ধর্ম ও গবেষনা

পাওয়া, না পাওয়া

পাওয়া, না পাওয়া

আমরা যা চাই তা অনেক সময় মেলে না, আবার না চাইতেই অনেক কিছু পেয়ে যাই। মাঝে মাঝে যা চাই তার উল্টোটা পাই। এর পেছনে কি কোনো কারন আছে? এর একটি উত্তর আল্লাহ কুরআনে দিয়েছেন, আল্লাহ বলেন, “তোমাদের কাছে হয়তো কোন একটা বিষয় পছন্দসই নয়, অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর হয়তোবা কোন একটি বিষয় তোমাদের কাছে পছন্দনীয় অথচ তোমাদের জন্যে তা অকল্যাণকর। বস্তুতঃ আল্লাহই জানেন, তোমরা জান না। [সুরা বাকারা: ২১৬]

অর্থা আমরা এমন অনেক কিছু চাই যা আমাদের জন্য হয়েতো দুনিয়া-আখিরাতে সুফলের চেয়ে কুফল বেশি বয়ে আনবে। আর তাই আল্লাহ আমাদের তা থেকে বিরত রাখেন। আল্লাহ আমাদের ভালোবাসেন বলেই বিরত রাখেন। উদাহরনস্বরূপ, পছন্দের কাউকে নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে না পাওয়া। হয়তো আল্লাহ চান না বলেই দুজনের মিলন হয় না, হয়তো তা দুনিয়া আখিরাতে কল্যানকর হবে না বলেই আল্লাহ আমাদের তা হতে বিরত করেন। সম্পদ, স্বাস্থ্য ইত্যাদির ক্ষেত্রেও তাই একটি হাদিসে এসেছে যে আল্লাহ বলেছেন, “আমার বান্দাদের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে যাদেরকে সম্পদশালী না করলে তারা প্রকৃতপক্ষে বিশ্বাস স্থাপন করবে না; আমি যদি তাদের দরিদ্র করি তবে তারা অবিশ্বাস করে বসবে আমার বান্দাদের মধ্যে এমন কিছু লোকও আছে যাদের সম্পদ অল্প না হলে তারা প্রকৃতপক্ষে বিশ্বাস স্থাপন করবে না, আমি তাদেরকে ধনী বানিয়ে দিলে তারা অবিশ্বাসীতে পরিনত হবেতবে তার মানে এই না যে আমরা আল্লাহর কাছে ধন-সম্পদ চাইবো না, বা চাইলেও আল্লাহ দেবেন না আমরা চাইবো, স্বয়ং নবী(সঃ) আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেন, “চারটি জিনিস সুখেরই অংশ: সঙ্গী, প্রশস্ত বাসস্থান, উত্তম প্রতিবেশী এবং আরামদায়ক বাহনতবে আমাদের আগে নিজেদের নিয়তকে পরিশুদ্ধ করতে হবে, আমাদের কর্মপন্থাকে পরিশীলিত করেতে হবে 

আল্লাহ তার বান্দা-বান্দিদের পরীক্ষা করেন, কখনও হতে পারে তা আশাভঙ্গের মাধ্যমে। অনেক সময় আমরা প্রিয় কোনো কিছু হারিয়ে ফেলি, আবার অনেক সময় কাছের মানুষ আমাদের কাঁদায়, হৃদয় ভেঙে চুরমার করে দেয়। আল্লাহ আমাদের এমন অনেক দুঃখ কষ্টের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যান। কেন? কারন দুঃখ-কষ্ট আমাদের ভিতরের শক্তিকে জাগিয়ে তোলে। নিজেদের চিনতে শিখায়। আমাদেরকে সৃষ্টির মুখাপেক্ষি হওয়া থেকে বিরত করে স্রষ্টার মুখাপেক্ষি হতে শেখায়।

