উইমেন (সামাজিক,মানসিক,সুবিধা বঞ্চিত নারী)

নারী ভাবনা (এক থেকে পাঁচ)

নারী ভাবনা (এক থেকে পাঁচ)
p1
 
১। আপনার একজন কলিগ, আপনার পাশেই বসেন। প্রতিদিন বা প্রতিমাসেই তিনি তাঁর নিজস্ব কাজ সামাল দিয়ে, আপনার ওপর দেয়া কিছু দায়িত্ব সেরে দেন। ছোটখাটো কাজ নয়, আপনার 'জব ডেসক্রিপশন' অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ। যেগুলো না করা হলে আপনার চাকুরী হুমকির মুখে পড়তে পারে। এবং এ জন্য তিনি কোন টাকা পয়সা আশা করেন না। বা, আপনি তাকে পয়সা দেয়াটা খারাপ দেখায়। এ মানুষটির প্রতি আপনার আচরণ কি হবে?
আপনি তাঁকে রেস্টুরেন্টে বা বাসায় ডেকে খাওয়াতে পারেন, তাঁর সাথে সবসময় ভদ্র আচরণ করতে পারেন, সর্বোপরি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে পারেন। --------------------------------------------------------- আপনি একজন পুরুষ, আপনার স্ত্রী যখন আপনার মা বা বাবাকে দেশেশুনে রাখেন, তাঁদের সাথে উত্তম আচরণ করেন, আপনার ভাইবোনের সাথেও অনুরূপ আচরণ করেন, আপনি স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকছেন তো? সময় সুযোগ পেলেই তাঁকে নিজ হাতে কিছু সাহায্য করছেন, অথবা উপহার দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে আপনি কৃতজ্ঞ? নাকি ভাবছেন, 'করবেই তো!' অথবা শুধুই স্ত্রী গর্বে গর্বিত হচ্ছেন?
 
 
২। শ্রম বিভাগের ধারণাটি পারিবারিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা সুবিচারের জন্য অপরিহার্য। তৈরী পোশাক শিল্পের কথা ধরা যাক। যে পুরুষ বা মহিলা টিশার্টের কলারটি সেলাই করছেন, আর যিনি বোতামঘর বসাচ্ছেন, কিংবা যিনি হাতার হেম মুড়ি দেন, কেউই বলেন না , 'আমিই টিশার্টটা বানিয়েছি, আমার কথাই বাকিদের শুনতে হবে।'
একটা মডেল পরিবারের কথা ধরা যাক। যেখানে পুরুষ বাইরে কাজ করেন,অর্থের বিনিময়ে। এই অর্থ তিনি ঘরে সরাসরি নিয়ে আসেন কিংবা প্রয়োজনীয় জিনিসপাতি কেনেন। আর মহিলাটি ঘরে থাকেন, তিনি স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে তাঁকে দেয়া উপায় উপকরণে মূল্য সংযোজন করে পরিবারের সদস্যেদের চাহিদা মেটান। মূল্য সংযোজন কি? চাল থেকে ভাত, শবজি দিয়ে তরকারি বানানো , চাদর দিয়ে বিছানা করা, খাবার বা বিছানাকে স্বাস্থ্যসম্মত করার জন্য রক্ষণাবেক্ষণ করা , বই থেকে বাচ্চার মাথায় জ্ঞান তৈরি করা ইত্যাদি। যদি শুধু টাকা রোজগারের যন্ত্র হয়েই আপনার এতোটা আত্নতৃপ্তি আসে যে আপনি নিজেকে সংসারের মালিক ভাবতে শুরু করেন, একটা ব্যপার ভেবে দেখবেন কি? আপনি বা আপনার সন্তানরা কিংবা বয়োবৃদ্ধ স্বজন যারা আপনার পরিবারের সদস্য, আপনারা কেউই টাকা খেতে পারেন না বা টাকায় শুতে পারেন না। আপনার সামনে আসা ধোঁয়া ওঠা পছন্দের খাবারটি কিংবা আপনার আশ্রয় যে গোছানো ঘরটি, এর তৈরির প্রথম অর্ধেক অবদান যেমন আপনার, বাকি অর্ধেকের অবদান আপনার স্ত্রীর্। এক্ষেত্রে আপনারা দুজনই সমান , বরং আপনার 'দায়িত্ব' (অধিকার নয়) একটু বেশী। যদি বুঝে থাকেন , তাহলে আজকের পর আপনি কাউকেই বলবেন না , 'আমার মা কাজ করতেন না' বা 'আমার স্ত্রী তো কিছু করে না।' অথবা কোন বোনকে কথাচ্ছলে বলে বসবেন না, 'আপনাদের তো ভালোই। বাসায় থাকেন সারাদিন। কাজ করতে হয় না। '
বলবেন কি?
 
