(লেখার ভুলত্রুটি গুলো কিংবা ভাষাগত সমস্যাগুলো ধরিয়ে দিলে বাধিত থাকব)
১
: সাব্বিরের নতুন ক্যালকুলেটরটা দেখেছিস?
: না দেখিনি, ও ক্যালকুলেটর কিনল কবে?
: কাল রাত্রে নাকি। ওর আব্বু এনে দিয়েছিল। আজ ক্লাসে নিয়ে এসেছিল।
: আচ্ছা, তা এত দেরী করে কিনল কেন?
: হয়ত সবারটা দেখতে চেয়েছিল, তারপর সবচেয়ে ভালোটা কিনবে বলে ভেবেছিল।
: কি আর ভালো কিনবে ও। বেশী ফাংশনাল হলে তো পরীক্ষার হলে ব্যবহারই করতে দিবে না।
: না, ওর ওটা, ও ব্যবহার করতে পারবে। পরীক্ষার নোটিসটা আমি দেখেছি। সেই হিসেবে ও কিছুটা সুবিধা পাবে। কিছু ফাংশন বেশী আছে আবার, আবার কিছু ধ্রুবকও রেকর্ড করা আছে ওতে। আমাদের তো সবকিছু কষ্ট করে মুখস্ত করতে হয়, ওর সব মুখস্ত না করলেও চলবে।
: তাই! ভালোতো! ধ্রুবক মুখস্ত করা কাজটা আমার খুবই কষ্ট লাগে, ক্যালকুলেটরে থাকলে ভালো হত। কিন্তু আমার ক্যালকুলেটরটা বেশ পুরোনো। সেই আদিকালের। আম্মুকে যেটা কিনে দিয়েছিল নানু।
: তুই নতুন ক্যালকুলেটর কিনবি না?
: আব্বুকে বলেছিলাম। কিন্তু আব্বু বলেছে এবছর আম্মুরটাই ব্যবহার করতে।
: কিন্তু নাইন-টেনের অংক করবি কিভাবে ওটা দিয়ে?
: জানি না। আব্বুকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। কিন্তু আব্বু নাছোড়বান্দা।
: হয়ত চাচা বুঝতে পারেননি। আরেকবার একটু বুঝিয়ে বলে দেখ।
সাঈদের এই কথার কোন উত্তর দিলো না রফিক। আব্বুকে বুঝিয়ে বললেও কতটুকু ফায়দা হবে তা এখনও জানে না সে। যতদিন আম্মু ছিল ততদিন আম্মুর কাছ থেকেই টাকা নিয়েছে সে। আম্মুর সাথে একটু জোর করলেই চলত, অথবা মাঝে মধ্যে একটু মন খারাপ করে থাকলেই চলত, তাতেই আম্মু বুঝে নিত সব।
কিন্তু এখন আম্মু নাই। চলে গেছে। আর ফিরবে না। কারণ কেউ ফেরে না। তাই মন খারাপ করেও আর কোন লাভ হবে না।
এখন সরাসরি আব্বুর কাছেই চাইতে হয়। আর আব্বুও এত সহজে টাকা দেয় না। সবকিছু খুটিনাটি জেনে তারপর ভালো মনে হলে টাকা দেয়। গতবার ক্যালকুলেটরের জন্য অনেক আশা করে টাকা চাইতে গিয়েছিল সে। দেয়নি আব্বু। ফলে এবার বুঝিয়ে বললেও কতটুকু লাভ হবে তা নিয়ে সংশয়ে ভূগতে থাকে রফিক।
২
বিকেল বেলা ঘরের পিছনে তার আব্বুকে খুজে পেল রফিক। ঘরের পিছনে জায়গাটা ছোট, তিনদিকে তার দিয়ে ঘেরা আর একদিকে ঘরের দেয়াল। ওখানেই একা একা ফুটবল নিয়ে ছোটাছুটি করতেছে আব্বু।
ফুটবল খেলতে পারেনা আব্বু। কিন্তু শুধু বল নিয়ে দৌড়া দৌড়ি করলেও শরীরটা গরম থাকবে, এই যুক্তিতেই ঘরের পিছনের জায়গাটা ঘিরেছিল আব্বু।
কিন্তু ফুটবল নিয়ে মাঠে না গিয়ে ঘরের পিছনে কেন?
