ইতিহাসের পাতা থেকে

‘সাবর’ বা ধৈর্য

‘সাবর’ বা ধৈর্য
বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম ‘সাবর’ বা ধৈর্য প্রত্যেক মুসলমানদের জন্যে অপরিহার্য। ‘সাবর’কে অনেকেই আমরা ‘সবুর’ বলেও ডেকে থাকি। কেউ বিপদে পড়লে, কোন কঠিন সমস্যায় পড়লে, কোন আকাঙ্খিত বস্তু না পেলে আমরা সাধারণত তাকে বলে থাকি, ‘সবুর কর, এত অধৈর্য হলে চলে’ কিংবা ‘সবুর কর সব ঠিক হয়ে যাবে’। আমাদের মাঝে একটা প্রবাদও প্রচলন আছে, ‘সবুরে মেওয়া ফলে’। ‘সাবর’ বা ‘সবুর’ এর সাথে তাওহীদের সম্পর্ক রয়েছে। হাফিজ ইবনে কায়্যিম রহিমাহুল্লাহ ইমাম আহমাদ রহিমাহুল্লাহ এর বরাতে বলেছেনঃ ‘সাবর’ বা ‘সবুর’ এর কথা নব্বই স্থানে কুরআনে উল্লেখ রয়েছে। ‘সাবর’ বা ‘ধৈর্য’ বা ‘সবুর’ যেটাই বলি না কেন এর মর্মার্থ আমাদের কাছে একই অর্থাৎ শাব্দিক উচ্চারণ পার্থক্য থাকলেও অর্থের দিক দিয়ে আমাদের নিকট বোঝার ক্ষেত্রে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। ‘সাবর’ এর আবার তিনটি প্রকারভেদ রয়েছে যে বিষয়টি আমরা অনেকেই জানি না কিংবা জানলেও বিষয়টি পরিস্কার নয়। ইনশাল্লাহ, সেই বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করবো। ‘সাবর’ এর তিনটি প্রকার হচ্ছেঃ ১. আসসাবর বিল্লাহ বা আল্লাহতে সবুর করা। ২. আসসাবর লিল্লাহ বা আল্লাহর জন্যে সবুর করা। ৩. আসসাবর মা’আল্লাহ বা আল্লাহর সাথে সবুর করা। আসসাবর মা’আল্লাহ প্রথম দুই শ্রেণীর ‘সাবর’ অপক্ষো বড় পর্যায়ের কঠিন ও দুরুহ। কারণ, প্রথম দুই শ্রেণীর ‘সাবর’ ধারণ করার ক্ষেত্রে কোন বিরোধিতা আসে না বরং কিছু সুনাম পাওয়া যায়। উদাহরণ স্বরুপঃ পাপ কাজ থেকে বিরত থাকলে, কারো ব্যবহারে মনক্ষুন্ন হলে, কারো উপর কোন বিপদ আপতিত হলে, কেউ মারা গেলে ভেঙ্গে না পড়ে ধৈর্য ধারণ করলে অনেকেই আপনাকে বাহবা দিবে; দেখেছ, কি ধৈর্যশীল – একটুও ভেঙ্গে পড়েনি! আবার কারো নিকট একটা বস্তু রয়েছে আপনারও সেই বস্তুটি দরকার যেমন ধরুন ফ্রিজ। আপনার একটা ফ্রিজ কেনা অতীব জরুরী হয়ে দাড়িয়েছে কিন্তু আপনার আয় সীমিত, হালাল উপর্জন করেন, আপনি ধৈর্য ধারণ করলেন। অবৈধ পন্থায় অর্থ উপর্জন করে ফ্রিজ কেনার চিন্তা করলেন না, আপনি আল্লাহতে ‘সাবর’ করে বললেন, ইনশা’ল্লাহ, আল্লাহ তা’আলা আমার একটা ব্যবস্থা করে দিবেন। অর্থাৎ আপনি আল্লাহর জন্যে ধৈর্য ধারণ করলেন। এখন কেউ যদি আপনার এই ধৈর্য ধারণের বিষয়টি জানে তাহলে আপনাকে বাহবা দিবে, আপনার সুনাম করবে – বাহ, আপনি একটা চমৎকার মানুষ। ‘আসসাবর মা’আল্লাহ’ তে উপরের দুইটির মতো সুনাম কিংবা বাহবা কোনটাই নেই, এই প্রকারের ‘সাবর’ বা ‘ধৈর্য’ শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যে। উদাহরন স্বরুপঃ সমাজে মানুষ মাজারে নজর নিয়াজ করাকে, মাজারে মৃত ব্যক্তির নিকট দোয়া করাকে কল্যাণ মূলক কাজ হিসেবে করে থাকে। ধরুন, আপনি এর বিরোধিতা করলেন, বললেন, মাজারে যেয়ে নজর নিয়াজ, মানত কিংবা মাজারে যেয়ে মৃত ব্যক্তির নিকট দোয়া করা ‘শিরক’। দেখা গেল, সবাই আপনার বিরোধিতা করল, আপনার পরিচিত জন আপনার নিকট থেকে দূরে সরে গেল কিন্তু তবুও আপনি আপনার বক্তব্যে অটল রইলেন, আল্লাহর সাথে ধৈর্য ধারণ করলেন। আবার ধরুন, অনৈসলামিক কাজ এতই প্রসার পেয়েছে যে সেটাকে স্বাভাবিক মনে করা হচ্ছে, আল্লাহর বিধানকে অমান্য করা হচ্ছে, মানুষ আল্লাহর ইবাদতে অংশীদার স্থাপন করছে, রাসূল ﷺ এর সুন্নাহ’র বিপরীত কাজ করছে, বিদআহ’র অনুসরণ করছে আপনি এগুলোর বিরোধিতা করলেন, এতে দেখাগেল