উইমেন (সামাজিক,মানসিক,সুবিধা বঞ্চিত নারী)
জনাব হানিফ সংকেত, এই প্রথম আপনাকে সমর্থন করতে পারলাম না!

সূত্রপাত...
এপ্রিল মাস, ২০১৩। আম্মু নাই বাসায়, আমিই আম্মুর বাসার দায়িত্ব পালনের অভিনয় করে যাচ্ছি। পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ, হিউম্যন রিসোর্স ম্যনেজমেন্ট। নতুন এক সাহায্যকারী আসলো গ্রামের এক আত্নীয়ের চেষ্টায়। মেয়েটার মায়াভরা চেহারা দেখেও মায়া হল না, চাঁছাছোলা ভুরু দেখে। কিছুদিন থাকার পর একদিন বেচারী উসখুস করে বলেই ফেললো,
-আপা আপনাদের বাসায় টিভিতে ইশটার জলসা আসে না?
-জানিনা তো, কেন?
-আপনারা সিরিয়াল দ্যখেন না?
-নাহ। তুমি দেখতা?
-জি। আগের বাসায় আমাদের সাদাকালো টিভি আর খালাম্মার এলছিডি ছিলো
-ও। তুমি হিন্দী বুঝ? আমি তো বুঝি না। এজন্য দেখে মজা লাগে না।
-না আপা, ইশটার জলসায় তো বাংলায় সিরিয়াল হয়।
অতঃপর একদিন ওকে নিয়ে সিরিয়াল দেখলাম এক পর্ব। ‘থ্রী স্টুজেস’ দেখেও এতো হাস্যকর লাগে নাই, আর ‘গড অফ কুকারীজ’ দেখেও এতো বিরক্ত হই নাই! বাসার মধ্যেই সারা শরীর ভর্তি গয়না পরে মহিলাগুলো এইভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আর এক একজনের মুখ কত যে এঙ্গেল থেকে দেখলাম, আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। মজার কথা হল, সেটা দেখেছিলাম, তাতে মা আর মেয়ে ছিলো যে দুই মহিলা, মাঝের বিরতিতে আরেক সিরিয়ালের বিজ্ঞাপন দেখলাম, সেখানে এই দুই মহিলা কলেজের বান্ধবী, একই নায়কের পেছনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন!
তবে সত্যি কথা, এই শাড়ি গয়নার আধিক্য, সম্পর্কের কূটকচালী আর সুন্দর চেহারাগুলোর এক ধরণের আকর্ষণ আছে। অন্য কাজ না থাকলে হয়ত বসে থাকতাম আর কিছুক্ষণ।
মাথায় কত ভাবনা আসে...
সীমান্তের নানা ঘটনা বা পারিবারিক ভাঙ্গনের ভুক্তভোগী বাংলাদেশীরা কিছুদিন পরপরই ‘ভারতীয় পণ্য’ বর্জনের ডাক দেয়। সাথেসাথেই আমাদের মনে পড়ে যায় আমাদের ঘরগুলোতে অবিরাম চলতে থাকা সিরিয়াল (কিলার) গুলোর কথা। আর আমরা কোমর বেঁধে নেমে পড়ি সিরিয়ালের একনিষ্ঠ দর্শক রমণীকুলের পিন্ডি চটকাতে। কয়েকদিন পর সে কে সে-ই। গোল্ডফিসের মত আবার নিজের গর্তে ফিরে আসি আর ভুলে যাই সিরিয়ালগুলো আমাদের কোত্থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, গানের সেই পাগলা ঘোড়ার মত।
কিছুদিন আগে পছন্দের পরিচালক হানিফ সংকেত তাঁর ব্জনপ্রিয় ম্যগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদী’তেও এ নিয়ে বেশ ভালো ব্যঙ্গ করেছেন। হানিফ সংকেতের যে গুণটা আমাকে মুগ্ধ করে, তা হোল, যে কোন সমস্যার গোড়ায় পৌঁছে যাওয়া। কিন্তু এই ব্যপারে উনিও আর দশজনের মত ‘মেয়েদের হাত থেকে রিমোট নেয়ার দুরূহতা’ বুঝিয়ে বিদায় নিয়েছেন। ক্ষুধার্ত সিংহের মুখ থেকে শিকার ছিনিয়ে নেয়ার সাথে রমণীকুলের রিমোটপ্রীতির তুলনা দেখে আমাদের গোল্ডফিস মেমোরী ঝলসে উঠেছে আরেকবার। সোশাল মিডিয়ায় ছি ছি পড়ে গেছে। মেয়েরা এতো খারাপ? সংসার সন্তান ফেলে শুধুই সিরিয়াল দেখে? বিবেকবান ফেসবুকাররা হরেক স্বাদের স্ট্যটাস দিয়েছেন, রঙ্গীন মেমে আপলোড করেছেন, অতঃপর বিষয়টা আবার হিমাগারে।
তো?...
