বই পরিচিতি/বই রিভিউ

'নিজের একটি কামরা'

'নিজের একটি কামরা'

 

শহুরে মাঘের বিকেল। শীত শুধু বিলাসিতা এখানে।ঝলকে আসা অবশিষ্ট উত্তুরে হাওয়ার প্রভাবে কারও কারও গায়ে তবু, ফ্যশন আর থেকে থেকে বাহারি শীতের পোশাক।

সপ্তাহান্তের দিন। নানামুখী কাজের কিছু সেরে, কিছু তুলে রেখে গোসল করে চায়ের ঢাউস মগ নিয়ে টেবিলে বসেছি। গত তিনদিনে পড়া একটা বইয়ের কথাগুলো মাথা থেকে ঝেড়ে না ফেলা পর্যন্ত শান্তি হচ্ছে না।  

আমার ঘরটা ছোট, তাতে পড়ার জায়গা আরও ক্ষুদ্র। বাবুইয়ের বাসায় যেমন দরজার কপাট লাগানোর বিলাসিতা করা যায় না, তেমনই এক দিকে দরজা নেই, আলমারি দিয়ে পার্টিশন দেয়া। এই এতোদিন দশ বাই দশের ঘরটা আমার কাছে অতি অপরিহার্য বিষয় ছিলো। বহু কষ্টে এদিক সেদিক জায়গা বাঁচিয়ে, প্রচলিত নিয়ম ভেঙ্গে এই ছোট্ট পরিসরটিকে আলাদা করে নিয়েছিলাম, অনেকের কটাক্ষ সহ্য করেই। আমার ঘরে সোফা নেই, কারণ আমি প্রয়োজন বোধ করিনি। কিন্তু ভাবা অসম্ভব যে, এখানে একটি টেবিল আর বইয়ের স্তূপ থাকবে না।

ভার্জিনিয়া উলফের A room of one’s own এক ধাক্কায় আমাকে একটি চরম বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আজকে আমি যে আকাঙ্ক্ষিত বস্তুটিকে বিনা কিংবা অল্প আয়াসে হাতের মুঠোয় পেয়েছি, সে বস্তুই মাত্র অল্প কিছুদিন আগে কারো কারো কাছে মহার্ঘ্য বস্তু ছিলো, এখনও আরও অনেকের কাছে আছে। তার চেয়ে ভীতিপ্রদ হল, আরও অনেকে এমনও আছেন, নিজের জন্য কোনটা চাইতে হবে সেটাই ভাবতে জানেন না। পরাধীনতা তাই কোন দৃশ্যমান শৃঙ্খল নয়, পরাধীনতা একটি অজ্ঞানতাপ্রসূত অন্ধকারের নাম। 

আমার হাতের বইয়ের কপিটি আলম খোরশেদের অনুবাদ, বাংলাদেশ অনুবাদ সংসদের পক্ষে ‘সংহতি’ বইটি প্রকাশ করেছে, সব্যসাচী হাজরার প্রচ্ছদে। সত্যি কথা বলতে, অনুবাদের ভাষা খুব ঝরঝরে নয়, তবে ভার্জিনিয়া উলফের বলতে চাওয়া কথাটি তাতে বাঁধা পড়েনি। নারী অধিকারের কথা ভাবতে আমাদের মাথায় চট করে চলে আসে পরিপাটি কোন একজন নারী অফিস পানে ছুটছেন কিংবা খোলা হাওয়ায় বসে গান গাইছেন। ভার্জিনিয়া উলফ যে অনুষঙ্গের আড়ালে নারীদের অবস্থানের ভিন্নতা দেখিয়েছেন, তা হোল সাহিত্য বা সৃজনশীলতা। নারীর মানসিক দৈন্যের পাশাপাশি তিনি অবকাঠামোগত আয়োজনের অভাব আর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা ধ্যন-ধারণাকে মূখ্য বলে দেখাতে চেয়েছেন।

