্রথম বাচ্চাটার জন্য রাতে ঘুমাতে পারতাম না, আমার শাশুড়ি মা ভোরে চুপি চুপি আমার ভাগ্নি কে ডেকে তুলতেন নাস্তা বানানোর জন্য, আমি টের পেলেই আমি উঠে যাবো, সেজন্য নিঃশব্দে কাজ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাতেন। এরকম ভালোবাসা দেয়ার মত শাশুড়ি আমাদের ঘরে ঘরেই আছেন, আমরা সে ভালোবাসাটা আদায় করে নিতে জানি না শুধু!
আমরা বাইরের মানুষ গুলোর কাছে নিজেকে 'well mannered' প্রমাণিত করার জন্য কত স্যাক্রিফাইস-ই না করি, কিন্তু এই একটা প্রসংগ এলেই কেন জানি নানান প্রশ্ন তুলি, ভীষণ নারীবাদী ও অধিকার সচেতন হয়ে উঠি! ইসলামের কোথায় লিখা আছে শশুর-শাশুড়ির খেদমাত করা জরুরী নয় সে দলীল খুঁজি, অথচ আমাদের শাশুড়িরা ও যে আমাদেরকে ভালোবাসেন, আমাদের সন্তানগুলো কে লালনপালনে সহযোগিতা করেন, আমাদের অনেকেই জব করি বা বাইরে সময় দেই, সেক্ষেত্রে তাঁরাই তো আমাদের সংসারটা সামলান। অন্তত দেখে রাখেন।
কারো কারো ক্ষেত্রে হয়তো ব্যতিক্রম ও থাকতে পারে, কিন্তু অধিকাংশ ঘরেই এখন এই দৃশ্যগুলোই চোখে পড়বে বেশি। তখন কিন্তু আর আমরা কুরআন হাদিসের দলীল খুঁজি না যে কোথায় আছে শাশুড়ি বৌকে রান্না করে খাওয়াতে হবে, কোথায় আছে বৌর কষ্ট হবে বলে শাশুড়ি আর কোথাও যেতে পারবেনা। এই বেলায় কিন্তু আমরা ঠিকই 'মনুষের জন্য মানুষ' -বুঝি। এই ক্ষেত্রে আমরা ঠিকই বুঝি 'শাশুড়ি বৌয়ের কষ্ট না বুঝলে তিনি কিসের শাশুড়ি,তিনি মানুষ না' ! অথচ মাস শেষে বেতনটা হাতে পেলে আর আবার অধিকার বোধ জেগে উঠে, ১০টাকার একটা চুলের ব্যান্ড কিনে দিতেও আমি রাজী না, কেন দিব শাশুড়ি কে ,'আমার বেতনে কি শাশুড়ির হক্ব আছে?' ...ইত্যাদি।
আসলে বর্তমান নীতি বিবর্জিত শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষালাভ করে আমরা coalfield হচ্ছি, মোটা বেতনে চাকুরী করার সুবাধে জামাইর কাছ থেকে হয়তো বাড়তি সন্মান (!) পাচ্ছি, কিন্তু 'সত্যিকারের মানুষ হতে আর পারছি না' !!!
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)