
তবে একজন মুসলিম নেতাকে জানতে হবে তার কর্মধারার অগ্রাধিকার। এটাও ইলমের অংশ. অতএব একজন দা'য়ী অর্থাত দ্বীন প্রচারকারীকে সবার আগে জানতে হবে দাওয়াতের কর্মধারা কি. আমরা যদি রাসূলের (স:) মক্কী জীবন দেখি, ইসলাম প্রচারের শুরুটা দেখি, তাহলে দেখতে পাব যে, তাওহীদের বাণী দিয়েই সর্বপ্রথম ইসলামের দিকে আহবান জানানো শুরু হয়. বলা হয় 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ', "আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই ". কুরাইশদের মাতৃভাষা আরবিতেই বলা হয়েছে তাওহীদের কথা. এ কথার অর্থ অমুসলিম কুরাইশরা ভাল করেই বুঝেছিল। তারা জানত যে 'উলুহিয়াত' শব্দের অর্থ হচ্ছে সার্বভৌম শক্তি এবং তারা এটাও বুঝতো যে, সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহর প্রতি আরোপ করার পরিনতি স্বরূপ পুরোহিত, গোত্রীয় সরদার এবং ধনী শাসকদের নিকট থেকে সকল কর্তৃত্ব ছিনিয়ে তা আল্লাহর নিকট অর্পণ করা হবে, আর এর বাস্তব পরিনতি হবে এই যে, মানুষের চিন্তা-ভাবনায়, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে, সম্পদ বন্টন ও বিচারনুষ্ঠানে এবং জাতীয় জীবনের অন্যান্য কর্মক্ষেত্রে; সংক্ষেপে মানুষের আত্মা ও দেহে একমাত্র আল্লাহ তাআলারই কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। তারা জানতো যে আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ না থাকার ঘোষণা সমাজে প্রতিষ্ঠিত সকল কর্তৃত্ব-এর বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ বিশেষ।
এখন প্রশ্ন হলো দ্বীনের দাওয়াত এভাবে শুরু হলো কেন? কেনই বা আল্লাহ তাআলা তাঁর দ্বীনের এ বাণীকে প্রাথমিক স্তরেই পরীক্ষায় নিক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত করেছিলেন।
জাতীয়তাবাদ ও দ্বীনের দাওয়াত:
নব্যুওতের প্রাক্কালে আরবদের ভূমি ও সম্পদ তাদের নিজেদের হাতে ছিল না. উত্তরাঞ্চলে সিরিয়া রোমানদের দখলে ছিল. অনুরূপভাবে দক্ষিণাঞ্চলে ইয়ামন ছিল পারস্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। স্থানীয় আরবগণ পারস্য রাজ্যের অধীনতা স্বীকার করে ওই অঞ্চল শাসন করছিল। শুধুমাত্র হিজায, তিহামা, এবং নজদ এলাকায় আরবদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিল, কিন্তু ওই এলাকাগুলো ছিল নিছক মরুভূমি। রাসুল (স:) মক্কায় আল আমিন এবং আস সাদিক (বিশ্বস্ত এবং সত্যবাদী) হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন, তিনি হিলফুল ফুযুলের ঘটনাটি মিমাংসা করেছিলেন। তিনি শতধা বিচ্ছিন্ন আরবদের ভাষাভিত্তিক ঐক্যের আহবানে একত্রিত করে রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যের দখলকৃত আরব ভূমি উদ্ধার করতে পারতেন এবং একটি সম্মিলিত আরব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা তাঁর পক্ষে কিছুমাত্র কঠিন ছিল না.
রাসূল (স:) তের বছর যাবত অমানুষিক অত্যাচার সহ্য করে প্রবল বিরোধিতার মুখে দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার পরিবর্তে জাতীয়তাবাদের আহবানে খুব সহজেই জনগনের সমর্থন লাভ করতে পারতেন এবং সমগ্র আরবের উপর তাঁর নেতৃত্ব স্বীকৃতি লাভ করতো।
একথাও বলা যেতে পারে যে, এভাবে তাঁর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের অধীনে সমগ্র আরব ভূমিকে ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত করে নেয়ার পর তিনি জনগনকে আল্লাহ তাআলার একত্বের প্রতি ঈমান আনয়নের জন্যে প্রস্তুত করতে পারতেন এবং তাঁর নিজের কর্তৃত্ব মেনে নেয়ার পর তারা সহজেই তাঁর উপদেশ ও শিক্ষানুসারে তাদের প্রতিপালক আল্লাহতাআলাকে মেনে নিতেও হতো.
