ফিল্ম ও মিডিয়া

মোবাইলে বন্ধুত্ব এবং ভিটামিন T বিতর্ক…

মোবাইলে বন্ধুত্ব এবং ভিটামিন T বিতর্ক…
প্রয়োজনের তাগিদে প্রযুক্তির যেমন ব্যবহার বাড়ছে তেমনি- বর্তমানে যোগাযোগের একটা সহজ মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে মোবাইল। তাই বাড়ছে সিমের প্রয়োজনীয়তা। তবে মাঝে মধ্যেই প্রশ্ন তুলতে ইচ্ছে হয়- ১৬ কোটির ছোট এই দেশে নেটওয়ার্ক কাভারেজের জন্য কয়টা সিম কোম্পানীর প্রয়োজন? যদিও এর বিপরীতে যুক্তি হলো- বিদেশী (দেশী কোম্পানী মাত্র একটি-টেলিটক) এসব কোম্পানী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে। তাই, সাংখ্যিক বিচার যদি নাও করি তবে বাস্তবতার বিচারে এবং যুব সমাজের স্বার্থে সিম কোম্পানীর ব্যবসায়িক নীতি নিয়ে সমালোচনা করলে বোধ হয় অতিরিক্ত হবে না। বিদেশী চারটি  সিম কোম্পানীঃ গ্রামীনফোন, বাংলালিংক, সিটিসেল এবং এয়ারটেল-এসবের মধ্যে সবচেয়ে বিতর্কিত হলো- এয়ারটেল। যখন থেকে ওয়ারিদ (016...) কোম্পানীর শেয়ার এয়ারটেল (ভারতীয় কোম্পানী-পূর্ণ নামঃ ভারতী এয়ারটেল লিমিটেড) কিনে নেয় এবং দেশব্যপী প্রচার প্রচারণা শুরু করে তখন থেকেই লক্ষ্যণীয় কোম্পানীটি যেনো সাংস্কৃতিক ভাবে আমাদের ঐতিহ্যের বাইরে ভিন্ন কোনো course complete করাতে এসেছে। শুরু থেকেই পর্যালোচনা  করে বললে- আমাদের দেশে যেখানে অধিকাংশ মেয়েরা সালওয়ার- কামিজ (সাথে ওড়না) পরে চলাফেরা করে সেখানে এয়ারটেল তার বিজ্ঞাপনে মেয়েদের টপস আর টাইট জিন্স পরিয়ে দেখায়। শুধু তাই নয়- আধুনিকতা ও তারুণ্যের মোড়কে তরূণ যুবকদেরও উদ্ভট স্টাইল ও অশালীনভাবে উপস্থাপন করে। তাদের মানসিকতা বুঝানোর জন্য একটা মেসেজ তুলে ধরছি।  From-20777, “Happy friendship day… নতুন নতুন বন্ধু বানাও আর আড্ডায় মেতে ওঠো! টাইপ BS অথবা ভিজিট করো https://moza.mobi/hibuddy/ …ফ্রি এসএমএস তো আছেই”!  সেই সাথে নিচে কিছু মেয়েদের নাম, বয়স ও জেলা দেয়া। উদাহরণ- পিয়াসি (১৯), স্পাইসি লেডি(২৭), লোনলি গার্ল(১৯), জলকণা(২৪), হাউজওয়াইফ(২৯)…ইত্যাদি। এদিকে তাদের দেয়া লিঙ্কে গিয়ে দেখা যায়- আরো কিছু মেয়ের নাম, ও রেজিস্ট্রেশন করার অপশান, সেই সাথে নিচে বলিউডি অভিনেত্রীদের অশ্লীল ছবির (পর পর কয়েকটা পেইজে) ডাইনলোড লিঙ্ক। বিষয়টা বিশ্লেষণ করে বলতে- প্রথমত, এটা আমরা সবাই জানি- অপরিচিত কারো সাথে গোপনে কথা বলা সম্পূর্ণ অনৈতিক। সেটা মোবাইলে হোক কিংবা ক্যাম্পাসের কোনো কোণায়। এতে পাপ কাজে জড়িয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। কারণ আমরা জানি না, শয়তান কখন কাকে দিয়ে কি করিয়ে ফেলবে। পত্রিকায় প্রায়ই দেখা যায়- মোবাইল প্রেমের ফাঁদে পড়ে নিজের সর্বস্ব হারানোর কথা কিংবা মোবাইলে পরিচয়, তারপর ভালোবাসা, অতঃপর ভাঙ্গন কিংবা আত্মহ...। তাছাড়া সবচেয়ে সহজভাবে বিবেচনা করে বলতে হয়- মোবাইলের মাধ্যমে এক অপরিচিতের ব্যাপারে কখনো আমরা সঠিক কিছু জানতে পারি না। অপরপক্ষ আমাদের সামনে নিজেকে অনেক ভালো বলেই প্রকাশ করবে আর আমরা আবেগের বশে  সেটাতেই বিশ্বাস করবো- তাছাড়া না দেখা মানুষটির বাস্তবতা মোবাইলে জানা সম্ভব নয়। তাই, স্বাভাবিকভাবেই বিবেকবান  নাগরিক কেউ চাইবে না প্রযুক্তির কাছে জিম্মি হয়ে নিজের জীবনকে ধ্বংস করতে। তাছাড়া অপরিচিত