
শৈশব কৈশোরের সন্ধিক্ষণের একটিমাত্র ঘটনা একটি মেয়েকে সটান দাঁড় করিয়ে দেয় এমনি এক বাস্তবতার সামনে; 'ময়না, তুই একটা মেয়ে'!
ময়না তখন হয়ত সাইকেল চালায়, কিংবা দেয়াল বেয়ে কারও অনাবাদী প্লটের ভেতরের টিনশেড ঘরে কি কি মালপত্তর আছে, তা দেখতে পা বাড়িয়েছে। বড় হয়ে যাবার সেই সত্যটি হয়ত সেই সন্ধ্যায় তাকে বলা হয়েছিলো, যে বিকেলেই ব্যডমিন্টনের র্যকেট দিয়ে সাথের ছেলেটিকে আচ্ছামতন পিটানোর পর তাকে আপেল দিয়ে মুখ হাসি করিয়ে দেয়ার জন্য মায়ের কাছে আবদার ধরেছিলো সে। ফলাফল? আরও আধঘন্টা বেশী খেলে ঘর্মাক্ত কলেবরে বাসায় ফেরা। আর বড় বোন পা ধুয়ে মশার কামড়ের দাগে পাউডার দিয়ে দিতে বাধ্য।
ময়নার শৈশব তাই অন্য সবার মতই সাধারণ হতে গিয়েও অসাধারণ হয়ে গিয়েছিলো। ময়না বড় হয়েছিলো, ঠিক, কিন্তু কিছু মায়ার হাত অসম্ভব মমতায় সে বড়ত্বকে ওর মাঝে সযত্নে রোপণ করে দিয়েছিলেন, যাঁদের নিজেদের বড় হবার গল্পগুলো হয়ত একদমই আলাদা! সেই অপূর্ণতাই হয়ত তাঁরা ভুলতে চেয়েছেন ময়নাকে দিয়ে।
ময়না কলোনীর রাস্তাময় খেলে বেড়ায়। 'রঙ রঙ' খেলার সময় রিকশা ওয়ালাকে থামিয়ে যাত্রীর জামা ধরে চেঁচায়, 'পাইসি বেগুণী রঙ''। কারও ছাদে লুকিয়ে উঠে আটকে গিয়ে চিৎকার করে গলা ফাটায়, না হয় ছাদে রাখা বালু দিয়ে 'বোমবাশটিং' বানিয়ে রাস্তায় যাওয়া মানুষ তাক করে করে ছুঁড়ে। ময়নার হাঁটুভরা দাগ, খেলতে গিয়ে রাস্তায় ছেঁচড়ে রক্ত বের হওয়ার। সে পড়তে বসে ক্যলকুলেটর দিয়ে আলো ফিরিয়ে পাশের বাসার পাজির হতচ্ছাড়িটাকে ডেকে বেড়ায়। তাতে কি? কোনমতে পাশ করে করে বার্ষিক পরীক্ষা উৎরে যাওয়া নীলজোছনাকে বাবা মা ছাড়েন না।
কালো মেয়েটা ঘর আলো করে না থাকুক, মাঝে মাঝে কথা তো শোনে। ঠোঁটের আগায় যা আসে, তা-ই বলতে পারা মেয়েটাকে বকেঝকে সুপথে রাখতে চাইলেও তাঁদের কথার মাঝে লুকানো স্নেহ কেমন করেই যেন ধরে ফেলে দস্যিটা। বইয়ের ভাঁজে বই নিয়ে পড়তো আগে, বকা খেয়ে সে এখন টানটান করে চুল বেঁধে টেবিলেই গল্পের বই নিয়ে বসে। জিগেস করলে ঠান্ডা উত্তর, পড়া শেষ! কার সাধ্য ওকে ছোঁয়? বাবামায়ের চোখের সামনেই 'বড়'দের উপন্যাস পড়ে ফেলে। দাঁত ওঠা ইঁদুরের মত, সামনে যা পাচ্ছে তা-ই পড়ে ফেলছে। ডানোর টিনের বিত্তান্ত পড়তে গিয়ে দুধ উথলে ফেলে মায়ের বকুনি শোনে ঠিক, আবার পর্দার আড়াল থেকে বাসায় আসা কারুর কাছে সে ঘটনার সস্নেহ বর্ণণা শুনে সে বকা ভুলতেও দেরী করে না।
