অনির্ধারিত
অনুশোচনা

এক রাতে কাজ শেষে বাসায় ফেরার পর আমার
স্ত্রী প্রতিদিনের মত আমাকে নিয়ে রাতের
খাবার
খেতে বসলো। তখন আমি তার হাতটি জড়িয়ে
ধরলাম
এবং বললাম, "আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে
চাই।"
সে আমার চোখের দিকে শান্ত ভাবে তাকালো...
আমি বুঝতে পারছিলাম
না যে তাকে আমি কথাগুলো কিভাবে বলবো।
কিন্তু
তাকে আমার জানানো উচিৎ যে, আমি তার সাথে
আর
সংসার করতে চাই না। আমি খুব ধীরে,
শান্তভাবে বিষয়টি তুললাম। সে আমার কথায়
কোনরকম বিরক্ত প্রকাশ
না করে ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করল, "কেন?"
আমি তার প্রশ্ন এড়িয়ে গেলাম। এতে সে রেগে
গেলো।
টেবিলের উপর থেকে সবকিছু ছুড়ে ফেলে দিয়ে
চিৎকার
করে বললো, "তুমি একটা কাপুরুষ।" সেই রাতে
আমাদের
আর কথা হল না। সে সারা রাত নিঃশব্দে কাঁদলো।
হয়তো ও বুঝার চেষ্টা করছিল কেন
আমি এমনটা চাইলাম। কিন্তু
আমি তাকে বলতে পারিনি যে, আমি আর
একটা মেয়েকে ভালোবেসে ফেলেছি।
আমি নিজেকে খুব অপরাধী মনে করেছিলাম, আর
ঐ
অপরাধবোধ নিয়েই আমি ডিভোর্স লেটার
লিখলাম,
যেখানে উল্লেখ ছিল, আমাদের বাড়ি, আমাদের
গাড়ি,
এবং আমার ব্যবসায়ের ৩০% এর মালিক সে হবে।
তার
হাতে কাগজটি যাওয়ার
সাথে সাথে ছিঁড়ে টুকরা টুকরা করে ফেললো।
যে মানুষটার সাথে আমি ১০ টা বছর সংসার
করলাম,
আজকে আমি তাকেই আর চিনি না। তার এতগুল সময়,
সম্পদ, এবং শক্তি নষ্ট করার জন্য আমার খুব খারাপ
লাগছিলো, কিন্তু এখন আমি আর তাকে ফেরত
নিতে পারবো না কারণ, আমি ফারহানা কে
ভালোবাসি।
অবশেষে সে আমার সামনে চিৎকার
করে কান্না করে দিল, যা আমি আশা করছিলাম।
আমার
কাছে তার কান্না একরকম মুত্তির চিহ্নের মত
লাগছিল। তখন মনে হচ্ছিল, এবার আমি আসলেও
সফল।
পরের দিন, আমি অনেক দেরী করে বাসায় ফিরি।
দরজায় ঢুকতেই দেখি, ও ডাইনিং রুমে টেবিলে
কিছু
লিখছিল। আমি আর খাবার খেতে গেলাম
না এবং সরাসরি ঘুমাতে চলে গেলাম, কারণ
সারাদিন
ফারহানাকে নিয়ে অনেক ঘুরেছি এবং এখন
আমি ক্লান্ত। আমি ঘুমিয়ে গেলাম। যখন আমার ঘুম
ভাঙ্গলো, তখনো ও লিখছিল। আমি গ্রাহ্য করলাম
না এবং আবার ঘুমিয়ে পরলাম।
সকালে সে আমাকে কিছু শর্ত দিল, যেখানে
লেখা
ছিল,
"আমি তোমার থেকে কিছুই চাইনা, কিন্তু
আলাদা হয়ে যাওয়ার আগে শুধু এক মাস সময় চাই।