একথায় আব্বুর যুক্তি হল, সবাই নিজের ঘরের দেয়ালের বাইরের সবকিছুকেই পর মনে করে। একটু জায়গা ফাকা থাকলে তার কোন যত্ন না নিয়ে ফেলে রাখে। এমনকি তার অবস্থা এমন হয়ে পড়ে যে, তার মধ্য দিয়ে শান্তিমত হেটে যেতেও ইচ্ছে হয় না। আর যদি সরকারী জায়গা হয়, তাহলে তো কথাই নেই। ডাস্টবিন আর তার মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না তখন।
আব্বুর যুক্তি হল, এভাবে নিজের পাশের জায়গাটাকেই পর মনে করা অনেক খারাপ একটা অভ্যাস। চাইলেই একে পরিস্কার রাখা যায়। সুন্দর করে রাখা যায়। তখন ঘরের মধ্যে আর বাইরে দুই জায়গাতেই থাকতে ভালো লাগে। সামাজিক সম্প্রীতি তো আর এমনি এমনি আসে না।
: আব্বু আমি খেলব। খেলতে খেলতে আব্বুকে কথাটা বলাই ভালো হবে, ভাবল রফিক।
: ঠিক আছে, চলে এস।
রফিক যোগ দেওয়াতে খেলার ধরণ পাল্টে গেল। আগে আব্বু একা একা বলে লাথি দিয়ে দেয়ালে মারতেছিল। আর এখন রফিক যোগ দেওয়াতে শুরু হল তার সাথে আব্বুর বল নিয়ে কাড়াকাড়ি।
খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয়ে গেল আব্বু, বিশ্রামের জন্য দাড়াল কিছুক্ষণ। কারণ, এতক্ষণ দৌড়াদৌড়ির পর হঠাৎ করে বসে পড়লে আরও বেশী গরম লেগে যেতে পারে। হিটস্ট্রোকেরও সম্ভাবনা আছে।
: আব্বু, সাব্বির একটা নতুন ক্যালকুলেটর কিনেছে। অনেক ভালো। কথাটা তুলল রফিক। কিন্তু আব্বু চুপচাপ।
: অনেকগুলো ফাংশন আর ধ্রুবক মেমরিতে সেভ করে দেয়া আছে। আব্বু এবারও চুপ। সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। পায়ের নিচে বল।
: ধ্রুবকগুলো অনেক বড় বড়, মনে রাখতে অনেক কষ্ট হয়। আবার ভুল হলেও অংক ভুল হয়ে যায়। আব্বু এবারও চুপ। বুঝতে পারল রফিক, আসল কথা বলার আগে কোন কথাই বলবে না তার আব্বু।
: আমি ওরকম একটা ক্যালকুলেটর কিনতে চাই। ওর আব্বুকে বললেই কিনে এনে দেবে। বলে ফেলল সে। কিন্তু আব্বু এবারও চুপ।
: আব্বু...
: হুম... যেন হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে রফিকের দিকে তাকাল।
: ক্যালকুলেটর কিনব... আবার গোড়া থেকে বলতে ইচ্ছে হল না তার।
: ঠিক আছে কিনে ফেল। হাতে টাকা পয়সা কেমন আছে?
বিস্মিত হত রফিক। বলে কি আব্বু, সে টাকা কোথায় পাবে?
: আমার কাছে তো কোন টাকা নেই। কথাটা বলতেই গলা শুকিয়ে গেল রফিকের। ভয়ে নয়, আব্বুর আচরণে।
: তাহলে কিভাবে কিনবে? রফিক এবার চুপ।
: ও আমার কাছ থেকে নিবে! আচ্ছা তাহলে এবার বল, কেন ক্যালকুলেটর কিনবে?