 
৩। 'নারী অধিকার' নিয়ে কথা বলাটা খুব ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে।
কেউ ভাবেন, সমস্যা আমার। আমি ঘর-সংসারের কাজ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছি। মনে মনে আমার ঘরের মানুষটিকে গালিগালাজও করেন কিছুটা। এই মানুষগুলো বেশিরভাগই সহৃদয় মহিলা।
এক শ্রেণীর পাঠক মাথা নাড়েন আর ভাবেন, 'আহারে! এই মহিলার জামাই না জানি কি প্যারাময় জীবন যাপন করছে!! অধিকারের নামে ভদ্রলোককে না জানি কি নির্যাতন করা হয়।' বলাই বাহুল্য, ইনারা বেশিরভাগ পুরুষ।
আর একটা শ্রেণী আছেন, এঁরা অবিবাহিত। ভাবছেন, 'বাবারে, এর চেয়ে গ্রামের মেয়ে বিয়ে করবো। মুখ বুজে কাজ করবে, প্রশংসা চেয়ে মুঠি পাকাবে না। কী সব অনাসৃষ্টি কান্ড, লেখাপড়া করে এইসব শিখেছে, ছ্যাহ!'
শেষ যাদের কথা বলবো, এরা চোয়াল শক্ত করে ভাবে, বিয়ে হলে এইভাবেই সব আদায় করবো জামাইর থেকে। আর না হয়, গাল ফুলিয়ে অপেক্ষা করেন, কখন 'তিনি' আসবেন। আজকে তাঁহার খবর করবো। হাতের কাছে পুরুষ প্রজাতির নমুনা তো ওই একজনই।
এই ভাবনা চিন্তাগুলো ইনবক্সে আসে। না হয়, আমি অন্তর্যামী নই যে এম্নিতেই জেনে যাবো। কাউকে আঘাত বা ছোট করতে আমি নারী_ভাবনা লিখছি না। অধিকার সচেতনতার সাথে সাথে নারী পুরুষ উভয়েরই কর্তব্য সচেতনতা প্রয়োজন। যারা Women Express ব্লগে আমাদের লেখাগুলো পড়েন, আপনারা বুঝবেন। একতরফা মহিলাদের উস্কে দিয়ে আমিও যে শান্তিতে থাকবোনা, সে বোধবুদ্ধি আমার আছে।
আল্লাহ ইনসাফ পছন্দ করেন, আমাদের পৃথিবীতে পাঠানোর উদ্দেশ্যও তাই। কিন্তু এই ইনসাফ আল্লাহ নিজে এসে প্রতিষ্ঠা করে দেবেন না, নবী রাসুলের যুগও শেষ। এমনকি আপনার শাসক যদি ভালো লোকও হন, জামাই বা বউয়ের সাথে আপনি কি আচরণ করছেন, দেখতে উঁকি দেবে না। আপনার জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার কাজটি আপনারই, এজন্যই আপনি খলিফা। হতে পারে আপনার সঙ্গীটি মোটেও সহযোগিতা করছেন না, জ্বী সেখানেই আপনার পরীক্ষা। প্রশ্ন কঠিন হলে চেঁচামেচি না করে মাথা ঠান্ডা রাখাটাই বুদ্ধিমানের কাজ!
 
