ইতিহাসের পাতা থেকে

স্বর্ণযুগের বিজ্ঞানঃ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি

স্বর্ণযুগের বিজ্ঞানঃ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি
ইংরেজিতে শব্দটা “Medieval Period”, বাংলায় বলে “মধ্যযুগ”। মধ্যযুগ বলতেই আমাদের মনে ভেসে ওঠে অন্ধকার যুগ কিংবা মধ্যযুগীয় বর্বরতার কথা।পঞ্চম হইতে পঞ্চদশ শতাব্দীব্ পর্যন্ত যখন ইউরোপে চলছিল এই মধ্যযুগ তথা অন্ধকার যুগ ঠিক সেসময় মুদ্রার অপর পিঠে মুসলিম সভ্যতার চলছিল স্বর্ণযুগ।
ইসলামের স্বর্ণযুগে আব্বাসীয় খিলাফতের রাজধানী ছিলো বাগদাদ নগরী। তখন বাগদাদ ছিলো সমৃদ্ধ নগরী, স্বপ্নের নগরী, বিশ্বের জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র। বাগদাদে “বায়তুল হিকমাহ” বা হাউজ অফ উইসডোম ছিলো বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সব সভ্যতার বিজ্ঞান,চিকিৎসাবিজ্ঞান, গণিতশাস্ত্, পদার্থবিজ্ঞা্‌ন, দর্শন, ইত্যাদি বিভিন্ন শাস্ত্রের জ্ঞানের সম্মেলন ঘটেছিলো।পরবর্তীতে 1258 সালে হালাকু খানের বাগদাদ আক্রমণের মধ্য দিয়ে ধুলোয় মিশে যায় ইসলামী সভ্যতার সেই জ্ঞান কেন্দ্র।
মুসলিম আবিষ্কারক বা বিজ্ঞানীদের কথা বলতেই প্রথমে বেশি শোনা যায় ইবনে সিনা, আল বিরুনী, জাবির ইবনে হাইয়ান এঁদের কথা। কিন্তু প্রকৌশল শাস্ত্রেও স্বর্ণযুগের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। সেসব উল্লেখযোগ্য অবদান নিয়েই আজকের এই আর্টিকেল।
 
 
ইসমাইল আল জাজারি
 
আচ্ছা চিন্তা করুন তো আজকে আমরা যে রোবট দেখছি এই রোবটের চিন্তা প্রথম কোথা থেকে এলো? আজকে যে গাড়ি গুলো চলছে তার প্রাথমিক ধারণা কোথা থেকে এলো? কিংবা পানি উত্তোলনের স্বয়ংক্রিয় মেশিন?
স্বর্ণযুগে প্রকৌশল আর প্রযুক্তির উদ্ভাবনে উদ্ভাবক হিসেবে যাদের নাম পাওয়া যায় তাদের মধ্যে ইসমাইল আল জাজারির নাম সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। দ্বাদশ শতকে আল জাজারি বেশ কিছু বিস্ময়কর যন্ত্রের নকশা প্রণয়ন করেছিলেন। আল জাজারি মূল বিশেষত্ব ছিল বিস্ময়কর সব যন্ত্রের নকশা প্রণয়ণে, বলা যেতে পারে আল জাজারি ছিলেন সে স্বর্ণযুগের একজন সুনিপুণ যন্ত্রকৌশলী। আল জাজারি তাঁর সমস্ত কাজের বিবরণ একটি বইয়ে লিপিবদ্ধ করেন। সেই বইয়ের বিভিন্ন ধরনের ইঞ্জিনিয়ারিং যন্ত্রের সুনিপুণ নকশা এবং তাদের কার্যপ্রণালী দেখতে পাওয়া যায়। আজকে আমরা অনেক উন্নত প্রজাতির রোবট দেখতে পাই এই রোবটের প্রথম ধারণা এসেছিল আল জাজারি সেই বইটি থেকে। ওখানে সর্বপ্রথম কিছু যন্ত্রের নকশা দেখা যায় যেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালনা করা যায়। রোবটের প্রথম ধারণা আল জাজারির সেই বিখ্যাত বই থেকেই পাওয়া যায়। এজন্য আল জাজারি কে “Father of Robotics” বলা হয়ে থাকে।
 
