ধর্ম ও গবেষনা

নেতার মতো নেতা যখন পাইনা কোথাও খুঁজে

নেতার মতো নেতা যখন পাইনা কোথাও খুঁজে

নেতার কি কি গুণ থাকতে হয়? আজকে তথ্যপ্রবাহের যুগে, এ বাক্যটা মোবাইলে বা কম্পিউটারে লিখতে না লিখতেই হাজারো গুণ পাবেন। ভাবছিলাম, সংজ্ঞা থেকে উদাহরণ বের না করে, উদাহরণ দেখেই সংজ্ঞা বানাই না কেন? উদাহরণ কোথায় পাই? আসুন দেখি!

এটা একজন নেতার কথা, যিনি একই সাথে সমাজ সংস্কার, ধর্মবিশ্বাস পরিবর্তন এবং শাসন ক্ষমতা পরিচালনা, এ সবগুলো কাজ সফলতার সাথে করে গেছেন। দেখিয়ে গেছেন, জীবন যাপনের দর্শন হিসেবে তাঁর শেখানো জীবন বিধান কত অনন্য, অসাধারণ, নিখুঁত এবং সুন্দর। তিনি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। যে বিষয়টি নিয়ে আজকে লিখবো ভাবছিলাম, সেটা হল, ধর্মীয় নেতা হিসেবে তিনি কি করে মানুষকে উদ্দীপিত করতেন? কেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে করে আসা ভুলগুলোকে শুধরে নিয়েছিলো অগণিত মানুষ? একেবারে কাছের আত্নীয় থেকে শুরু করে সুদূর ইরান থেকে আসা যুবকও? ধনী বা গরীব, আযাদ কিংবা স্বাধীন, নাবালক এবং বৃদ্ধ, সবাই কি আলোর দীপ্তি দেখে তাঁর পতাকাকে বুকে ধারণ করেছিলো? জগতের বেশিরভাগ নেতার সাথে পার্থক্য থাকে যে জায়গায়, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে জায়গাটিতে অনন্য, তা হল শাসনক্ষমতা পাবার পর এই মানুষটি কিন্তু বদলে যান নি। আগের মতই তাঁর কাছে মনের ক্ষুধা মেটাতে আসতো অসংখ্য মানুষ। সীরাত গবেষকরা খুব সুন্দর করে এসবের কারণ দেখিয়েছেন। আমার কাছে তার থেকে দুইটা গুণকে খুব আকর্ষণীয় লাগে। আসুন দেখি গুণগুলো কি?

প্রথমতঃ নিজের জন্য নৈতিকতার সবচেয়ে বড় জায়গাটাকে পছন্দ করা। সেটা কি? নেতা তো নিজের জন্য সবচে উঁচু চেয়ারটাই চান। আর আমরা দিয়েও থাকি। সবার চেয়ে বড়, সবচেয়ে জমকালো সিংহাসনটা নেতার, রাজার। আমরা এটা ধরেই নিই। মুহাম্মাদও নিয়েছিলেন, কিন্তু সেটা স্বর্ণের সিংহাসনটি নয়। সেটা মানের আসন। আর কেউ যা করেনি, কাউকে করতে বলেন নি, সে কৃচ্ছ্বতা নিজের জন্য বাধ্যতামূলক করে নিয়েছিলেন। একটা চাটাইয়ে ঘুমাতেন। তাতে শরীরে দাগ পড়ে যেতো। সব বেলায় ভরপেট খেতেন না, চুলাই জ্বলতো না ঘরে। অথচ বাড়ির মধ্যেই হয়তো জমে আছে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ, চাইলেই রান্না করা খাবার আসবে অবস্থাপন্ন অনুসারীদের বাড়ি থেকে। চাইলেই সারারাত ঘুমিয়ে কাটাতে পারেন, অথচ রাতের ইবাদতকে নিজের জন্য নিয়ম করে নিয়েছিলেন। দাঁড়িয়ে থেকে থেকে পা ফুলে যেতো। গুণাহ মাফের ব্যকুলতা তো ছিলোই, তার সাথে ছিলো কৃতজ্ঞতা আদায়ের প্রেরণা। তিনি জানেন, তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, আবার সে মানুষটি হওয়ার জন্য নিজের আয়ুর প্রতিটা মুহূর্তকে ব্যয় করে গেছেন। সরল, পবিত্র এই শুভ্র মানুষটির কাছ থেকে একদম ঘরের লোকও কখনও দূর্ব্যবহার পান নি। কিভাবে সম্ভব? তাঁর রাগ হত না? কোন কারণে আশাভঙ্গ? হয়তো সময়মত কাপড় এগিয়ে দেয়নি কেউ, হয়ত খাবারের যোগাড় হয়নি, আষ্ফালন করেন নি, রাগ দেখান নি। দীর্ঘদিনের অনুচর যায়েদ, স্ত্রী আইশা এই সবকিছুর সাক্ষী। তাঁদের সাক্ষ্যগুলো আজও সারা পৃথিবীর সামনে প্রমাণ হয়ে আছে, হ্যাঁ এমন মানুষ হওয়া সম্ভব।