বন্ধু কখনো আমাদের নিঃসঙ্গতার সাথী হতে পারে না, বরং এরাই আমাদের হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দ্বিতীয়ত, লিঙ্কের অশ্লীল ছবিগুলো মূলত পর্নোগ্রাফীকে প্রমোট করছে। যা সমাজে নারীঘটিত অপরাধ ও বিশৃংখলা ছড়ানোর জন্য দায়ী। আর এসব কুকর্মে শুধু যে নারী মর্যাদা ক্ষুন্ন হয় তা না বরং পুরুষ অধিকারও হরণ হয়- কারণ এতে ছেলেদের মেধা, কর্মশক্তি ও চরিত্র- সবই ধ্বংস হয়ে যায়। সুতরাং, এসব উদ্ভট অফার কিসের জন্য? যাতে সমাজে ধ..., পরকিয়া, ব্যভিচার বাড়ুক? এদিকে যে,  মা-বাবারা তাদের সন্তানদের সাথে যোগাযোগের সুবিধার্থে মোবাইল কিনে দেন, পরে এসব অফারের ফাঁদে যখন খোদ সন্তানেরাই জড়িয়ে পড়ে তখন যেনো প্রযুক্তির কাছে জিম্মি হয়ে যান মা-বাবারাই। তাদের আফসোস করা ছাড়া আর কোনো  উপায় থাকে না। তাই সচেতন নাগরিক হিসাবে এসব মনভোলা অফার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে আমাদেরই। “ প্রকাশ্য বা গোপন কোনো অশ্লীলতার কাছেও যেও না”- সূরা আন’আম, আয়াতঃ ১৫১। এবার, আরেকটা মেসেজ বিশ্লেষণ করার জন্য তুলে ধরছি- এক শুক্রুবারের মেসেজঃ “ইনজয় ফ্রাইডে! হাজারো বন্ধু-বান্ধবী আছে তোমার অপেক্ষায়… তোমার নাম সেট করো তাড়াতাড়ি! আর এয়ারটেল প্রযোজিত টেলিফিল্ম ‘ভিটামিন T কুইজ খেলে জিতে নাও মোবাইল সেট”। প্রথমেই বলবো- শুক্রুবারটা মুসলমানদের জন্য ধর্মীয়ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ ও গুরুত্ব বহন করলেও প্রচারণার অভাবে দিনটা হয়ে গেছে নিছক ছুটির দিন। তাই, এই দিনকেই ঘিরে থাকে হাজারো অফার। তাই শুক্রুবার তথা জুম’আর দিনের তাৎপর্য উল্লেখ করে কুর’আনের আয়াত ও হাদিস দিলে হয়ত উপযুক্ত হবে। “মুমিনগণ, জুম’আর দিনে যখন নামাযের আযান দেয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের দিকে দৌড়াও এবং বেচাকেনা পরিত্যাগ করো। এটা তোমাদের জন্যে উত্তম যদি তোমরা বুঝো” (সূরা জুম’আ, আয়াতঃ ৯)।তাছাড়া আবু হুরাইরা রাঃ হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাঃ এই দিন সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন- এ দিনে এমন একটি মুহূর্ত আছে, যে কোনো মুসলিম যদি এ সময় সালাতে দাঁড়িয়ে আলাহ’র নিকট কিছু প্রার্থনা করে, তবে তিনি তাকে অবশ্যই তা দিয়ে থাকেন …(বুখারি,জুম’আ অধ্যায়)।সুতরাং- এই অজ্ঞ জাতি যেখানে তাৎপর্যই জানে না সেখানে যেনো এসব অফার তাদেরকে আরো ভুলিয়ে রাখছে। এদিকে  ভিটামিন-T কুইজ খেলার কথা যেহেতু উঠেছে, তাই এই টেলিফিল্মটার ব্যাপারে কিছু ধারণা দেয়া কর্তব্য মনে করি। মূলত, ভার্সিটি পড়ুয়া তরূণদের নিয়ে এই টেলিফিল্ম। তবে তারূণ্যের কথা বলে এতে মূলত ছেলেমেয়েদের ফ্রি-মিক্সিং, অবাধ ঘুরা-ফেরা এবং মা-বাবার অনুমতির অগ্রাহ্যতাকেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে- যা এদেশের ধর্ম, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ পরিপন্থি। পারষ্পারিক বন্ধুত্ব হলে একটা ছেলে-মেয়ের মধ্যে আলিঙ্গন হওয়াটা- এখানে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখানো হয়েছে। যদিও আমরা জানি- বিয়ের আগে বয়ফ্রেন্ড/গার্লফ্রেন্ড রাখা, তাদের সাথে অবাধ মেলামেশা-মূলত চরিত্র নষ্ট করতে পারে। অনেকেই এক্ষেত্রে যে যুক্তি দেখান- তাহলোঃ “এভাবে আমরা ছেলে-মেয়ে লিঙ্গভেদে বৈষম্য করছি, এটা ঠিক না”।  