চাওয়াটা খুব মজার, অনেকেই হয়ত ফিক করে হেসে দেবেন! বলবেন, ‘অ, তার একটা রুম চাই? তো অসুবিধা কি? আমার পুরো ঘরই তো তার। সে ই তো ঘরণী’। বটে! নারী ঘরণী বটেন, কিন্তু সেটা কর্তব্য অর্থে, অধিকার অর্থে নয়। তা ও বিয়ের আগে পিতার ঘরে তার একটি ঘর এবং টেবিল থাকে, আনুষ্ঠানিক পড়ালেখা শেষ হলে সে পাটও শেষ। আর বিয়ের পর নারী সম্ভবত নিজেই ভুলে যান, তাঁর একান্তে সময় কাটাতে হলে শুধু দুপায়ের মানুষ নয়, কমপক্ষে দুটি চারপায়ের জড়বস্তুও প্রয়োজন। একটি চেয়ার এবং একটি টেবিল, আর কিছু নিজস্ব সময়, এর অভাবে অনেক নারীর শেকসপীয়র হয়ে ওঠা হয় না, প্রকৃত বোদ্ধার মত রাজনীতিকে বুঝতে পারলেও বারোয়ারি বসার ঘরে পারিবারিক আড্ডার গালগল্পের প্রভাবে তিনি সামাজিক উপন্যাসেই আটকে থাকেন।

আসুন, বই থেকে তুলে আনা কিছু উদ্ধৃতি দেখিঃ

-      “কল্পনায় সে চুড়ান্ত গুরুত্বের যোগ্য, কার্যত তার কোন মূল্যই নেই।কবিতার ছত্রে ছত্রে তার উল্লেখ, ইতিহাসে সে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। কথাসাহিত্যে রাজা ও বিজেতাদের জীবন সে নিয়ন্ত্রণ করে, বাস্তবে সে যে কোন বালকেরও দাসী। ”

-      কোন এক বিশপ লিখেছিলেন, ‘অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের যে কোন নারীর পক্ষে শেকসপীয়রের মত নাটক লেখা সম্পূর্ণ অসম্ভব। ঠিক যেমন বিড়ালেরা আত্না থাকা সত্ত্বেও কখনওই স্বর্গে যায় না।’

-      একটা স্থায়ী উপার্জন মন মানসিকতায় কী অসম্ভব পরিবর্তনই না আনতে পারে।। পৃথিবীর কোন শক্তিই আমার পাঁচশ পাউন্ড ছিনিয়ে নিতে পারবে না। খাদ্য, বাসস্থান ও পোশাক আমার চিরকালের জন্য নিশ্চিত।

 

ভার্জিনিয়া উলফ খুব মজার একটি উদাহরণ টেনেছেন। শেকসপীয়রের কালজয়ী লেখাগুলোর পেছনে অনেক সুবিধাবঞ্চিত হয়েও শুধু পুরুষ হবার জন্য শেকসপীয়র যে বাড়তি সুযোগগুলো পেয়েছেন, তার ভূমিকা আছে। সেই একই স্থানে একটি নারী থাকলে তার বাস্তবতা হয়ে দাঁড়াতো ঠিক উল্টোটা। একটা তুলনায় বিষয়টা খুব স্পষ্ট হয়ে যায়। ধরে নেয়া যাক, ঠিক একই রকম কাব্যপ্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে একটি নারী, শেকসপীয়রের মতই অল্প একটু আনুষ্ঠানিক শিক্ষা পেয়েছে এবং একই রকম পারিবারিক পরিবেশ থেকে সে বের হয়ে এসেছে।  উলফ দেখছিলেন মনের চোখে, মেয়েটি লুকিয়ে লিখছে আবার ফেলেও দিচ্ছে তার সৃষ্টিগুলোকে। কারণ সে সমাজে মেয়েদের লেখালেখির চল নেই। বয়স কুড়িতে আসতেই তাকে নরম গরম কোথায় ‘বাধ্য করে’ বিয়েতে রাজী করিয়ে ফেলা হচ্ছে। ভাগ্যগুণে সে ফাঁড়া কাটলোও হয়ত। একদিন সবার চোখ এড়িয়ে মেয়েটিও লেখক হবার প্রতিষ্ঠা পেতে অজানায় পা বাড়ায়, শেকসপিয়রেরই মত। এর পরের কাহিনী উলফের জবানীতে পড়ুন-