এই
একমাসে আমরা জতটুকু সম্ভব স্বাভাবিক জীবন
জাপন
করবো, কারণ আর একমাস বাদেই আমাদের
ছেলেটার
পরীক্ষা। ওর যাতে কোন ক্ষতি না হয় তাই
আমি এমনটা চাইছি।"
আমি মেনে নিলাম। কিন্তু সে আমার কাছে আরও
কিছু
চেয়েছিল... ও আমাকে মনে করতে বললো, বিয়ের
দিন
আমি তাকে যেভাবে কোলে করে নিয়ে ঘরে ঢুকে
ছিলাম।
ও আমাকে অনুরোধ করলো, যাতে এই একমাস
আমি তাকে প্রতি সকালে কোলে করে আমাদের
শোবার
ঘর থেকে বাইরের দরজা পর্যন্ত নিয়ে যাই।
আমি ভাবলাম, ও পাগল হয়ে গেছে। যাই হোক, এই
শেষ
সময়ে যাতে আর ঝামেলা না হয়, তাই আমি তার
অনুরোধ
মেনে নিলাম।
আমি ফারহানাকে আমার স্ত্রির দেয়া শর্তগুলোর
কথা বলেছিলাম। শুনার পর সে অট্ট
হাসিতে ফেটে পড়লো, যা খুবই অযৌক্তিক
লাগলো আমার কাছে। তখন ফারহানা আমার
স্ত্রির
উপর ঘৃণা এবং রাগ নিয়ে বললো, "সে যতই
ছলনা করুক আর মায়া কান্না দেখাক, তাকে
ডিভোর্স
নিতেই হবে।"
আমাদের বিবাহবিচ্ছেদের উদ্দেশ্য স্পস্টভাবে
প্রকাশ
হওয়ার পর থেকে আমার স্ত্রি এবং আমার মধ্যে
আর
কোন শরীরী যোগাযোগ ছিল না। যাই হোক, যেদিন
আমি প্রথম তাকে কোলে তুললাম, তখন আমরা
দুজনেই
খুব বিব্রতবোধ করছিলাম। আমাদের ছেলেটা
পেছন
থেকে তালি বাজাচ্ছিল আর বলছিল, "আব্বু
আম্মুকে কোলে তুলেছে, কি মজা কি মজা।"
ছেলেটার
কথা শুনে কেন জেন আমার খারাপ লাগতে শুরু
করলো।
শোবার ঘর থেকে ড্রইংরুম, ড্রইংরুম থেকে বাইরের
দরজা পর্যন্ত আমি ওকে কোলে করে নিয় গেলাম।
সে তার চোখ বন্ধ করলো এবং ফিস ফিস করে
বললো,
"আমাদের ছেলেটাকে আমাদের ডিভোর্সের
কথাটা
কখনও
জানতে দিওনা।" আমি ওকে দরজার
বাইরে নামিয়ে দিলাম। সে তার কাজে চলে গেল,
আর
আমি অফিসে চলে গেলাম।
দ্বিতীয় দিন, আমরা দুজনেই খুব স্বাভাবিক আচরন
করলাম। সে আমার বুকে মাথা রাখলো। আমি তার
চুলের
গন্ধ পাচ্ছিলাম। আমার মনে হল, আমি কতদিন এই
মানুষটাকে একটু ভালোভাবে দেখিনি, বুঝার
চেষ্টা করিনি। দেখলাম, ওর কত বয়স হয়ে গেছে।
চেহারায় বয়সের ছাপ পড়ে গেছে... চুলে
কাঁচাপাকা রঙ
ধরেছে। কিছু মুহূর্তের জন্য মনে হল আমি তার
সাথে কি করেছি।
চতুর্থ দিন, যখন আমি তাকে কোলে তুললাম, তখন
বুঝতে পারলাম আবার আমাদের অন্তরঙ্গতা ফিরে
আসছে।
এটাই সেই মানুষ, যে তার জীবনের ১০ টা বছর
আমার
সাথে পার করেছে। পঞ্চম এবং ষষ্ঠ দিন আমার