খুব কাছের একজন মানুষ, একদিন অফিস থেকে এসে বললেন,
-জানো আমি তাড়াতাড়ি (অফিস টাইম শেষ হবার সাথে সাথে!) বাসায় আসতে চাই দেখে ‘অমুক’ ভাই কি বলেছেন?
-কি?
-উনি নাকি নয়টার সময় আস্তে আস্তে ভাবতে থাকেন এবার উঠা দরকার। আমরা জিগেস করলাম, ঘরে কিচ্ছু বলে না? উনি বললেন, কি বলবে? একটা ফুল টাইম ড্রাইভার দিয়ে অন্য গাড়িটা বাসায় দিয়ে রেখেছি। যেখানে ইচ্ছা যায়। সব চলছে ঠিকমত।
-ও।
-ভাবী কিন্তু ঢাকা ভার্সিটি থেকে পাশ করা।
-ও।
-কি হইলো?
-না মানে, যে মানুষটা একখানা গাড়ি আর ড্রাইভারকে নিজের বিকল্প ভাবেন, উনি রাতেই বা কেন বাসায় যান???
আমার কাছের মানুষটা, মাত্রই বিয়ে করেছেন তখন, খুব করে ভাবতে বসলেন, তাইতো! বেশ কিছুক্ষণ চোখ ট্যরা করে কি ভাবলেন কে জানে!
এই যে আপনি পুরুষ মানুষ, একটু ভাবেন দেখি? আপনার জীবনে কি জিনিসকে গুরুত্ব দিয়েছেন? তাতে কিছু আবার হারিয়ে বসেননি তো? ভালোবাসার মানুষটিকে কি দিয়ে খুশী করতে চেয়েছেন? একবারে প্রথম থেকে? আপনাকে কাছে পেয়ে খুশী হতে দেখে মুগ্ধ হয়েছেন? নাকি আপনার আনা খুব দামী উপহারটা দেখে চপল খুশীতে নেচে উঠা দেখে প্রেমে পড়েছিলেন? কোনটা? নতুন জীবনসঙ্গীকে কি দিয়ে ইমপ্রেস করতে চেয়েছিলেন? হ্যলভেশিয়ায় নিয়ে? নাকি গভীর রাতে রাস্তার পাশে চা অলার থেকে চা আর গোল বিস্কুট খেয়ে তাঁকে বুঝতে চেয়েছেন? বাংলাদেশে এখনও এমন মেয়ে আছে জানেন? স্টারের ডিনারের চেয়ে জাকির হোসেন রোডের বেহারী দোকানের রুটি-কাবাব আর মোড়ের চায়ের দোকানের চা ‘আপনার সাথে’ খেতে চায়।তবে...
এই একই মেয়েটি আমূল বদলে যেতে পারে যদি তার অনুভুতিগুলোকে আপনি অন্য তারে বেঁধে দেন, শুরু থেকেই বস্তুগত ভালোবাসার স্কেলে মাপতে থাকেন আপনাদের সম্পর্ককে।
বুঝলাম। এর সাথে হানিফ সংকেতের কি?