ইসমাঈল আল-জাজারি রচিত গ্রন্থ “কিতাবুল জামাওয়াল ইলমি ওয়াল আমল”, যার অল্পকিছু কপি বর্তমানে সংরক্ষিত আছে।
 
 
আল জাজারি সর্বপ্রথম রৈখিক গতিকে ঘুর্ণন গতিতে (and vice versa) রূপান্তরিত করার মূলনীতি কৌশল আবিষ্কার করেন। শুনতে খুব সাদামাটা শোনালেও বর্তমানে, এই আধুনিক যুগে যে সমস্ত যন্ত্র আমরা দেখতে পাই তার উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই এই মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। এর একটা বড় উদাহরণ হল গাড়ির ইঞ্জিন- ঘুর্ণন গতিকে রৈখিক গতিতে রুপান্তরিত করেই চালিত হয় গাড়ির ইঞ্জিন । একই মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে আল জাজারি এক স্বয়ংক্রিয় পানি উত্তোলনের যন্ত্র তৈরি করেছিলেন, যার উল্লেখ তাঁর বইয়ে পাওয়া যায়। এটি আজকের আধুনিক water lifting pump এর আদিরুপ।
তবে আল জাজারির সবচেয়ে বিখ্যাত আবিষ্কার হল এলিফ্যান্ট ক্লক কিংবা ক্যাসেল ক্লক। সময়মতো নামায আদায়ের জন্য সময়ের সঠিক হিসাব রাখা খুব জরুরি। আর সে ধরণের প্রয়োজনীয়তা থেকেই সর্বপ্রথম সময় নির্ধারণের জন্য ঘড়ির এক নকশা প্রবর্তন করেন তিনি।
 
আল জাজারি তার সমস্ত কার্যের বিবরণী একটি বই এ লিপিবদ্ধ করেন যার নাম “কিতাবুল জামাওয়াল ইলমি ওয়াল আমল” ইংরেজিতে "The complete book of knowledge and work". বইটিতে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ভাবে বিভিন্ন রঙ্গিন চিত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন সরল থেকে জটিল যন্ত্র নকশা নকশার ছবি দেয়া আছে। যা কিনা বর্তমানে প্রকৌশলীদের জন্য অনুসরণীয়।
 
 
বনু মুসা ভ্রাতৃবৃন্দ
 
আব্বাসীয় খলিফা আল-মামুন জ্ঞানের কদর করতেন। আর সেজন্যই তাঁর বাইতুল হিকমাহ তে তিনি স্থান দিয়েছিলেন বিশ্বের নানা প্রান্তের বিভিন্ন জ্ঞানীগুণীজনদের। খলিফা আল মামুন বনু মুসা ভ্রাতৃবৃন্দেরও পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। বনু মূসাগণ তিন ভাই ছিলেন, একজন প্রকৌশলী, একজন ছিলেন গণিতবিদ আরেকজন ছিলেন জ্যোতির্বিদ।
বনু মূসা ভ্রাতৃত্রয়
 