কিন্তু সকল জ্ঞানের আধার ও সকল বিষয়ে বিজ্ঞ আল্লাহতাআলা তাঁর নবীকে ওই পথ ধরে চলতে দেননি। বরং তাঁকে তিনি প্রকাশ্য ঘোষণার মাধ্যমে আল্লাহ ব্যতীত অপর সকলের কর্তৃত্ব অস্বীকার করার নির্দেশ দেন ও স্বয়ং আল্লাহর রাসূল ও তাঁর স্বল্প সংখ্যক অনুচরদের ধৈর্য সহকারে তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হতে নির্দেশ দেন.
প্রশ্ন হচ্ছে এসব কেন? রাসূলুল্লাহ (স:) ও তাঁর প্রিয় সাহাবিগণকে অযথা নির্যাতনের শিকারে পরিনত করা হয়নি। তিনি জানতেন যে, অন্য কোন উপায়ে উদ্দেশ্য সফল হতে পারে না. রোম ও পারস্যের নির্যাতন থেকে আরব ভূমিকে মুক্ত করে সে স্থলে আরবি নির্যাতনই প্রবর্তন করা এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল না. দেশী-বিদেশী সকল নির্যাতনই এক ও অভিন্ন।
অর্থনৈতিক বিপ্লব ও দ্বীনের বাণী:
রাসূল (স:) এর নব্যুওয়াত প্রাপ্তির সময় আরব দেশে সুষম সম্পদ বন্টনের কোন উপায় ছিল না. তাই সে দেশে সুবিচারও ছিল অনুপস্থিত। ধনী দেরকেই সম্ভ্রান্ত ও শ্রেষ্ঠ বিবেচনা করা হতো এবং সাধারণ মানুষ শুধু ধন-সম্পদ থেকেই বঞ্চিত ছিল না, উপরন্তু তাদের মানবীয় মর্যাদাই সে সমাজে স্বীকৃত ছিল না. এটা সকলেই স্বীকার করবেন মুহম্মদ (স:) একটি সামাজিক বিপ্লব শুরু করলে যার মাধ্যমে ধনীদের সম্পদ ছিনিয়ে নিয়ে দরিদ্রদের মধ্যে বন্টন করা হতো, তাহলে আরব সমাজ দুভাগে বিভক্ত হয়ে যেত এবং বিপুল সংখ্যক জনগণ ওই আন্দোলনে অংশগ্রহন করত. নবী করিম (স:) নিজে ক্ষমতায় গিয়ে ধনীদের সম্পদ কুক্ষিগত করে গরিবের মাঝে বিলিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু সর্বজ্ঞ ও নির্ভুল জ্ঞানের অধিকারী আল্লাহ তাআলা তাঁরই প্রিয় নবীকে এ পথেও পরিচালিত করেননি। আল্লাহতাআলা ভালো করেই জানেন যে, একমাত্র আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ-এর মাধ্যমেই সত্যিকার সামাজিক সুবিচার আসতে পারে। গোটা সমাজকে আল্লাহ প্রদত্ত ইনসাফপূর্ণ বন্টননীতি মেনে নেয়ার জন্যে প্রস্তুত হতে হবে.
নৈতিক সংগঠনের মাধ্যমে আন্দোলনের সূচনা:
রাসূল(স:) যে যুগে তাঁর দাওয়াতি কাজ শুরু করেন, সে যুগে আরব দেশ নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে নিম্নতম স্তরে পৌঁছে গিয়েছিল। অত্যাচার নির্যাতন ছিল ওই সমাজের নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। বিখ্যাত কবি জুহাইর ইবনে আবী সালমা বর্ণনা করেছেন:
"যে সশস্ত্র হয়ে আত্মরক্ষা করবে না, মৃত্যুই তার অনিবার্য পরিনতি।"
"আর যে অত্যাচার করবে না, সে অবশ্যই অত্যাচারিত হবে. "
"অত্যাচারী হোক কিংবা "অত্যাচারিত- সকল অবস্থাতেই তোমার ভাইয়ের সাহায্য কর. মদ ও জুয়া সামাজিক প্রথার মধ্যে শামিল ছিল এবং এসব অভ্যাস নিয়ে মানুষ গর্ব করতো। সে যুগের সকল কবিতাই মদ ও জুয়াকেই কেন্দ্র করে রচিত হতো. সে সমাজের সকল জায়গায় বিভিন্ন ধরনের ব্যভিচার প্রচলিত ছিল.
