ধর্ম ও গবেষনা
রমজানঃ মাগফেরাতের আহ্ববান

পবিত্র রমজান হচ্ছে এমন এক মাস যে মাসে নাজিল হয়েছিল সর্বকালের সেরা ও পরিপূর্ণ বিধি-বিধান সম্বলিত আসমানি ধর্মগ্রন্থ কুরআন। শুধু তাই নয় এ মাসের তৃতীয় রমজানে হযরত ইব্রাহিম (আ.)’র কাছে নাজিল হয়েছিল মহান আল্লাহর বাণীর মহাগ্রন্থ বা সহিফা। এ মাসেই হযরত মুসা, দাউদ ও ঈসা (আ.)’র কাছে নাজিল হয়েছিল যথাক্রমে আসমানি মহাগ্রন্থ তাওরাত, জাবুর ও ইঞ্জিল।
বিশ্বনবী (সা.)’র পবিত্র হাদিস অনুযায়ী সবচেয়ে জরুরি ও শ্রেষ্ঠ জ্ঞান হল মহান আল্লাহর পরিচিতি অর্জন বা আল্লাহকে জানা। প্রত্যেক মানুষের মূল্য নির্ভর করে এ বিষয়টির ওপর। যে যত বেশি আল্লাহকে জানেন তার অস্তিত্ব তত বেশি আলোকিত বা নুরানি হয়। আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি জানতেন বিশ্বনবী (সা.)। আর এ জন্যই তিনি ছিলেন সবচেয়ে বড় বা সর্বকালে সর্বশ্রেষ্ঠ খোদা-প্রেমিক ও খোদাভীরু। তবে আল্লাহর সত্ত্বার পরিচয় সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। বিশ্বনবী (সা.)ও তা জানতে পারেননি। আল্লাহর সত্ত্বাকে মানুষ কখনও, এমনকি পরকালেও জানতে পারবে না। নবী-রাসূল, ইমাম ও আওলিয়ার মত বড় মাপের মানুষের পক্ষে যা জানা সম্ভব হয়েছে তা হল কেবলই আল্লাহর গুণবাচক পরিচিতি। দোয়ায়ে জুউশান কাবির নামক বিখ্যাত দোয়ায় উল্লেখিত হয়েছে মহান আল্লাহর এক হাজারটি গুণবাচক নাম। এ যেন হাজারো চোখ বা চশমা দিয়ে আল্লাহর হাজারো রূপকে দেখা। বলা হয় আল্লাহর গুণবাচক আরো অনেক নাম রয়েছে যা আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত মানুষরা জানতে পারেন মৃত্যু-পরবর্তী জগত বা আলমে বারজাখে।
আমরা যে নবী-রাসূল ও ইমামগণকে উচ্চতর মর্যাদা দানের জন্য যেসব দোয়া-দরুদ ও সালাম পাঠাই আল্লাহর দরবারে তার তাৎপর্য হলো এটাই। অর্থাৎ মহাপুরুষরা পরকালীন জগতেও আল্লাহকে আরো ভালোভাবে জানতে থাকবেন এবং এর ফলে তাঁদের মর্যাদাও বাড়তে থাকবে।
আল্লাহর পরিচিতি তথা গুণবাচক নাম সম্পর্কে জানার জন্য মানুষকেই উদ্যোগী হতে হবে। আল্লাহ কেবল তাদের কাছেই নিজের পরিচিতির জ্ঞান দান করেন যারা এ বিষয়ে গভীরভাবে আগ্রহী ও এ বিষয়ে প্রাণপণ চেষ্টা সাধনা করেন। জাগতিক ক্ষেত্রেও আমরা দেখি যে, আপনি যদি কারো পরিচয় জানার জন্য আগ্রহ দেখান, আর সেই ব্যক্তি যদি আপনাকে পছন্দ না করেন তাহলে তিনি তার বংশ, নাম ও পরিবারের খোঁজ-খবর আপনাকে জানাবেন না, বরং এসব বিষয়ে আপনার কৌতূহলকে ফাজলামি বা বাড়াবাড়ি বলেই মনে করবেন। কিন্তু ওই ব্যক্তি যখন বুঝবেন যে আপনি সত্যিই তাকে ভালবাসেন ও গভীরভাবে শ্রদ্ধা করেন তাহলে তিনি তার পরিচিতি আপনার কাছে ধীরে ধীরে প্রকাশ করতে বাধ্য হবেন। অন্য কথায় আল্লাহর মারেফাত অর্জনের জন্য বান্দাকেই এগিয়ে আসতে হবে। আল্লাহ নিজে এ বিষয়ে বা এক্ষেত্রে অনাগ্রহী বান্দার দিকে এগিয়ে আসবেন না।