আমাদের দেশের মেয়েদের জীবনচক্রটা একবার ভাবেন তো! শহর বা মফস্বলের মেয়েদের মোটামুটি একই রকম। ব্যতিক্রমগুলোর কথায় পরে আসি। পড়ালেখা-সাজুগুজু-এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটির মধ্যে নাচ শেখা, গান শেখা- এসএসসি- এইচএসসি- কলেজ/ভার্সিটি- বান্ধবীদের সাথে আড্ডা- একদিন চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে বান্ধবীদের কাঁদিয়ে শশুরবাড়ি গমন- সংসার- জামাই- বাচ্চা- কপালে থাকলে পড়ালেখা শেষ করা- আরও ভালো কপাল থাকলে চাকুরী- বাচ্চা রাখার কেউ না থাকলে বা কষ্টসহিষ্ণু না হলে চাকুরী ছেড়ে ঘরেই থিতু হওয়া... এই তো?
আপনি মহাব্যস্ত কর্মক্ষম পুরুষ মানুষ। হয়ত ব্যবসায়ী, হয়ত চাকুরে কিংবা আর্মিতে আছেন। ঘরে সময় দিতে পারেন না তেমন। এজন্য লেখাপড়া জানা স্ত্রীকে হাতের তালু আর পাঁচ আঙ্গুল সোজা করে দেখিয়ে থামিয়ে দিলেন, জানিয়ে দিলেন ‘তোমাকে চাকুরী করতে দেবো না’। খুব ভালো। যোগ্য পুরুষের কাজ করেছেন। কিন্তু আপনার স্ত্রীর শিক্ষিত মনটি কি তার যথাযোগ্য খাবার পাচ্ছে কি না খেয়াল করেছেন কখনো? উনি সারাদিন কি করেন? কিভাবে কাটান? বাচ্চা ‘মানুষ’ করার কাজটি উনার একারই কি না, উনি সারাদিন সেই ঘানি টানবেন! আর আপনি অফিস থেকে ফিরে আপনার পরিবারবর্গকে কৃতার্থ করেছেন এমন ভাব নিয়ে রিমোট বা পত্রিকা নিয়ে বসে যাবেন। আর যদি এর মধ্যে বন্ধুদের ডাক আসে তাহলে তো কথা-ই নাই। ভোঁ-দৌড়। এসে দুটো খেয়ে উদ্ধার করে ঘুম। আর না হয় রাত করে ফেরা।
একটা সত্য কথা বলে রাখি। একটা বাচ্চার জীবনের প্রথম দুই বছর কেটে গেলে তার ভবিষ্যত আত্নমর্যাদাবোধ এবং স্বনির্ভরতার জন্যই কিন্তু মায়ের কাছ থেকে তাকে কিছুটা পৃথক করে দিতে হয়। মায়ের নিজের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দিলে তিনিও জীবনের সব অপূর্ণতার জন্য বাচ্চাকে দায়ী না করে তার প্রতি যত্নবান হতে পারেন। এটা দুজনের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যই ভালো। কিন্তু এতো হিসাবের সময় কোথায় আপনার? এগুলো তো জানেনই না। বউ জোর করে এরকম কোন লেখা পড়ালেও অদৃশ্য (আসলে দৃশ্যমান!) হাতের হেলনে আপনি ভুলে যেতে পারেন, না?
আপনার স্ত্রীর কথা ভাবেন না একবার? পারবেন একদিন তার জীবনটা আপনি কাটাতে? পারবেন আপনার ভেতরে লুকিয়ে থাকা ক্যম্পাসের চঞ্চল তরুণটিকে চার দেয়ালের মাঝে আটকে দিতে? তাহলে একটি তরুণীকে কেন এই জীবনে ঠেলে দিয়েছেন?
এখানে একটা কথা বলি। অনেক মেয়ে ডাক্তার হয়েও অলসতায় বা অন্য কোন কারণে প্রফেশনে যেতে চায় না। আমি তাদের আলোচনার বাইরে রাখতে চাই না। আচ্ছা, হতে পারে, সে বাইরের পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারেনি বা আপনার বাচ্চাদের জন্ম আর অন্য কারণে পড়ালেখা শেষ করতে পারেনি। আপনি কি তার মনের জন্য কোন খাবারের ব্যবস্থা করেছেন? নাকি ‘ফুলটাইম ড্রাইভার আর একটা গাড়ি’? বেচারী দিন শেষে কি দিয়ে তার না পাওয়ার ঝুলি ভরবে?