হজরত মুহম্মদ (স:) চারিত্রিক মানোন্নয়ন, সমাজ শুদ্ধিকরণ ও আত্মশুদ্ধির কর্মসূচি নিয়ে নৈতিক সংস্কারের একটি আন্দোলনও শুরু করতে পারতেন। সহজেই বলা যেতে পারে, এ ধরনের আন্দোলন শুরু করলে আল্লাহর রাসুল(স:) বেশ কিছু লোক জমাতে পারতেন। এ লোকগুলো উন্নত নৈতিক মানের দরুন সহজেই তাওহীদের বাণী গ্রহন ও পরবর্তী দায়িত্ব পালনের জন্যে প্রস্তুত হত এবং এ এ কাজ করলে এ "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ"র বাণী ততটা তীব্র বিরোধিতার মুকাবিলা করতো না. কিন্তু সর্বজ্ঞ আল্লাহ ভালোভাবেই জানতেন যে, এটা সঠিক পথ নয়. তিনি জানতেন যে, একমাত্র ঈমানের ভিত্তিতেই নৈতিকতা গঠিত হয়. ঈমানই ভালমন্দের মানদন্ড ও নৈতিক মূল্যবোধ নির্ধারণ করে এবং এ মানদন্ডের উতসমূল স্বরূপ এক উচ্চতম কর্তৃত্বের সন্ধান বাতলে দেয়.
সর্বাত্মক বিপ্লব:
কঠোর পরিশ্রমের পর ঈমান যখন সুদৃঢ় হলো, যে মনিবের প্রতি ঈমান আনা হয়েছিল, বাস্তব কার্যকলাপের ভিতর দিয়ে যখন তাঁর প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ পেল; মানুষ যখন তাদের সত্যিকার স্রষ্টা - মনিব ও প্রতিপালককে চিনতে পেরে একমাত্র তাঁরই প্রশংসা করতে শুরু করলো, যখন তারা সকল বিষয়ে অন্যের এমন কি নিজের কামনা-বাসনার প্রভাব থেকে মুক্তি লাভ করলো; আর যখন কালেমায়ে "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু" তাদের অন্তরে খোদিত হয়ে গেল, তখনই আল্লাহতাআলা তাদের সকল বিষয়ে সাহায্য দান করলেন। আল্লাহর জমিন রোম ও পারস্যের অধীনতা থেকে মুক্ত হলো কিন্তু এ মুক্তি অনারবদের প্রভুত্বের স্থলে আরবদের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যে নয়, বরং আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য।
ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার ফলে সকল প্রকার জুলুম-নির্যাতনের অবসান ঘটে. আল্লাহ তালআলার নির্ধারিত মানদন্ডে ওজন করে সম্পুর্ণ নিরপেক্ষ ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়. আল্লাহর নামেই ন্যায়বিচারের ঝান্ডা উঁচু , যাতে কেবল 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ' ব্যতীত আর কিছুই লেখা হয়নি।
চরিত্র উন্নত হলো, হৃদয় ও মন বিশুদ্ধ হলো এবং এর ফলে কিছু সংখ্যক ঘটনা বাদে কোথাও আল্লাহতাআলার নির্ধারিত চরম দন্ড দানের প্রয়োজন দেখা দিল না. কারণ, ওই সময়ে মানুষের বিবেক নিজে নিজেই আইন মেনে চলতে উত্সাহী হয়ে উঠে. পুলিশ ও আদালতের পরিবর্তে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, তাঁর কাছ থেকে পুরস্কার প্রাপ্তির আশা ও তাঁর ক্রোধভাজন হওয়ার ভীতি মানুষের অন্তরে স্থান লাভ করে.
মানব গোষ্ঠী এক কলুষমুক্ত সমাজ ব্যবস্থায় নৈতিক মান ও জীবনের অন্যান্য মূল্যবোধের ক্ষেত্রে সমুচ্চ দিগন্তে উন্নত হয়. ইতিপূর্বে মানবগোষ্ঠী কখনোও এতো উচ্চ পর্যায়ের জীবনযাত্রা লাভ করেনি এবং পরবর্তীকালে ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন উপায়ে ওই পর্যায়ের উন্নতি সম্ভব হয়নি।[২]
সুত্র:
১. রাসুলুলাহ (স:) এর শিক্ষাদান পদ্ধতি - ড: মুহাম্মদ আবদুল মাবুদ
২. ইসলামী সমাজ বিপ্লবের ধারা - সাইয়েদ কুতুব শহীদ
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)