মনে মনে চরম বিরক্ত হলেও তেতোমুখে অনেক কষ্টে শিষ্টে আবার গোড়া থেকে গুছিয়ে কথাগুলো বলল রফিক। আব্বুর এই অনাত্নীয় সুলভ আচরণ কোনভাবেই বুঝে আসতেছে না তার। হয়ত আম্মু না থাকার কারণে এর প্রভাবটা আরও বেশী মনে হচ্ছে।
: তোমাদের বইতে আর কতগুলো ধ্রুবকই বা আছে! ওগুলো মুখস্ত রাখা তো খুবই সহজ! সবশুনে আব্বুর নির্লিপ্ত জবাব।
: কিন্তু ওগুলো অনেক বড় বড়। আর তাছাড়া অনেকগুলো নতুন ফাংশনও আছে। আবার বোঝাতে চেষ্টা করল সে।
: ক্যালকুলেটরই যদি তোমার ফাংশনের অংক করে দেয়, তাহলে তুমি নিজে কি শিখলে? এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া সহজ হবে না। কারণ ক্যালকুলেটরের কোন ফাংশন নিয়ে আব্বু কথা বলতেছে সে জানে না। সাব্বিরের নতুন ক্যালকুলেটরটা দেখেনি সে।
: কিন্তু সবাইই তো নতুন ক্যালকুলেটর কিনেছে। দমে গেল রফিক। মাথা নিচু করেই কথাটা বলল সে। বুঝে গেছে সে, আব্বু তাকে নতুন ক্যালকুলেটর কিনে দেবে না।
: সবাই কিনেছে, কিন্তু সাইদ কিনেনি!
ঝট করে আব্বুর দিকে তাকাল রফিক। সত্যি সাঈদ ক্যালকুলেটর কিনেনি। কারণ কিনতে পারেনি। সে বলতে চাইল যে, সাঈদই তাকে বুদ্ধি দিয়েছে নতুন ক্যালকুলেটর কিনতে। কিন্তু নতুন করে কথা বলার মত আর কোন ইচ্ছে ছিল না তার।
৩
মাঝে মাঝে স্কুলের সময়টা খুব বিরক্তিকর লাগে তার কাছে। ছোট্ট একটা স্কুল, মাঠ বলে কিচ্ছুটি নেই। বিল্ডিংয়ের ভিতরেই যা ঘোরাঘুরি। হাতে কোন কাজ না থাকলে অসহ্য হয়ে উঠে সময়টা। কিন্তু স্কুল ছুটি হওয়ার আগে বেরোনোরও কোন সুযোগ নেই। আর বের হয়েই বা যাবে কোথায়, চারিদিকেই শহর।
তাও যদি স্থির শহর হত, তবে একটা কথা ছিল। রাস্তা, বসতবাড়ি, সবদিকেই নির্মান কাজ চলতেছে। বাতাসে শুধু ধুলা আর ধুলা। একবার বাতাসের বাড়ি খেয়ে উপরে উঠে আর নিচে নামে না ওগুলো। স্থির হয়ে থাকে বাতাসে। যেমন পানিতে মেশেনা এমন পাতলা কিছু মেশালে যা হয়, না গলে পানিতে মিশে ওগুলো, না থিতিয়ে নিচে পড়ে।
তার উপর আছে বালুর স্তুপ। প্রতিদিন এক সাগর বালু পেরিয়ে স্কুলে আসে তারা। মুল শহরের মানুষগুলো কতই না আরামে আছে, অন্তত নির্মাণের এই ঝামেলা থেকে মুক্ত আছে তারা। ভাবে রফিক।
ওর ফ্রেণ্ড সবাই মোবাইল আর ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু ও ল্যাপটপ পাবে কোথায়। ওর আব্বুতো ওকে ক্যালকুলেটরই কিনে দিতে চাচ্ছে না।
কিন্তু কিনে দিচ্ছেনা বলে চাইবে না সে!