আর কিছুদিন পর। নীলজোসনা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে। মনের মধ্যে থিরথির কাঁপন তুলে একসময় পা রাখে ছোট্ট কিন্তু মায়াভরা ক্যম্পাসে। দুইদিন না যেতেই একই শহরের মেয়ে হয়েও ভার্সিটির হলে গিয়ে ওঠে স্বাধীনচেতা মেয়েটা। বাবা- মা- বড় বোন- বড় ভাই বকেন ঠিকই। আবার দিনেরাতে গিয়ে দেখেও আসেন। রাত দুইটা কি তিনটায় হলের ফুলঘেরা বাগানে হাত পা ছড়িয়ে ক্রস হয়ে আকাশে কী দেখে কে জানে! চেনাশুনা যারা তারা বলে, পাগলী! রাত দশটায় গেট বন্ধ হবার ঠিক আগ মুহূর্তে দারোয়ান মামার মুখে 'কিন্তু' ঝুলিয়ে তুফান বেগে বের হয়ে যায় মেয়েটা মাঝে মাঝে, মায়ের ঘ্রাণ পেতে। বাসায় এসে বাবার বকা মায়ের শাসন কিছুতেই মুখের হাসিটা মুছে যায় না।
শুধু একবার, বাবার ড্রয়ারে নিজের ছবি আর অফসেটে প্রিন্ট দেয়া সিভি দেখে হাসি মুছে যায়, ছিঁড়ে কুটি কুটি করে হলেই পালিয়ে যায়, ঝুঁকি না নিয়ে। বাবা হাঁক দেন, 'আনো ওকে হল থেকে। অইখানে থেকে থেকে এমন পাজী হয়েছে।' দুষ্টু মেয়েটার কানে এই কথা কে তুলবে। চাপা পড়ে যায় প্রসঙ্গটা সেখানেই। যদিও, একদিন, নিজেই তল্পিতল্পা গুটিয়ে সংসার করতে আসে মেয়েটা। অনিচ্ছায় না, রীতিমত মহা আনন্দে। কিভাবে যেন আরেকটা জানালা খুঁজে পেয়েছে ও, উদার, ভালোবাসাময়। পৃথিবীটাকে খুঁজে নেয়ার দ্বিতীয় পর্বের কাজ শুরু করতে হবে, মায়াভরা কন্ঠে মা ডাক শোনার তো এইই তো সময়।
ও হো, দেখ দেখি, কখন ময়না আর নীলজোসনা এক হয়ে গেছে, খেয়ালই করিনি। জীবনের গল্প হয়ত একই দুজনের।
নীলজোসনা আজকে জানে, সে সবার আগে একজন মানুষ। মর্যাদা খোঁজার জন্য হাত মুঠি করে উঠাতে হয়নি তার। বাবার পকেট থেকে কষ্টের টাকায় যখন তাকেও শিক্ষিত করে তোলা হয়, দেয়া হয় আত্নমর্যাদার অনুভূতি, তার পোশাকে -কথায় পরিচয় দিতে শেখানো হয় রুচির, তখন নীলজোসনারা বোঝে, জী আমিই মানুষ। তাকে জীবনসঙ্গী করে নেয়ার জন্য যখন একজন পবিত্র মানুষ তার বাবার কাছে আর্জি পেশ করেন, আলোআঁধারী রেস্টুরেন্টে বসে তাকে প্রলুব্ধ না করে সিজদায় আল্লাহর কাছেই চান, তখন গায়ের রঙয়ের পার্থক্য ওকে হীনমন্যতায় ডুবিয়ে দেয় না। আর তাই,অপারেশন থিয়েটারে যাবার আগে ভালোবাসার মানুষগুলোর চোখের পানি আর ছোটছোট হাতগুলোর স্পর্শ তাকে ভুলিয়ে দেয় নতুন করে বড় হবার স্বপ্ন।
যে বড় হয়েই জন্মেছে, তার আবার বড় হতে হয়?
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)