দ্বিতীয়তঃ সহজ করে দেয়া। ইসলাম বাস্তবিক অর্থে একটু দুরূহ জীবন ব্যবস্থা। কেন বলছি? অন্য ধর্মগুলোতে দেখু...। আচার সর্বস্ব কিছু নিয়ম কানুন, অনুষ্ঠান, কিছু সাময়িক পালনীয় রীতিনীতি, বাহ্যিক বেশভূষা বদলে নিলেই মোটামুটি ধর্মপালন হয়ে যায়। কিন্তু ইসলাম মানুষের মনের জগতে কাজ করে। তরবারীর চেয়ে এখানে মনের পাহারাদারের ক্ষমতা অনেক বেশি। যে ক্ষমতা বাড়ানোর চর্চা করলে, একসময় আর আইন, পুলিশ, তরবারী এইসবের দরকারই বোধ হয় না। যে ক্ষমতার জোরে অন্যায়কারী নিজেই এসে শাসকের কাছে ধরা দেয়, 'আমাকে শাস্তি দিন, ব্যভিচার করেছি'। কিন্তু এর প্রবক্তা বা বাহক হিসেবে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেমন ছিলেন? তাঁর নিজের বলে দেয়া মূলনীতিই দেখি, 'সহজ কর, কঠিন করো না। সুসংবাদ দাও, বীতশ্রদ্ধ করো না'। কি সুন্দর! সারাজীবন তিনি এর চর্চা করেছেন। নিজে রাতের সালাত বাদ দেন নি, অন্য কাউকে বাধ্যও করেন নি, এমনকি স্ত্রীকেও না। উৎসাহিত করেছেন। আবার কেউ অতিরিক্ত করতে চাইলে বাঁধা দিয়েছেন। মানুষকে কুরআনের কথা শুনিয়েছেন, আবার নির্দেশ দিয়েছেন বক্তৃতা যেন বেশী লম্বা না হয়, মানুষ অধৈর্য্য হয়ে পড়বে। নিজের একা সালাতে পা ফুলে যেতো, এতোক্ষণ দাঁড়াতেন, অথচ সমবেত সালাতকে সংক্ষিপ্ত করতে বলেছেন। বাচ্চার মায়েদের জন্য, অসুস্থ বৃদ্ধদের জন্য। নিজে কঠোর পর্দা করেছেন, চোখ নামিয়ে রেখেছেন। অথচ যুবক সাহাবীকে থুতনীতে ধরে আস্তে মুখ ঘুরিয়ে দিয়েছেন, সে এক মহিলার দিকে তাকাচ্ছিলো তাই। কোন ধমক না, কোন ভর্ৎসনা না। মেয়ের ঘরে গিয়ে গোস্বাভরে মুখ ফিরিয়ে বসেছেন, কেন? পর্দায় প্রাণীর ছবি। একে ত আল্লাহর নবী, তার ওপর পিতা। চিৎকার চেঁচামেচি করাই স্বাভাবিক ছিলো না? করেন নি। যতবার আল্লাহর শাস্তির কথা মানুষকে বলতে হয়েছে, ততবার জান্নাতের সৌন্দর্যও মনে করিয়ে দিয়েছেন। এজন্য মানুষ শান্তি পেতো, স্বস্তি পেতো, আস্থা রাখতো এই নেতার ওপর। নইলে কেন একজন যুবক এসে বলবেন, 'ইয়া আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আমার ব্যভিচার করতে ইচ্ছা হয়'? কি বলেছেন তিনি জবাবে? ছি ছি করে উঠেছেন? না। তাকে জিগেস করেছেন, 'এ কাজ তোমার মা বোনের সাথে কেউ করুক পছন্দ করবে?'। তারপর স্বভাবসুলভ বুদ্ধিতে তাকে শান্ত করে ফেরত দিয়েছেন। ভাবতেই অবাক লাগে, নেতা ঠিক কতটা মানবিক মানুষ হলে একজন ধর্মীয় নেতার কাছে কেউ এসে এমন ইচ্ছার কথা খুলে বলতে পারে? আর তিনিও সাহস রাখেন, সে ইচ্ছাকে আল্লাহর আনুগত্যের দিকে মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার?

শেষ কথা। এই যে নিজে পালন করতে ঢিলেমি না করা, এই যে সহজ করে দেয়া, এই নীতিগুলোর প্রভাব কি ছিলো এটা ভাবতে গেলে আসলেই ভালো লাগে। প্রায় পনরশ বছর পর, আমরা আজও এই সর্বশ্রেষ্ঠ নেতাকে ভুলে যাইনা। নিজের কাজের ছাপ তিনি এঁকে গেছেন কাগজের পাতায় শুধু নয়, মানুষের মনে। পাথরের খোদাইয়ের চেয়েও মজবুত সে ছাপ আজও মুছে যায়নি। আজকের নেতা হতে চাওয়া মানুষদের দেখিয়ে গেছেন, নিজের জন্য সর্বোচ্চ আধ্যাত্নিক মান বেছে নেয়ার নীতি। আর অনুসারীদের জন্য সে মানকেই সহজভাবে উপস্থাপনের এক অনন্য সাধারণ উদাহরণ।


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)