নতুন করে ভাবল রফিক। হাল ছেড়ে দিলে কিভাবে হবে। ক্যালকুলেটর কিনতে চাইলে কিনে দেয়নি আব্বু, কিন্তু ল্যাপটপ কেনার বায়না ধরলে, ক্যালকুলেটর নিশ্চয়ই কিনে দেবে। বুদ্ধিটা খারাপ না। ভাবল রফিক। আম্মুর মত আব্বুকেও একটু জ্বালিয়ে দেখা যাক না।
৪
মন খারাপ করে নিজের রুমে এসে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল রফিক। আব্বুকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে সে। সেই যাইই বলে আব্বুর একটাই কথা, তাকে বোঝাতে হবে যে, জিনিসটা তিনি কেন রফিককে কিনে দেবেন। তাকে বোঝাতে পারলেই তিনি টাকা দিয়ে দেবেন কেনার জন্য। বলে টাকা বের করে রেখেছিলেনও টেবিলের উপরে।
অনেক আশা নিয়ে আবার গোড়া থেকে সব গুছিয়ে বলেছিল রফিক। সব কথা শুনে আব্বু মাথা উচু করে রফিকের দিকে তাকিয়ে একটা কথাই বলেছিল,
: হল না। আমি সন্তুষ্ট নই। তুমি আমাকে বোঝাতে পারনি। আমি দুঃখিত।
এরপরই আব্বুর উপর রেগে যায় সে। টাকা না দেওয়ার ব্যাপারটা সে মেনে নিতে পারলেও, কিন্তু আব্বুর এই আচরণ সে মেনে নিতে পারছিল না।
: আম্মুকে কখনও এভাবে বোঝাতে হয়নি আমার। আব্বুর দুর্বল স্থান কোনটা জানে রফিক।
: আম্মুর কাছে চাইলেই পেতাম। কিন্তু আপনি কোনভাবেই দিতে চাচ্ছেন না। ক্যালকুলেটরটা আমার খুবই দরকার, অথচ আপনি বুঝতেই চাচ্ছেন না। আমার ফ্রেণ্ডরা সবাই কতকিছু কিনেছে, অথচ আপনি আমাকে ক্যালকুলেটরটাও কিনে দিচ্ছেন না। আম্মু মারা যাওয়ার পর, আপনি যেন একদমই পর হয়ে গেছেন। আমাকে চিনেনই না। আমি আপনার লাভ বোঝাতে না পারলে, আমার প্রয়োজনীয় কোন জিনিসই কিনে দেবেন না। আম্মু আমার সাথে কখনও এরকম আচরণ করেনি।
এরপর আর ওখানে দাড়ায়নি রফিক। সোজা নিজের রুমে চলে এসেছে।
৫
দরজায় হালকা নকে ঘুমটা ভেঙে গেল রফিকের। দেখল দরজা দিয়ে আব্বু ঘরে ঢুকতেছে। আব্বুকে দেখেই ঘুমটা পুরোপুরি ছুটে গেল রফিকের। বিছানায় উঠে বসল সে, তারপর বালিশে হেলান দিল।
আব্বু এসে রফিকের পড়ার টেবিলের চেয়ারটাতে বসলেন।
কিছুক্ষণ দুই জনই চুপচাপ।
তারপর মুখ খুলল আব্বু।
‘তোমার আম্মু যখন মারা যায়, তখন একটা চিন্তা খুব ভাবিয়ে তোলে আমাকে। যদি আমিও মারা যায়!’