আবারো মনে হল যে, আমাদের সম্পর্কটা আবার
বেড়ে উঠছে। আমি এসব বিষয়ে ফারহানাকে কিছুই
বলিনি।
যতই দিন যাচ্ছিল, ততই খুব সহজে আমি আমার
স্ত্রিকে কোলে তুলতে পারতাম। সম্ভবত, প্রতিদিন
কোলে নিতে নিতে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল।
একদিন
সকালে বাইরে যাওয়ার জন্য সে পছন্দের কাপড়
খুঁজছিল। প্রায় অনেকগুলো কাপড় সে পরে দেখল,
কিন্তু একটাও তার ভালো লাগছিলো না। সে স্থির
হয়ে বসলো এবং দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বললও,
"আমার
সব গুলো কাপড় ঢিলে হয়ে গেছে...।" তখন
আমি বুঝতে পারলাম সে অনেক শুকিয়ে গেছে এবং
এ
জন্যই আমি তাকে খুব সহজে কোলে তুলতে
পারতাম।
হঠাৎ এটা আমাকে খুব আঘাত করলো... সে তার
মনে অনেক কষ্ট চাপা দিয়ে রেখেছে। মনের
অজান্তেই
আমি আমি ওর কাছে যাই এবং ওর মাথায় হাত দেই।
ঐ
মুহূর্তে আমাদের ছেলেটাও চলে এল এবং বললও,
"আব্বু,
আম্মুকে কোলে তুলার সময় হয়েছে।" আমার
স্ত্রি ছেলেটাকে ইশারায় কাছে আসতে বলল
এবং তাকে কিছুক্ষণের জন্য খুব শক্ত
করে জড়িয়ে ধরল। আমি অন্য দিকে তাকালাম,
কারণ
আমার ভয় হচ্ছিল, এই শেষ মুহূর্তে জেন আমার
সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর
আমি তাকে কোলে নিলাম। শোবার ঘর থেকে
ড্রইং রুম,
ড্রইং রুম থেকে বাইরের দরজা পর্যন্ত
তাকে নিয়ে গেলাম। সে তার হাত
দিয়ে আলতো ভাবে আমার গলা জড়িয়ে ছিল।
আমিও
তাকে খুব হাল্কাভাবে কোলে নিয়ে ছিলাম...
ঠিক
জেন
বিয়ের প্রথম দিনের মত।
কিন্তু তার এই এত হাল্কা ওজন আমাকে অনেক কষ্ট
দিয়েছিল... প্রায় অনেক আগে যেদিন
আমি তাকে কোলে নিয়েছিলাম, সেদিন
তাকে নিয়ে কিছু দূর হাটতেই আমার অনেক কষ্ট
হচ্ছিলো। আমাদের ছেলেটা স্কুলে চলে গেছে।
আমি আমার স্ত্রিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে
বললাম,
আমি বুঝতে পারিনি যে, আমাদের
মধ্যে এতটা অন্তরঙ্গের অভাব ছিল। এ কথা বলেই
আমি অফিসে চলে গেলাম। অফিস থেকে ছুটি
নিয়েই
বেরিয়ে গেলাম। চলে গেলাম সোজা ফারহানার
বাসায়।
সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত উপরে উঠে গেলাম। আমি খুব
তাড়াহুড়ো করছিলাম, ভয় পাচ্ছিলাম যাতে আমার
মন
আবার পরিবর্তন হয়ে যায়। ফারহানা দরজা খুলতেই
আমি তাকে বললাম, "ফারহানা, আমাকে মাফ করে
দিও...