তাঁদের রচিত বইয়ের নাম “কিতাব আল হিয়াল” ইংরেজিতে যাকে বলে “Book of Tricks”, আনুমানিক 850 খ্রিস্টাব্দের দিকে রচিত। বইটি থেকে সর্বপ্রথম ভালভ, লিভার ইত্যাদির প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায়।
এ ছাড়াও “কিতাব আল হিয়াল” এ অনেক যন্ত্রের নকশা এবং তার কার্যপদ্ধতি বিবরণ পাওয়া যায়। কিছু যন্ত্রের আবিষ্কার ছিল প্রয়োজনে, আর কিছু আবিষ্কার ছিল তার স্রেফ আনন্দের জন্য, খেলাচ্ছলে। যেমন তাদের বই এ ছিলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালিত বাঁশির নকশা যেটা ওয়াটার প্রেসারে পরিচালিত হতো এছাড়া ছিল স্বয়ংক্রিয় ল্যাম্প। এগুলোকে আপাতদৃষ্টিতে যাদুর কৌশল, হিয়াল বা tricks মনে হতো, কিন্তু এর প্রতিটির পেছনে ছিল সূক্ষ্ম যান্ত্রিক কলাকৌশল।
 
আব্বাস ইবনে ফিরনাস
 
সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ আকাশে ওড়ার স্বপ্ন দেখেছে । সেই গ্রীক পুরাণের ইকারুসের গল্প থেকে রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের এরোপ্লেন আবিষ্কার পর্যন্ত বহুবার বহুজনে আক্ষরিক অর্থেই আকাশে ওড়ার স্বপ্ন দেখে এসেছে । তাদের মধ্যে একজন হলেন স্বর্ণযুগের আবিষ্কারক আব্বাস ইবনে ফিরনাস। আব্বাস ইবনে ফিরনাস পাখির পালক এর সাহায্যে তৈরি এক পাখা আবিষ্কার করেছিলেন এবং সেটি ব্যবহার করে কিছু সময় ওড়ার জন্য সক্ষম হয়েছিলেন। তবে উনার নকশাকৃত ওড়ার পাখাটির ত্রুটি ছিল, তাতে কোন Tail ছিলো না ফলশ্রুতিতে তার আজকের উড়োজাহাজ এর মতো সফলভাবে ল্যান্ড করার সক্ষমতা ছিলনা। তবে আব্বাস ইবনে ফারনাস এর এই নকশা এবং প্রচেষ্টার কারণে তাকে একজন “Pioneer of Aviation” হিসেবে গণ্য করা হয়।
 
আব্বাস ইবনে ফিরনাস এর নকশাকৃত উড্ডয়নের পাখা (এনিমেটেড)
 
আব্বাস ইবনে ফিরনাস ছিলেন বনু মুসা ভাতৃত্রয় এর সমসাময়িক।উড্ডয়নের প্রচেষ্টা ছাড়াও কাঁচের উপর বিস্তর গবেষণা করেছিলেন, এবং রঙিন কাচের প্রস্তুত প্রণালী আবিষ্কার করেছিলেন। রিডিং গ্লাসের ধারণাও সর্বপ্রথম উনি প্রবর্তন করেন।
স্বর্ণযুগে প্রকৌশলবিদ্যার মৌলিক সব শাখায়ই কমবেশি নতুন ধারণার উল্লেখ পাওয়া যায়, একই সাথে প্রায় প্রতিটি শাখায় প্রভুত উন্নতিও সাধিত হয়। স্থাপত্য, যন্ত্রকৌশল, পুরকৌশল, পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ, সেচকার্য, ভূমিজরিপ এসকল শাখায়ই বিস্তর গবেষণাকাজ লক্ষ্য করা যায়।
বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলো আসলে ধারাবাহিকভাবে এগোয়, অনেকটা রিলে রেস এর মতো। পূর্বসূরীদের প্রাথমিক ধারণার ভিত্তিতে উত্তরসূরীরা নতুন মাত্রা যোগ করেন। এভাবেই ধাপে ধাপে উন্নতিসাধনের মাধ্যমে এতো অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি মানুষের হাতে এসে পৌঁছেছে।আর এভাবেই কালানুক্রমে এগিয়ে চলেছে বিজ্ঞান তাঁর জয়যাত্রার পথে।
 
 
 
 
 
 
তথ্যসূত্রঃ
১। “Science in a Golden Age”- Al jazeera Documentary,
২। “The House of Wisdom” by Jim Al-Khalili, The Penguin Press, New York, 2011

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)