‘খুবই বোকাটে একটা চিন্তা।’ হেসে ফেলল আব্বু।
‘কিন্তু সত্যি গত কয়েকদিন ধরেই এই চিন্তাটাই করতেছিলাম আমি। মৃত্যুর তো আর কোন সময়সীমা কারও জানা নেই। কখন আসবে বলাও যায় না। তাই আগে থেকে প্রস্তুত থাকা ভাল।’
‘আজ থেকে ১৮ বছর আগে আমাদের বিয়ে হয়েছিল। নতুন জীবন, নতুন সংসার। অনেক স্বপ্ন। দুজন মিলেই পুষিয়ে নিচ্ছিলাম নিজের সময়গুলো। তোমার আম্মুকে ঘরের কাজে মনোযোগী দেখে, আমি মুলত বাইরের জীবন নিয়েই বেশী ব্যস্ত ছিলাম। একটু একটু করে গুছিয়েও নিচ্ছিলাম নিজের জীবনটাকে। শিক্ষাজীবনের বাধাহীন জীবন থেকে গোছালো স্বভাবে ফিরে আসাটা এত সহজ ছিল না যদিও। কিন্তু, মানিয়ে নিতে পারছিলাম।’
‘বছর একটা ঘুরতেই এলে তুমি। আর তোমার আম্মুর ব্যস্ততাও বেড়ে গেল অনেক। কিন্তু সে মানিয়ে নিচ্ছিল। তোমার আগমনে আমার প্রতি তার মনোযোগে বিঘ্ন দেখিনি আমি।’ আব্বুর নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়েছে, ভাবে রফিক। না হলে এসব কথা বলতেছে কেন। নিজের ভিতরে আরো জড়সড় হয়ে যায় সে।
‘তোমার আম্মুর মনোযোগ দেখে ঘরের দিকে আর তাকায়নি আমি। পরিবারটা বড় হয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতের চিন্তা করা শুরু করি। বলতে গেলে দিনে অফিস আর রাতে নিজের বাসায় ঘোরাঘুরিতেই কেটে গেল আরেকটি বছর। এল রাদিয়া। আরও ব্যস্ত হয়ে উঠলাম আমি। আরও দুইটা ভবিষ্যতের চিন্তাও যে করতে হবে এখন।’
‘আরও দ্রুত হয়ে উঠল আমার চলাচল। ভুলে গেলাম আমি জীবনের অনেক বাস্তবতা। এতটাই ব্যস্ত ছিলাম আমি, একবারের জন্যও রাস্তার পাশে ফুটপাতে চোখ যায়নি আমার। চোখ যায়নি অফিস কিংবা বাসার গেটের পাশেও। কিংবা আমার অফিসের পাশের পার্কটাতেও। আমি এই চিন্তা নিয়েই এত সন্তুষ্ট ছিলাম যে, জীবন আর কখনও এরচেয়ে পূর্ণ হতে পারে না।’
‘এরপরেই জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভটা খসে পড়ল আমার। আর আমার চোখের সামনে প্রকাশিত হয়ে উঠল, অনেক দৃশ্য যা কখনও চোখে পড়েনি আমার। শুধুমাত্র বেচে থাকার জন্য কি কষ্টটাই না করতেছে মানুষ। পার্কের ডিম বিক্রেতা, রাস্তার পাশের ঝালমুড়ি বিক্রেতা কিংবা জুতা সেলাই করা লোকটা, কি তাদের জীবনের আর চাওয়া। দিনের ১৮ ঘণ্টায়ই তাদের কাটে রাস্তার উপর। পরিণতিতে তারা পায় শুধু খাবার আর আশ্রয়। অনেকে তাও পায় না।’