তাদের উদ্দেশ্যে বলতে- ছেলে-মেয়েরা যখন প্রাপ্তবয়ষ্ক হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই অপর লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে। তাই কো-এডুকেশনে পড়তে গিয়ে বা চাকরি জীবনে অবশ্যই পাশের ছেলে/মেয়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা উচিত, প্রয়োজনে কথা বলা উচিত আর ক্লাসে সহপাঠী রূপে আচরণ করা উচিত। তবে তাই বলে- অতিরিক্ত ও অবাধ মেলামেশা হলে সেটা মূলত সহপাঠী বা সহকর্মী হিসাবে থাকে না, তখন সেটা ভিন্ন দিকে গড়ায়। যেটাকে সহজে নাকোচ করার পথ থাকে না। তাই স্বাভাবিক দুরত্ব বজায় রেখে নিজেকে ও নিজের চরিত্রকে নিরাপদে রাখা ভালো। এদিকে, আমাদের ভদ্র সমাজে কখনো ভুল বশত কারো গায়ে স্পর্শ লাগলেও আমরা দুঃখ প্রকাশ করি- এটাই ভদ্রতা, অথচ এই টেলিফিল্মে- শেখানো হয়েছেঃ ভার্সিটিতে যাও, বন্ধু বানাও, জড়িয়ে ধরো-এটাই মুক্তচিন্তা, আধুনিকতা। এছাড়া দেখানো হয়েছেঃ “ঢাকা থেকে কক্সবাজার দূরত্বে বন্ধুদের সাথে যেতে মা-বাবার অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন নেই। আর মা-বাবাদের সাথে ঘুরতে যাওয়া যেনো- দুগ্ধপোষ্য শিশু!” এক্ষেত্রে বলবো- পৃথিবীর বিভিন্ন সম্পর্কের মজা বিভিন্ন রকম। বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে এক ধরণের অনুভূতি থাকে তেমনি মা-বাবাদের সাথে ঘুরতে থাকে অন্য রকম অনুভতি। কিন্তু তাই বলে- এমন নয় যে- হাত-পা বড় হয়ে যাওয়ার পর আমরা মা-বাবা’র অনুমতি ও তাদের সঙ্গ ত্যাগ করবো। বরং তাদের প্রতিও আমাদের দায়-দায়িত্ব আছে। তারাও আমাদের সাথে কিংবা বিপরীতভাবে  বলতে ফ্যামিলির ট্যুরও আমাদের পারিবারিক বন্ধনকে মজবুত করে। তাই মা-বাবাদের সঙ্গকে অগ্রাহ্য ও টিটকারি দেয়া উচিত নয়। এদিকে অবশ্যই আমাদের অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের (ছেলে-মেয়ে উভয়েরই) নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে অনেক সময় অধিক দূরত্বে যেতে বারণ করেন। আবার অনেক সময় রাজিও হয়ে যান (আশেপাশের জায়গায় একসাথে বান্ধবী মিলে যেতে দেন)। আর আমরা তাদের অনুমতি চাই- মানসিক স্বস্তি ও ভরসার জন্য। আর এটা বিবেচনা করেই এক জেলা থেকে ভিন্ন জেলায় যাতায়াতে সন্তানদের সাথে ভরসাযোগ্য কাউকে সাথে দিয়ে দেন, সম্ভব হলে নিজেই সাথে নিয়ে যান কিংবা নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। সুতরাং,  ভিটামিন T-তে ছেলেমেয়েদের একসাথে অভিভাবক ছাড়া দূরে কোথাও ভ্রমণে যাওয়ার যে মনগড়া থিউরি দিয়েছে তা সম্পূর্ণ অসভ্যতা। সবশেষে এসব উদ্ভট অফার ও টেলিফিল্ম আমাদের স্বাভাবিক জীবনকে অস্বাভাবিক করার জন্য দায়ী। তাই এয়ারটেল কোম্পানীর উচিত- যে দেশে তারা ব্যবসা করতে এসেছে সে দেশের ধর্ম- ঐতিহ্যের প্রতি খেয়াল রাখা। অন্যথায় সাধারণ জনগণ তাদের সিম ব্যবহার থেকে নিরাপদ থাকতে বাধ্য হবে। বাস্তবে এমন অফারগুলোতে অতিষ্ট হয়ে আমার এক আত্মীয় এয়ারটেল সিম ব্যবহার ছেড়ে দিয়ে অন্য সিম নেয়। তাই আশাকরি- কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে সজাগ হবে।

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
লেখকের অন্যান্য ব্লগ সবগুলো দেখুন