আমি আমার স্ত্রির সাথে ডিভোর্স চাইনা।"
ফারহানা আমার দিকে খুব অবাক হয়ে তাকাল এবং
আমার
কপালে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, "আচ্ছা তুমি
ঠিক
আছো তো?? তোমার কি জ্বর আসছে??" আমি ওর
হাত
আমার কপাল থেকে সরালাম এবং আবারো বললাম,
"ফারহানা, আমি ওকে ডিভোর্স দিতে চাই না।
তুমি পারলে আমাকে মাফ করে দিও। আমাদের
বৈবাহিক
সম্পর্কটা হয়তো বিরক্তিকর ছিল, কারণ
আমরা আমাদের জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুহূর্ত
গুলোকে মুল্য দেইনি, কিন্তু এর মানে এই
না যে আমরা কখনো একে অপরকে ভালোবাসিনি।
কিন্তু এখন আমি বুঝি যে, যেদিন
আমি তাকে বিয়ে করেছিলাম, সেদিন
আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যে মৃত্যু পর্যন্ত
আমি তার সাথে থাকবো।" তখন ফারহানা আমাকে
খুব
জোরে একটা চড় মারলো এবং আমার মুখের উপর
দরজা লাগিয়ে দিয়ে ভেতরে চিৎকার করে
কান্নায়
ভেঙে পড়লো। আমি বাসার নিচে নেমে এলাম
এবং চলে আসলাম। পথেই একটা ফুলের দোকান
পেলাম
এবং একটা ফুলের তোড়া কিনলাম আমার স্ত্রির
জন্য।
আমাকে দোকানদার জিজ্ঞেস করলো, "স্যার
কার্ডের
উপর কি লিখবো?" আমি একটু মৃদু হাসলাম
এবং লিখতে বললাম, "আমি প্রতিদিন
সকালে তোমাকে কোলে নিব... আমার মৃত্যু পর্যন্ত"
ঐ দিন সন্ধ্যায় আমি বাসায় ফিরি, আমার হাতে
ফুলের
তোড়া, আমার চেহারায় সুখের হাসি, আমি সোজা
আমার
শোবার ঘরে চলে যায় এবং দেখি আমার স্ত্রি আর
নেই। সে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে... সারা
জীবনের
জন্য
চলে গেছে... যেখান থেকে আর কখনো ফেরা
সম্ভব না।
আমার স্ত্রির ক্যান্সার ছিল, অথচ
আমি ফারহানাকে নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে,
এদিকে কোন খেয়ালই করিনি।
সে জানতো যে সা মারা যাচ্ছে... কিন্তু
সে আমাকে বুঝতে দেয়নি, কারণ আমাদের ছেলের
পরীক্ষা ছিল এবং আমাদের ডিভোর্স
হয়েছে এটা জানলে আমাদের ছেলেটার মন-
মানষিকতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
সে মারা গেলে আমাদের আর
আলাদা হয়ে বেঁচে থাকতে হবে না। সে আমার
ছেলের
কাছে প্রমান করে দিয়ে গেল, আমি খুব
ভালো স্বামী ছিলাম, যে তার স্ত্রির অনেক
খেয়াল
করতো।
সম্পর্কের এই ছোট ছোট ব্যাপারগুলো আসলেও
অনেক
গুরুত্বপূর্ণ। এই বড় রাজপ্রাসাদ, গাড়ি, সম্পত্তি,
টাকা এগুলো সব কিছুই ভালো থাকার পরিবেশ
তৈরি করে কিন্তু নিজেরা কোন সুখ দিতে পারে
না।
তাই কিছু সময় বের করুন আপনার স্বামী বা স্ত্রির
জন্য। তার বন্ধু হন। এবং কিছু কিছু ছোট ছোট
মুহূর্ত তৈরি করুন যা আপনাদের সম্পর্ককে আরও
কাছের করবে। কারণ, এটাই সত্য "পরিবার
পৃথিবীতে সব চাইতে দামি।" আপনি যদি এখন কোন
সম্পর্কতে নাও থাকেন, তারপরেও দ্বিতীয় বারের
মত
অথবা তার চাইতেও বেশী চিন্তা করুন, কারণ
এখনো দেরী হয়ে যায় নি... এখনো অনেক সময়
আছে।
[লেখাটি সংগৃহিত....ভালো লাগলো তাই এখানে শেয়ার করলাম]
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)