সমাজে সবাই আপনার বিরোধিতা করল, আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও আপনার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিল কিন্তু তবুও আপনি ধৈর্য ধারণ করে আপনার বিরোধিতায় অটল রইলেন, অসত্যের সাথে আপোষ করতে রাজি হলেন না। এটাই হচ্ছে আসসাবর মা’আল্লাহ – রাব্বুল আলামীনের সঙ্গতা। কেননা মু’মিন বান্দা যখন আল্লাহর জন্য মানুষকে অসন্তুষ্ট করে তখন তাদের অসন্তুষ্টির কারণে যত বাধা অসুবিধা আসবে তার জন্য আল্লাহ ব্যবস্থা করবেন। আর বান্দা যখনই আল্লাহর জন কোন বস্তু বা মানুষের ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, সঙ্গতা পরিত্যাগ করে তখন আল্লাহ তার বান্দার ঐ পরিত্যাজ্য বস্তু অপেক্ষা অধিক উত্তম বস্তু পুরস্কার দেন। সুতরাং যখনই সত্যের-পথিক আল্লাহ তা’আলার জন্যে কোন মানুষ বা কোন দল পরিত্যাগ করতে পারবে, তখন আল্লাহ ঐ ব্যক্তি বা দল অপেক্ষা তাকে উত্তম কিছু দিবেন। তা’ই হল আল্লাহর মাইয়াত তার সঙ্গতা, তা যা পরিত্যাজ্য ব্যক্তি বা দল অপেক্ষা অতি উৎকৃষ্ট ও স্থায়ী। আর আল্লাহই হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ পাওয়ার বস্তু এবং স্থায়ী, যার লয় নেই, ক্ষয় নেই। এমন এই সঙ্গতা যা সারা জীবন এবং মৃত্যুর পর কবরে, হাশরে। এমনকি জান্নাতে তাঁরই দীদার সমস্ত নিআ’মাত অপেক্ষা মিষ্টি ও তৃপ্তির হবে। এই প্রকাল ‘সাবর’ এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ রাসূল ﷺ এবং সাহাবীদের জীবনী। মিথ্যার সাথে তারা কোন মতেই আপোষ করেন নি। মক্কায় জঙ্গে আবু তালিব এলাকায় তিন বছর পর্যন্ত একঘরে করে রাখা হয়েছিল, তাদের সাথে সকল প্রকার লেনদেন, ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, খাদ্য সরবারহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল কিন্তু তবুও তারা সত্য পথ থেকে বিন্দু মাত্র বিচ্যুত হননি। যার কারণে তাদের উপর আল্লাহ তাআলা সন্তুষ্ট হয়েছিলেন এবং তাদেরকে নেতৃত্ব দান করেছিলেন। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ রহিমাহুল্লাহ বলেছেনঃ ধৈর্য ধারণ ও দৃঢ় বিশ্বাসের কারণে দীনের ইমামাত নেতৃত্ব লাভ হয়। এটা কুরআনের সূরা সাজদার নিন্মোক্ত আয়াতের মর্ম হতে গৃহীত। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ “আর আমি তাদের মধ্য হতে নেতা মনোনীত করেছিলাম, যারা আমার নির্দেশ অনুসারে পথপ্রদর্শন করতো, যেহেতু তারা ধৈর্যধারণ করেছিল। আর তারা ছিল আমার নিদর্শনাবলীতে দৃঢ় বিশ্বাসী”। (সূরা সাজদাহঃ ২৪) উম্মাতে মুসলিমার মধ্যে যে সমস্ত মনীষী একমাত্র আল্লাহর নির্দেশিত হুকুম মুতাবিক রাসূল ﷺ এর তরীকার প্রতি হিদায়াত করার জন্যে একনিষ্ঠ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন, তাদের ইমামাত অপ্রতিদ্বন্দ্বীরুপে উম্মাতের হৃদয়ের গভীরে স্থান পেয়েছে। আমরা যেন ধৈর্যের সকল প্রকারভেদ অনুসরণ করতে পারি সেই তৌফিক আল্লাহ তা’আলার নিকট চাইছি। আল্লাহ তাআলা আমাদের হিফাজত করুন। আমীন। “তুমি ধৈর্য ধারণ করো, তবে তোমার ধৈর্য তো একমাত্র আল্লাহর ই সাহায্যে হবে। আর তুমি তাদের (বিরোধীদের) ব্যবহারে দুঃখ করো না, আর তাদের ষড়যন্ত্রের কারণে তুমি মনঃক্ষুন্ন হয়ো না।” (সূরা নাহলঃ ১২৭) “নিশ্চয়ই আল্লাহ ঐ সমস্ত লোকের সাথে আছেন যারা আল্লাহকে ভয় করে চলে এবং যারা আল্লাহর দীনে মুখলিস” । (সূরা নাহলঃ ১২৮) (সংগৃহীত)

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
লেখকের অন্যান্য ব্লগ সবগুলো দেখুন