৪। অধিকার এবং কর্তব্য চুম্বকের দুই মেরুর মত, আপনার আলোচ্য ক্ষেত্র বা ব্যক্তিটি যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন, তার অধিকার থাকলে কর্তব্য থাকবেই।
মা হিসেবে নারীর অধিকার পুরুষের অধিকারের তিনগুণই শুধু নয়, বরং প্রথম তিনভাগই নারীর। অর্থাৎ নারী এখানে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত। এর পেছনের সুপ্ত সত্যটি হল, মা হিসেবে তার কর্তব্যও তিনগুণ এবং সেটি অগ্রে-সম্পাদনকৃত। মানে কি? নারী সন্তান ধারণ করবেন, জন্ম দেবেন এবং লালন পালন করবেন। তৃতীয় কাজটির বেলায় নারীর পর পুরুষের কর্তব্য থাকবে, কারণ ভরণ পোষণের যাবতীয় দায়িত্ব আল্লাহ পুরুষকে দিলেও পিতা হিসেবে তার অধিকার পেছনে। বিষয়টা কেমন? আপনি নারী হলে আপনার সন্তানের তিনগুণ পাওনা আছে আপনার কাছে যা অর্থ দিয়ে পরিশোধযোগ্য নয়। দুইগুণ আপনি আদায় করেন সন্তানকে ধারণ ও জন্মদান করে। লালনপালনের দায়িত্ব আপনি নিজে না করে অর্থ দিয়ে সেটিকে অন্য কাউকে দিয়ে পূরণ করে ফেললে আপনি মা হিসেবে তার কাছে প্রথম তিনভাগ দায়িত্বের হকদার হবেন না।
আপনি যদি বাবা হন, তাহলেও একই কথা। আপনি কোটিপতি হলেও আপনার সংগ, আপনার মূল্যবোধ ভালোবাসার উষ্ণতা আপনাকেই দিতে হবে। উদয়াস্ত যার মুখের হাসির জন্য খাটবেন, তার সেই স্বাস্থোজ্জ্বল হাসিটি দেখার সময় যদি করে নেন, তবেই তার দায়িত্বের তালিকায় আপনার নামটি দ্বিতীয় স্থানে থাকার অধিকারী হবেন।
আপনি নারী হোন বা পুরুষ, অধিকারসচেতনতার নামে আপনাকে আপনার কর্তব্য নিয়ে ভাবতে দিচ্ছে না যে শিক্ষা বা সমাজ বা ব্যক্তি, তার ব্যপারে সতর্ক থাকুন। হয়তো সে আপনার বন্ধু নয়।
 
৫। আমাদের কোন বউ ছিলো না! -----------------------
'বউ' - খুব মিষ্টি একটা শব্দ। বিশেষ করে বিয়ের আগে, ছেলে মেয়ে উভয়েই আয়নায় নিজের পাশে কল্পনা করে এক কাল্পনিক অস্তিত্বকে, যার নাম 'জীবনসংগী'। মেয়েদের ক্ষেত্রে এ কল্পনা কাল্পনিকই বটে। আর বিশেষ করে বাঙালি মেয়ের জন্য এটা ক্রেডিট কার্ডের একাউন্ট। মেয়েটি শৈশব থেকে প্রস্তুত হয়, কোন এক নাম না জানা, অচেনা মানুষের জন্য। যে তার 'রৌদ্র রুদ্র রবি' হবে, মনের গহীনে লুকানো দুরন্ত ইচ্ছা সত্যি করে দেবে, ছুঁয়ে যাবে না পাওয়ার সবগুলো ঘর। আর সে তার আজন্ম-সঞ্চিত সুধায় ভরে দেবে সেই 'আকুলে নিদাঘ তিয়াসা' নিয়ে অপেক্ষা করে থাকা মানুষের হৃদয়। ছেলেদেরও তাই, তবে কি না এক্ষেত্রে অভাবগুলো বড় বেশী দৃশ্যমান, বস্তুগত। সে কথা থাক(রাস্তাটা বিপদজনক লাগছে, আর না এগোই)।
 