মোট কথা যে ব্যক্তি যত বেশি আল্লাহকে চিনবেন তিনি বেহেশতে ততই উচ্চ মর্যাদা বা উচ্চ শ্রেণী লাভ করবেন। আমরা বেহেশতের আকাঙ্ক্ষা করি। অথচ কোনো কোনো বেহেশতি আল্লাহর কাছে এতো প্রিয় ও উচ্চ মর্যাদা-সম্পন্ন যে বেহেশতই তাদেরকে পাওয়ার জন্য আগ থেকেই ব্যাকুল আকাঙ্ক্ষার কথা ব্যক্ত করে বলবে: কবে তারা এখানে এসে বেহেশতকে ধন্য করবেন! আর তো অপেক্ষা সহ্য হচ্ছে না! বিশ্বনবী (সা.) ও তার পবিত্র আহলে বাইতগণ ছিলেন এমনই ব্যক্তিত্ব যাদের জন্য বেহেশত অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। মহানবী সালমান ফার্সি সম্পর্কেও বলেছেন, বেহেশত তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে! আমরা যখন এমন ব্যক্তিত্বদের জন্য দরুদ পাঠাই তখন তাঁদের মর্যাদা ও উচ্চ অবস্থান যেমন বাড়তে থাকে তেমনি তা আমাদের জন্যও অফুরন্ত কল্যাণ বয়ে আনে। তাইতো দয়ার নবী (সা.) বলেছেন: যে রমজান মাসে আমার ওপর সালাওয়াত বা দরুদ পাঠাবে আল্লাহ বিচার দিবসে তার ভাল কাজের পাল্লা ভারী করে দেবেন, অথচ অন্যদের পাল্লা হাল্কা থাকবে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন: নিশ্চয়ই আল্লাহ ও ফেরেশতাগণ দরুদ পাঠান নবীর (বিশ্বনবী-সা.)ওপর, হে ঈমানদারগণ, তোমরাও তাঁর ওপর দরুদ ও সালাম পাঠাও।
সৎকাজ, দান-খয়রাত, দরুদ ও কুরআন তিলাওয়াত ইত্যাদি আমাদের মৃত মা-বাবার জন্যও কল্যাণ বয়ে আনে। সন্তানের সৎকর্মের সাওয়াব বাবা-মাও সাদকায়ে জারিয়া হিসেবে পেতে থাকেন। তাই রমজানের দিনে আমাদের উচিত মৃত কিংবা অসুস্থ প্রিয়জনদের কথা ভেবে আমরা যেন বেশি বেশি সৎকর্ম করি। এমন পবিত্র মাসে মৃত ও অসুস্থদের নামে সাদকা দেয়া উচিত ।
আল্লাহর পরিচিতি বা আল্লাহকে জানার একটা বড় উপায় হচ্ছে তার নিদর্শনগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করা। মানুষ নিজেই হচ্ছে আল্লাহর এক বড় নিদর্শন। মানুষের মধ্যেই রয়েছে এমন অনেক বিস্ময়কর ও রহস্যময় বিষয় যে তার অনেক কিছুই এখনও বিজ্ঞানীরা জানতে পারেননি। এ জন্যই বলা হয়েছে: মান আরাফা নাফসাহু ফাক্বাদ আরাফা রাব্বাহু। অর্থাৎ যে নিজেকে চিনেছে সে আল্লাহকেও চিনেছে।
বড় বড় ব্যক্তিত্ব তথা নবী-রাসূল, ইমাম ও আওলিয়া আল্লাহকে চিনেছেন ও জেনেছেন অন্তরের চোখ দিয়ে প্রত্যক্ষ-করা জ্ঞান তথা ইলমে শুহুদ বা ইলমে লাদুন্নির মাধ্যমে। সে ধরনের জ্ঞান অর্জনের জন্য যোগ্যতার দরকার রয়েছে এবং মহান আল্লাহর কাছেও সে বিষয়ে আকুল হয়ে আবেদন জানাতে হবে। আর এ ধরনের জ্ঞান কেবল পবিত্র অন্তরের অধিকারীরাই অর্জন করতে পারে। যার মনে দুনিয়ার হাজারও কলুষিত চিন্তা প্রতিনিয়ত ঘুরপাক খায় সেই অস্বচ্ছ ও হিজাবযুক্ত অন্তরে এমন উচ্চতর জ্ঞান বা হিকমত কখনও আসতে পারে না।
বিশ্বনবী (সা.) এক বৃদ্ধা নারীর মুখে আল্লাহর জিকির শুনে তাকে প্রশ্ন করেন, আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে কিভাবে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন?
এ সময় চরকায় সুতো উৎপাদনরত সেই বৃদ্ধা চরকার ওপর থেকে হাত সরিয়ে নেয়ায় চরকা থেমে যায়। এরপর বৃদ্ধা বলেন, এই চরকাটির চাকা যদি কারো হাতের ধাক্কা বা সাহায্য ছাড়া চলতে না পারে তাহলে এই বিশ্বজগত এবং দিন ও রাতের আবর্তন বা পরিচালনা কিভাবে একজন স্রস্টা ছাড়া ঘটতে পারে? বিশ্বনবী বললেন, প্রত্যেক মুসলমানের অন্তত: এতটুকু মাত্রায় আল্লাহর পরিচিতি সম্পর্কে জ্ঞান ও ঈমান থাকা উচিত।
আইআরআইবি.কম থেকে।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)