আমাদের দুঃখ-কষ্টের পেছনে আল্লাহর আরও একটি উদ্যেশ্য আছে, তা হলো আমাদের পাপসমূহ মুছে ফেলা একজন বান্দা/বান্দি যখন দুঃখ-কষ্টে পতিত হয় তখন তার গুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করেন এভাবে একসময় সে মাসুম হয়ে যায় আল্লাহ আমাদের ভালোবাসেন বলেই তো আমাদের দুঃখ-কষ্টে ফেলেন, আমাদের জান্নাতে যাওয়ার পথ সহজ করে দেন

সাথে সাথে এর মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার পরীক্ষা নেন। আল্লাহ কাউকে নিয়ামত দিয়ে পরীক্ষা করেন; কাউকে নিয়ামত থেকে বঞ্চিত করে পরীক্ষা করেন আমার এক বন্ধু আমাকে একবার একটি সুন্দর প্রশ্ন করেছিলো একজন মানুষ দুনিয়াতে জন্মসূত্রে ধন-সম্পদের অধিকারী হলো এবং একই সাথে সে আল্লাহর ইবাদতও করলো ফলে সে আল্লাহ চাইলে জান্নাত লাভ করবে আবার, আরেকজন মানুষ জন্মসূত্রে অতি দরিদ্র ঘরে জন্মালো; সে দুনিয়াতে মানবেতর জীবন কাটালো আর আল্লাহর ইবাদত করলো ফলে আল্লাহ চাইলে সেও জান্নাতে যাবে আমার বন্ধুর প্রশ্ন ছিলো: একজন দুনিয়াতেও পেলো এবং আখিরাতেও পেলো, কিন্তু অপরজন দুনিয়াতে পেলো না, শুধু আখিরাতে পেলো এটা কি ন্যায়বিচার হলো? দুইজন কি সমান হলো? আমি জবাবে বলেছিলাম(ইসলাম সম্পর্কে আমার যতটুকু জ্ঞান ছিলো তার আলোকে): আল্লাহ কারও প্রতি বিন্দু মাত্র অবিচার করেন না প্রথমত, নবী(সঃ) বলেছেন, গরীবরা ধনীদের চেয়ে ৫০০ বছর আগে জান্নতে যাবেশুধুমাত্র গরীব হবার কারনে তারা একটি বাড়তি সুবিধা পাবে। দ্বিতীয়ত, গরীবদের জন্য জান্নাতে যাওয়া তুলনামুলকভাবে সহজ আপনি ধনী হলে আপনার উপর অনেক দায়-দায়িত্ব ও বাধ্যবাধকতা আসবে, যেমন জাকাত দেয়া, গরীবদের সাহায্য করা, সম্পদকে হালাল পন্থায় ব্যায় করা, ইত্যাদি এছাড়াও সম্পদ মানুষকে বেপোরোয়া করে তোলে, হারামে প্রলুব্ধ করে, আখিরাতকে ভুলে দুনিয়া নিয়ে মত্ত থাকার প্রনোদোনা দেয় এর উদাহরন পৃথিবীজুড়ে আছে অর্থা সম্পদ কারো কাছে একা আসে না, সাথে আনে ফিতনা ও পরীক্ষা আপনাকে এসবের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে হবে পক্ষান্তরে দেখা যায়, গরীবরা বেশি ধর্মভীরু হয়, গরীবদের পাপের সুযোগতুলনামূলোক কম হয় তৃতীয়ত, ইসলাম আমাদের শেখায় যে আপনি যত কষ্ট করবেন আপনার সওয়াবও ততো বেশি হবে যেমন, আপনি এসি রুমে বসে, ভরপেট খেয়ে, দুশ্চিন্তমুক্ত হয়ে চার রাকাত নামায পড়লেন আর, একজন প্রচন্ড গরমে, খালিপেটে থেকে, প্রচন্ড দুশ্চিন্তা নিয়ে চার রাকাত নামায পড়লো আল্লাহ কি দ্বিতীয় বেক্তিটিকে প্রথম বেক্তির চেয়ে বেশি পুরস্কার দিবেন না? চতুর্থত, যারা দুনিয়াতে অবর্ননীয় কষ্ট স্বীকার করেছে, আল্লাহ তাদের ক্ষতি পূরন দিবেন