আর যারা ব্যতিক্রম? পড়ালেখা শেষ করে চাকুরী করছেন, কিন্তু বাসায় এসে বুয়ার হাতে সব ছেড়ে দিয়ে টিভি ছেড়ে বসেছেন? তাদের এই আসক্তির কারণ কি? আপনার কর্মক্লান্ত স্ত্রীকে নিয়ে কখনো ফুটপাথের চা খেয়েছেন ভাই? কখনো তার পছন্দের কোন খাবার রান্না করে অবাক করে দিয়েছেন? দাঁড়ান, ভাবতে বসে যাবেন না যেন। কেন আপনাকেই সব শুরুর কাজ করতে হবে? কারণ ত্যগের শুরুটা আপনার স্ত্রীই করেছেন। অপরিচিত/ অর্ধপরিচিত/ পূর্বপরিচিত আপনার হাত ধরে আপনার ঘরে জায়গা করে নিতে এসেছেন। হতে পারে এই ঘর তার ঘরের পাশেই। হতে পারে অজ কোন গ্রামে মাত্র কয়েকদিনের জন্য। তবুও তো! ফ্রেঞ্চ/ জার্মান মেয়েদের মত বিয়ের আগে আপনার সাজানো বাসা দেখে বিয়েতে মত দেন নাই।
হুমম...
এই মেয়েটাই যখন রিমোটটা হাতে নিয়ে তার না পাওয়ার যন্ত্রণা বা আপনার অবহেলা ভুলতে চাইবে তখন আমি তাকে অনেক দোষ দিতে চাই না। এটা ঠিক, যে একসময় নেশা ধরে গিয়ে সে তার অনেক অবশ্য করণীয়কেও ভুলতে শুরু করে, এটা অন্যায়। কিন্তু এর সূত্রপাত তো আপনারই হাতে, আপনারই অপরিকল্পিত সিদ্ধান্তের ফলে, আপনারই ইচ্ছা-জীবনের ভাঁজে।
তো, যারা এমন হয়ে গিয়েছে তারা কি করবে? হায়-হুতাশ?
অভ্যাস খুব মারাত্নক ব্যপার। আর মেয়েদের সব একগুঁয়েমীর আড়ালেই কোন না কোন অভিমান থাকে। সুতরাং যে পুরুষটা অনেক অনেক বছর সংসারের পরও স্ত্রীকে বুঝেন নাই, আজকে হঠাত করে তাকে সময় দিয়ে ‘ফিরিয়ে’ আনতে চান আর এইটা যদি স্ত্রী বেচারী বুঝেই যান, স্বামী প্রবরের কিন্তু খবর আছে। যদি সত্যিই কেউ চায় তাকে তার অবস্থা বুঝেই ব্যবস্থা নেয়া উচিত। চিন্তা করে, সময় দিয়ে উপায় বের করা উচিত। নিজের, বাচ্চাদের স্বার্থেই।
আমার কাছে একটা উপায়কে সহজ মনে হয়। সবারই কিছু না কিছু নেশা থাকে, শখ থাকে। আমার কাছের কয়েকজন মেধাবী গৃহবধূকে আমি বদলে যেতে দেখেছি। একটু স্বাধীনতা আর একটু মোটিভেশন দিলে পথ ভুলে যাওয়া মেয়েটি নিজের পথ খুঁজে নিতে পারে। তার শখের কাজের ব্যপারে কোন প্রশিক্ষণ দিয়ে সেটাকে লাভজনক না হোক, প্রোডাক্টিভ কাজে লাগানো যায়। ৪০ বছর বয়সেও ল’ পড়তে গেছেন বা ফ্যশন ডিজাইনিং এ ভর্তি হয়ে ব্যস্ত দিন কাটাচ্ছেন এমন দুজনকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। আগে যে অবসরে গল্প, টিভি বা পায়ে/গায়ে/হাতে ব্যথার ডাক্তারের কাছে যেতে হত, এখন সে সময়ে ক্লাস/নোট করেন, কয়েকটা মেয়েকে বাসায় প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। এলসিডি টিভিটা এখন আর কাজে লাগছে না। আমার এই দুইটা বাসায় যেতে খুব ভালো লাগে। বসে অনেক কথা শুনি। আর উনাদের কাছ থেকে স্পিরিট চুরি করে আনি। সময় ফুরিয়ে যাবার আগেই সময়কে সময় দেয়ার স্পিরিট...
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)