এবার বাস্তবে আসি। কোথায় কবে একটা ফিল্মের অল্প একটু জায়গা দেখে ভারি ভালো লেগেছিলো। নতুন বিয়ের পর স্বামীপ্রবর টিফিনবক্সে খাবার নিয়ে অফিস যাচ্ছেন, দুই হাতে করে মহামূল্যবান ধনরত্ন নিয়ে যাবার মত করে, আর ভাবগাম্ভীর্য ভুলে লাফ ঝাঁপ দিয়ে ফেলছেন ক্ষণে ক্ষণে। আহা, যেন বিয়ে হওয়া মাত্রই নতুন আসা মেয়েটি জীবনসংগীর সব দায়িত্ব বুঝে নিবেন, আর তিনি হাঁপ ছেড়ে বাঁচবেন। না না, দায়িত্ব পুরুষটিও নেবেন তো। তবে সেক্ষেত্রে ব্যপার আছে দুইটা।
   এক, শ্রমবিভাগ অত্যন্ত কার্যকরী বিষয়, আর
   দুই,সে দায়িত্বগুলো সবই বস্তুগত।
   বাঙালির ছেলেকে আশৈশব 'পুরুষ' হিসেবেই বড় করে তোলা হয়। তাকে জানানো হয় সে 'পেতে' এসেছে, এবং সেজন্য তাকে ফিচকে কাঁদলে চলবে না, হুংকার দিতে হবে। আশার কথা একটাই এই সব প্রশিক্ষণের মাঝ দিয়েও কিছু পুরুষ 'মানুষ' হয়েই বড় হন, যাঁদের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়।
 
একই আতুড়ঘরে জন্মে, একই কোলে হাত পা ছুঁড়ে একজন বড় হয় সেবা দিতে, আর একজন সে সেবা চাইতে, নির্দ্বিধায়, নিঃসংকোচে। ব্যাপারটা এ পর্যন্ত বেশ মধুর, অন্তত শুনতে তাই লাগে। অনেক সময়ই অনেক স্ত্রী গর্ব করে বলেন, 'ও তো নিজের কাপড়টা ভাঁজও করে না'। কিংবা স্বামী বড়াই করেন, 'আপনার ভাবী তো, বাড়ির গোড়া থেকে ধনেপাতাও কেনে না'। শুনলেই ভালোবাসাময় কিছু সম্পর্কের কথা ভাবতে ইচ্ছা করে।
 
সমস্যা হয় তখন, যখন এ সমাজে বড় হওয়া কোন স্বামী বা স্ত্রী তাঁর চাহিদা, স্বপ্ন কিংবা আশানুরূপ আচরণ পান না। মেয়েরা, শতকরা আশি ভাগ ক্ষেত্রেই মানিয়ে নেন, কারণ শতকরা একশ ভাগ ক্ষেত্রেই মুরুব্বীরা মেয়েটিকেই বলেন, 'মানিয়ে নে না! সংসার সুখের হয়.. 'ইত্যাদি। আর পুরুষ? স্ত্রীর কোন খুঁত, অপারগতা, দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতা কিংবা চুড়ান্তক্ষেত্রে দ্বিচারিতার অভিযোগ শোনা মাত্রই ভাবা হয়, 'আমাদের ছেলেকে আরেকবার বিয়ে করাবো,এমন কি বয়স হয়েছে?' শুধু 'চুল কডা পাহে গ্যাছে বাতাসে!'
 
'পুরুষ মানুষ'এর রাগ আছে-চন্ডাল সে রাগ, তাদের ক্ষোভ দুঃখ আছে, কাজের জায়গায় কারো ওপর রাগ আছে, কাজের শেষে ক্ষুধা আছে, হাতে কাউকে পেটানোর নিশপিশ ইচ্ছা আছে, আর ঘরে আছে স্ত্রী, শক এবজরভার। সব ঝাড়া যাবে এখানে এসে, সব। শুধু একটু বুঝে নিতে হবে, তাঁর শক এবজরভারের ব্রান্ডখানা কি, টয়োটা না বিএমডব্লিউর, ব্যাস। এইবার তার কাঁধে ভর দিয়ে একজীবন পার করে দেয়া। সমস্যা হলে? বকে ঝাড় করো বা বদলাও, বাঁধা নেই। আর স্ত্রীটি, একই রকম হাত-মাথা-যোগ্যতা নিয়েও ওই বকাঝকা কিংবা বদলানোর ভয়ে চুপ। কেন? 'তাঁদের বউ ছিলো না যে?' আবারও বলি, এই সব ধরণের মানুষের মধ্যেই ব্যতিক্রম আছে। সম্ভবত এজন্যই, এখনও বৃষ্টি হয়, ফুল ফোটে কারও প্রিয়ার খোঁপায় জড়ানো হবে বলে, সত্যিকারের বাবা আর মায়ের কোলে বেড়ে ওঠে একজন দুজন ভবিষ্যতের কাণ্ডারি। #নারী_ভাবনা ৫

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
সম্পর্কিত ব্লগ