মানুষ তার দুনিয়ার জীবনের আমল-আখলাক-ত্যাগ-কষ্ট ইত্যাদির বিবেচনায় জান্নাতে উচ্চ থেকে উচ্চতর মর্যাদা লাভ করবেন অর্থা গরীব তার কষ্টের খেসারত বেহেশতে পাবে পঞ্চমত, কেউ গরীব হয়ে জন্মালে সে আজীবন গরীবই থাকবে এমনটা নয়, পরিশ্রমের মাধ্যমে সে দারিদ্র জয় করতে পারে আবার কেউ ধনীর ঘরে জন্মালে সে যে আজীবন স্বচ্ছল থাকবে তার কোনো নিরাপত্তা নেই, পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক রাজাও পথের ফকির হয়েছেনআর সুখ একটি মানসিক বিষয়; অঢেল সম্পদ অনেক সময় সুখের খোঁজ দিতে পারে না, আবার দেখা যায় গরীবের কুটিরে দিন রাত সুখের পসরা বসে। ষষ্ঠত, ‍দুনিয়ার জীবন আখিরাতের তুলনায় কিছুই না, কারন আখিরাতের জীবন অনন্তকালের জীবন, যার শেষ নেইআর, পরকালে ভালোরা দুনিয়ার জীবনের সব কষ্ট ভুলে যাবে, আর পাপীরা দুনিয়ার জীবনের সব সুখ ভুলে যাবে। একটি হাদিসে নবী(সঃ) বলেছেন, “দুনিয়াতে খুব আরাম-আয়েশে থাকা একজন পাপীকে জাহান্নামে একবার ডুবিয়ে এনে আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন, ‘তুমি কি কখনও ভালো কিছু দেখেছো? কোনো আরাম-আয়েশের কথা মনে করতে পারছো কি?’ উত্তরে সে বলবে, ‘আল্লাহর নামে কসম করে বলছি, না, আমি দেখি নি, কোনো আনন্দের কথাও আমার মনে নেই!’ এরপর দুনিয়াতে সমস্যায় জর্জরিত থাকা একজন জান্নাতীকে আল্লাহ জান্নাতে একবার ডুবিয়ে এনে জিজ্ঞেস করবেন, ‘তুমি কি কখনও কোনো দুর্দশায় ছিলে? কথনও কি কোনো কষ্ট-দুর্ভোগে ছিলে তুমি?’ উত্তরে সে বলবে, ‘আল্লাহর শপথ! আমি কখনও কোনো দুর্দশা দেখি নি, আর কখনও কষ্ট-দুর্ভোগও পোহাই নি!’ অন্য একটি হাদিসে এসেছে, মানুষ আখিরাতে আক্ষেপ করে বলবে, পৃথিবীতে তাদের চামড়া যদি কাঁচি দিয়ে কেঁটে টুকরো করা হতো, তবে তার প্রতিদান আজ তারা পেতো

সুতরাং, সার্বিক দিক বিবেচনায় দেখা যায় যে আল্লাহর বন্টনে কোনো অবিচার নেই হয়তো আমাদের বুঝতে কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু তা আমাদের জ্ঞানের স্বল্পতার কারনেই

আমরা দুনিয়াতে খবুই স্বল্প সময়ের আতিথী মাত্র তাই পাওয়া, না পাওয়ার হিসেব কষে সময় নষ্ট করাটা বোকামী ছাড়া কিছু নয় ক্ষুদ্র এই জীবনে অনেক কিছুই হয়তো পাওয়া হবে না, অনেক স্বপ্ন পূর্ন হবে না, অনেক মানুষ পাশে থাকবে না কিন্তু তাতে যেন আমাদের জীবন থেমে না যায়, আমাদের হৃদয় যেন শক্ত না হয়ে যায় আমরা যেন বিশ্বাস রাখি আমাদের রবের উপর, যা কিছু হয়, তার অনুমতিতেই তো হয়; আর আল্লাহই তো আমাদের সবথেকে কাছের, সবথেকে আপন; তিনি তো আমাদের মঙ্গল ছাড়া অন্য কিছুই চান না!


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)