“অতএব তার নিজের প্রতিভাই তাকে অন্য পথে চালিত করে। সে তার যৎসামান্য সম্পত্তি পুঁটলিতে বেঁধে নিয়ে, এক গ্রীষ্মের রাতে দড়ি মেয়ে নিচে মেনে আসে আর লন্ডন রওনা হয়। ...... ভাইয়ের মত তারও ছিল শব্দ ও সংগীতের ব্যপারে চটজলদি প্রতিভা। ভাইয়ের মত তারও ছিল নাট্যবোধ। সেও তাই মঞ্চের দরজায় গিয়ে দাঁড়ায়, অভিনেত্রী হবার বাসনা পোষণ করে। মোটা, মুখপাতলা ম্যনেজারটা তাকে নিয়ে ফোঁড়ন কাটে। কুকুর ছানার নাচ ও মেয়েদের অভিনয় করা নিয়ে কী যেন একটা বিদ্রূপাত্নক অঙ্গভঙ্গি করে- কোন মেয়েরই, সে বলে, অভিনয় করার ক্ষমতা নেই। সে ইঙ্গিত করে- আপনারা জানেন কিসের। সে তার পছন্দের এই শিল্পে কোন শিক্ষা পায় না। সে কি কোন সরাইখানায় রাতের খাবার কিনতে কিংবা মধ্যরাতে রাস্তায় হাঁটতে পারতো? তবু তার প্রতিভা ছিলো সাহিত্যেই এবং সে ছিলো তরুণী ও তার মুখে ছিলো শেকসপিয়রের আদল, একই রকমের ধূসর চোখ ও জোড়া ভ্রু- অভিনেতা কাম ম্যানেজার নিক গ্রিন তার ওপর দয়াপরবশ হলেন এবং সে নিজেকে আনিষ্কার করল তার সন্তানের জননী হিসেবে- নারীদেহে আটকে পড়া কবিহৃদয়ের উত্তাপ ও আক্রোশ পরিমাপ করবে কে?- এবং এক শীতের রাতে আত্নহ... করে এখন সে শুয়ে আছে ক্যসল ও এলিফেন্ট এর মোড়ে, যেখানে বাসগুলো এসে থামে।”

একের পর এক নারী লেখকের জীবনেতিহাসের এদিক সেদিক তুলে এনেছেন লেখিকা। ধীরে ধীরে নারী লিখে অর্থ উপার্জনের পর্যায়ে এসে পৌঁছায়। তবে তার লেখার বিষয়বস্তু? সামাজিক উপন্যাস, জীবনীগ্রন্থ ইত্যাদির সীমানায়ই আবদ্ধ ছিলো নারীর বিচরণ। তারপরও প্রতিভার পাশাপাশি ব্যবসাবুদ্ধি না থাকায় অনেক মূল্যবান গ্রন্থের স্বত্ব নারীরা তুলে দিয়েছেন প্রকাশকের হাতে।

সবশেষে, ভার্জিনিয়া উলফ স্বপ্ন দেখেন, প্রতিটি সৃজনশীল নারী হৃদয়ের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা শেকসপিয়রের সে বোনটি জেগে উঠুক, যাকে সমাজ আত্নহ... ছাড়া আর কোন সম্মানের পথ বেছে দিতে পারেনি। “তবে আমার বিশ্বাস, এই কবি, যে কোনদিন একটি শব্দও লিখেনি এবং যে ঐ রাস্তার মোড়ে সমাহিত, সে এখনো বেঁচে আছে। সে বেঁচে আছে আমার আপনার মধ্যে, এবং আরও অনেক নারীর মধ্যে, যারা আজ রাতে এখানে নেই, কারণ তারা বাসন ধোয়া আর বাচ্চাদের ঘুম পাড়াতে ব্যস্ত। কিন্তু সে বেঁচে আছে, কারণ বড় কবিরা কখনও মরে না, তাদের উপস্থিতি এখনও সক্রিয়, তাদের শুধু আমাদের সামনে রক্ত-মাংসে হাঁটার সুযোগ করে দেওয়া দরকার। ... ...

আমাদের যদি স্বাধীনতার অভ্যাস এবং যা ভাবি হুবহু তাই লেখার সাহস থাকে, আমরা যদি যৌথ বসার ঘর থেকে পালিয়ে গিয়ে কিছুটা হলেও মানবসমাজকে দেখি, ... ... তাহলে সুযোগ আসবে এবং সেই মৃত কবি, শেকসপিয়রের বোন, পুনরায় শরীর ধারণ করবে, যে এতোদিন সমাহিত ছিলো। অজ্ঞাত পূর্বসূরীদের জীবন থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে পুনরায় জন্ম হবে তার।”

আমার পড়া আর শতটি গল্প-কাহিনীর বইয়ের চেয়ে অন্যরকম ভাষার আঘাতে ভার্জিনিয়া উলফ আমাকে জাগিয়ে দিয়েছেন। সভ্যতার একটি বিশেষ সময়ে এসে, যখন নারী আন্দোলন দৃশ্যমান একটি জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, আমি অনুভব করেছি তাঁর এই কথাগুলোর আবেদন একটুও কমে যায় নি, বরং পরিণত হয়েছে প্রাণের কথায়।  


 


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)