‘কিভাবে তারা জীবনের এই পর্যায়ে এসেছে তা আমি জানি না। কিন্তু ফুটওভার ব্রিজের সিড়ির উপর একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকা শিশু দুইটা! সিড়ির উপরের একটা ধাপে হেলান দিয়ে, নিচের একটা ধাপে বসে আছে একটা শিশু। বয়স কত হবে, ২ বছর! তার কোলে ঘুমিয়ে আছে আরও একটা। বড় ছেলেটা ছোটটাকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরে আছে যেন, মা তার ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। চিন্তা কর, কোথায় জীবনের স্বীকৃতি, আর কোথায় একাত্মতার অনুভূতি। তুমি কি বলতে পার রফিক যে, ঐ দুইটা ছেলের একজনকে আল্লাহ আঈনস্টাইনের কোন গিফট দিয়ে পাঠাননি। বলতে পার না, কারণ ঐ গিফট উন্মোচনের কোন ব্যবস্থা আমরা করিনি।’
‘যখন আমার মধ্যে এই চিন্তা প্রকট হয়ে উঠল যে, আমিও মারা যেতে পারি, তখন আরেকটি চিন্তা আমার মাথায় গেড়ে বসল, তোমাদের কি হবে।’ এবার চোখ তুলল রফিক। কি বোঝাতে চাইছে আব্বু।
‘এখানেই আমার দুইটা চিন্তা ধাক্কা খায়।’
‘কোন জিনিসটা মানুষের জীবনে যুদ্ধ করার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয়। নির্দিষ্ট একটা লক্ষ্য নির্দিষ্ট করার জন্য সবচেয়ে কোন জিনিসটি প্রয়োজনীয়? বলতে পার?’ আব্বু তাকিয়ে আছে দেখে মাথা নাড়ল রফিক।
‘চিন্তা করার ক্ষমতা। তোমার সামনে যদি লক্ষ্য সম্পর্কে ধারণাই না থাকে, তাহলে তুমি ঐ লক্ষ্য সম্পর্কে চিন্তা করবে কিভাবে, লক্ষ্যে পৌছানো তো আরও দুরের কথা।’
কিছুক্ষণ চুপচাপ।
‘রফিক, যদি তোমার ইচ্ছা থাকে হিমালয়ের সমান উচুতে মাথা উচু করে দাড়ান, তবে যদি তুমি কখনও কোন ডোবায়ও পড়ে যাও, তুমি একদিন ঠিকই উঠে আসতে পারবে। আর যেদিন উঠে আসবে, সেদিন ভুলে যেওনা, ডোবায় তোমার সাথে পড়ে থাকা অন্যদের কথা। এটাই সৃষ্টিকর্তার প্রতি তোমার কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ।’
আবারও নিরবতা।
‘আমি চাচ্ছিলাম যে, তুমি এমনভাবে বেড়ে ওঠ যে, তুমি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে শিখ। এটা যে কোন সফল মানুষের প্রথম গুন। নিজের অহংকে প্রয়োজন অনুযায়ী বাকা করতে শেখা। এই গুন অর্জন করতে পারলে জীবনে কোন সফলতাই তোমার কাছে অধরা থাকবে না।’
‘একারণেই তুমি যখন আমাকে বলছিলে ক্যালকুলেটর কিংবা ল্যাপটপ কিনে দেওয়ার কথা, তখন আমি চাচ্ছিলাম যে, তুমি নিজের অহংকে বাকা করে নিজের প্রয়োজনটা উপযুক্তভাবে উপস্থাপন করতে শিখ। আমি তোমাকে বলেছিলাম তোমাকে ক্যালকুলেটর কিনে দিয়ে, আমার লাভটা কি, তা আমাকে বুঝিয়ে বলতে। ব্যাপারটা এইভাবে দেখো না যে, আমি তোমাকে পর মনে করেছি। আসলে আমি চেয়েছি আমি নিজে পর হিসেবে সেজে তোমাকে পরকে কনভিন্স করতে শেখাতে।’
‘আমি তোমার আব্বু। তুমি চাইলে আমাকে তোমার ইচ্ছামত তুমি বাকা করতে পারবে। কিন্তু একজন কোম্পানির মালিককে কি পারবে? কিংবা একজন মানুষ, যে দান করতে চায়, কিন্তু সে নিশ্চিত হতে চায় যে, তার দানটা বিফলে যাবে না, তাকে কি বোঝাতে পারবে, যে তার দান করা অর্থ তুমি তার কর্যে হাসানা উৎস সৃষ্টি করার কাজে ব্যবহার করতে পারবে!’
