উইমেন (সামাজিক,মানসিক,সুবিধা বঞ্চিত নারী)

রোজীরা ভালো থাকুক

রোজীরা ভালো থাকুক
জানেন আপা, আমি শুধু একটু খেয়ে-পরে ছেলেকে নিয়ে একটা নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে চাই। আমার ছেলেটাকে নিয়েই আমার সব স্বপ্ন। কিন্তু ছেলেটা আমাকে রেখে রেখে খালি চলে যেতে চায়। ছেলের কথা বলতে গেলেই রোজীর দুই চোখ ভিজে যাচ্ছিল। রোজীর ছেলে ইয়াসিনের বয়স আর কতই বা হবে- দশ কি এগারো বছর। এ দুরন্ত ছেলেকে মানুষের মত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলাই রোজীর জীবনের চাওয়া। [caption id="attachment_3318" align="aligncenter" width="225"]রোজীর ছেলে ইয়াসিন রোজীর ছেলে ইয়াসিন[/caption]  রোজীর সাথে কথা হচ্ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। তিনি আশে-পাশেই যখন যেখানে পারেন জীবিকার তাগিদে ছোট-খাট কাজ জুটিয়ে লেগে পড়েন। যেখানে ঠাই হয় থাকেন। ঢাকায় কোন স্থায়ী আবাস নেই। রোজীর বাড়ি গোপালগঞ্জ। কথাবার্তায় কোন আঞ্চলিক টান না থাকায়- পড়ালেখা কতদূর করেছেন জিজ্ঞেস করায় তিনি জানালেন, ছোট বেলায় পড়ালেখায় ভালোই ছিলেন। কিন্তু বিয়ে হয়ে যাওয়ায় গ্রামের আর দশটা মেয়ের মত পড়ালেখার পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আর তাই এস এস সি এর পর আর পড়ালেখা করা সম্ভব হয়নি। বিয়ের পরে রোজীর কষ্টের জীবনের শুরু হয়। স্বামীর নির্যাতন সহ্য করে অনেক কষ্টে মুখ বুজে সংসার করেন। দুই মেয়ে ও এক ছেলের মা রোজী এখন স্বামীর বাড়িতে না থাকার কারণ জানতে চাইলে বলেন,           আমি যেখানে খাওয়াটাও ঠিক মত পাই না। উল্টো শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় সেখানে থেকে কি লাভ হবে। রোজী দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। মেয়ে জামাইরা রাগ করে তাই তিনি মেয়েদের বাসায় থাকেন না। রোজী তার বাবার বাড়িতে থাকতে পারেন। কিন্তু সেখানেও অভাবের সংসার। স্বামীর নির্যাতন না থাকলেও চাচাদের নির্যাতন সহ্য করতে হয়। তার মা মান-সম্মানের কথা ভেবে তাকে আশে-পাশের কোন বাড়িতে কাজ করতে দেন না। মায়ের পরামর্শেই ছেলেকে নিয়ে একটু ভালো ভাবে থাকার আশায় রোজী ঢাকায় চলে এসেছে।  তবে ঢাকায়ও খুব সুখে নেই। একটু নিরাপদে থাকার জায়গার খোঁজে ছেলেকে নিয়ে ঘুরে বেড়ান।  বলছিলেন, ছেলেটা থাকলে আশে পাশের পুরুষ মানুষরা একটু কম জালায়।  ছেলেকে ছাড়া কালকে কমলাপুর রেলস্টেশনে ছিলাম। অনেক ক্ষণ বসে ছিলাম। কিন্তু খুব ঘুম আসছিল তাই শেষে এক পাশে একটু জায়গা পেয়ে শুলাম। সাথে সাথেই এক লোক এসে পাশে শুয়ে পড়ায় বাধ্য হয়ে উঠে যেতে হয় আমাকে। তবে খানেক পরে এক কিনারে জায়গা পেয়েছিলাম। ওখানে দূর থেকে লোকেরা একটু আধটু খোঁচা দিলেও অন্য কোন ভাবে জালাতে পারে নাই। তাই ওখানে কিছুক্ষণ ঘুমাতে পেরেছিলাম। তবে একটু পরে স্টেশনের কর্মচারীরা এসে উঠিয়ে দেয়ায় উঠে পড়তেই হয়। তারপর আবার ছেলে ইয়াসিনের কথা বলতে যেয়ে কণ্ঠ জড়িয়ে আসলো রোজীর। তার ছেলে তাকে না বলে একা কিভাবে যেন বরিশাল চলে গিয়েছে। এতদিন কোন খোঁজ জানতেন না। হন্যে হয়ে সম্ভাব্য সব জায়গায় খুঁজেছেন। অবশেষে পথ শিশুদের নিয়ে কাজ করা একটি সংস্থা ছেলেকে খুঁজে বের করেছে। এখন লঞ্চে হয়তোবা রওনা হয়েছে- এ কথা বলতে বলতে ব্যাগ থেকে একটি খাতা বের করেন রোজী। খাতাটির তিন বা চার পৃষ্ঠা জুড়ে ছোট ছোট করে কয়েক জনের নাম ও মোবাইল নাম্বার লেখা। বিভিন্ন কাজ করতে যেয়ে নতুন পরিচিত হওয়া মানুষদের নাম্বার টুকে রাখেন তিনি এ খাতায়। একজনের নাম্বার দেখিয়ে বললেন, জানেন আপা, এনার সাথে পরিচিত হয়েছি ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের একটা অনুষ্ঠানে কাজ করবার সময়। খুব ভালো লোক- আমাদের খুব উপকার করতে চেয়েছিলেন। তারা আমাদের কিছু ছবিও তুলে দিয়েছিলেন। [caption id="attachment_3319" align="aligncenter" width="300"]ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ছেলের সাথে রোজী ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ছেলের সাথে রোজী[/caption] রোজী খাতা থেকেই পথ-শিশু সংগঠনের একজন সদস্যের মোবাইল নাম্বার দিয়ে বললেন তার ছেলের খোঁজ নিয়ে দিতে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ইয়াসিনকে পাওয়া গিয়েছে। পথ শিশু সংগঠনটির কিছু সদস্য ওকে নিয়ে লঞ্চে করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। ছেলে ফিরে আসছে শুনে রোজীর মুখে প্রশান্তির ছায়া নেমে আসলো। রোজীর স্বপ্নের জগত জুড়েই যে রয়েছে- ইয়াসিনের ভালো থাকা।  ইয়াসিন বর্তমানে পথ শিশু সংগঠনটির তত্ত্বাবধানে আছে। রোজীকেও  ঐ সংগঠন থেকে কাজ দেয়া হয়েছে। প্রতিদিনের সংগ্রামে রোজীরা সফল হতে পারে না, তবু লড়াই করে যায়, খড়কুটো খুঁজে। কিছু আলোকিত মানুষের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমেই হয়তো  রোজীদের ও তার সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গঠনের পথ সহজ হয়ে যায়।  এ পৃথিবী ভরে উঠুক আলোকিত মানুষে; ভালো থাকুক রোজীরা।

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
সম্পর্কিত ব্লগ