‘যদি না পার, তবে কোথায় পাবে তুমি ফুটওভার ব্রিজের সিড়িতে ঘুমিয়ে থাকা ঐ শিশু দুইটার জন্য কিছু করার মত অর্থ?’ রফিক চোখ তুলে তাকাল।
‘রফিক, দুনিয়ার সমস্ত সমস্যা তোমাকে একা সমাধান করতে হবে, এমন কোন কথা নেই। তুমি একা তা পারবেও না। মানুষ ভাল কাজ করতে চায়, তারা দানও করতে চায়, কিন্তু তারা চায় কোন উপযুক্ত কেউ তাদের পথ দেখিয়ে দিক। তুমি কি সেই উপযুক্ত কেউ একজন হতে চাও? তবে অন্যের ইচ্ছামত নিজের ইচ্ছাকে বাকা করতে শিখ।’ উঠে দাড়ালেন আব্বু।
‘অনেক কথা হয়েছে। আজ আর নয়।’ বলে দরজার দিকে হাটা ধরল আব্বু।
কিন্তু দরজার কাছাকাছি গিয়েই আবার ঘুরে দাড়াল।
‘ও হ্যা। এটা যেহেতু তোমার প্রথম পরীক্ষা, সেহেতু আমি তোমাকে পাশ করিয়ে দিচ্ছি।’
রফিক কিছু বুঝতে না পেরে আব্বুর দিকে তাকিয়ে রইল। কিন্তু সেদিকে না তাকিয়েই ঘর থেকে বের হয়ে গেল আব্বু।
আর তার সাথে সাথে একরকম ভরহীন শূন্যতায় ভরে উঠল তার মন।
৬
উল্টাপাল্টা চিন্তার আকাশে এদিক-ওদিকে দোল খাচ্ছিল রফিক। আব্বু এসে এতক্ষণে কি বলে গেল, তখনও তা হজম করার চেষ্টা করতেছে সে।
কিন্তু বেশীক্ষণ আর থাকা হল না এভাবে।
দরজা খুলে ঝড়ের বেগে প্রবেশ করল রাদিয়া।
‘ভাইয়া, তুই নাকি কোন প্রপোজালে পাশ করেছিস, তাই আব্বু তোর বাজেটের ৪০% টাকা দিয়েছে।’ বলে টেবিলের উপর কিছু একটা রাখল সে।
তারপর যেভাবে এসেছিল, সেভাবেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে।
‘৪০% টাকা!’
‘আব্বু রাদিয়াকে দিয়ে টাকা পাঠাল! নিজের রুমে এসেও দিয়ে যায়নি!’ এবার আবার রাগ হতে শুরু করল তার।
‘শুধু তাকেই কেন দূরে ঠেলে দিতে হবে!’ তার উপর রাদিরাকে প্রাধান্য দেওয়ার উদাহরণও মনে পড়তে লাগল তখন তার। আব্বুর সামনে কথা বলতে কিছুটা হলেও ভয় লাগে তার, আর অন্যদিকে রাদিয়া সবসময় আব্বুর সামনেই তর্ক করে ওর সাথে।
রাগ হলেও একটা বিষয় মনে পড়ল রফিকের। সে কখনও আব্বুর কাছে টাকা চায়নি। চেয়েছে আম্মুর কাছে। আর আব্বুও কখনও নিজে তাকে টাকা দেয়নি। দিয়েছে আম্মুর মাধ্যমে। আর এখন সে নিজে টাকা চাইলেও, আব্বু টাকা দিয়েছে রাদিয়ার মাধ্যমে!
তাহলে রাদিয়াই কি আম্মুর প্রতিস্থাপন!
আব্বু বলেছে, কাউকে রাজি করাতে তার ইচ্ছানুসারে নিজের মনকে বাকা করতে। তার মনে হয় সে দুই নম্বর বিকল্প খুজে পেয়েছে। কারও কাছে নিজের মনকে বাকা করে কাজ না হলে, তার দুর্বল স্থানটাকে খুজে বের করলেই চলবে।
আব্বুর দুর্বল স্থান সে খুজে পেয়ে গিয়েছে।
হেসে উঠল রফিক।
তারপর টেবিলের উপর থেকে টাকাগুলো নিয়ে বাইরে যেতে উদ্যত হল। এই টাকায় তার নিজের পছন্দের ক্যালকুলেটর না হলেও সাঈদ একটা ক্যালকুলেটর কিনতে পারবে।
তারপর!
তারপর আবার আব্বুকে বলবে সে ক্যালকুলেটর কেনার কথা। তবে এবার রাদিয়াকে রাজি করাবে আগে। যদিও জানে কাজটা সহজ হবে না এতটা।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)