অনির্ধারিত

"বাবা বলে গেলো, আর কোনদিন গান কোর না! "

"বাবা বলে গেলো, আর কোনদিন গান কোর না! "
গান শুনতাম তখন। এক রাতে, পাশে খোলা জানালায় হু হু বাতাস, হেডফোনে রেডিও টুডে।আর সামনে মেকানিক্স অফ সলিডস। দরাজ কন্ঠে একজন গেয়ে উঠলেন, “আমি তোমাকেই বলে দেব, কি যে একা দীর্ঘ রাত, আমি হেঁটে গেছি বিরান পথে আমি তোমাকেই বলে দেব, সেই ভূলে ভরা গল্প, কড়া নেড়ে গেছি ভূল দরোজায় ছুঁয়ে কান্নার রঙ, ছুঁয়ে জোছনার ছায়া” খুব মনে আছে, কেঁপে উঠেছিলাম। এভাবেও চাওয়া যায় জীবনসঙ্গীকে? এতো আকুতি দিয়ে? একলা জীবনের দীর্ঘ রাতগুলো, না বলা কথার অশ্রু দিয়ে সাজানো ক্ষণগুলো আসলেই কেউ শুনবে কোনদিন? এখানে একটা কথা বলে যাই, সঞ্জীবের চলে যাওয়াটা এই গানটাকে মাথায় এক্কেবারে পাঞ্চ করে দিয়েছিলো। ২০০৭ এ, সিডরের সেই ভয়াবহ রাতে সঞ্জীবের মাথায় হেমারেজ হয়। তাঁর স্ত্রী, সেই রাতে কোন যানবাহনের ব্যবস্থা করতে পারেন নি, পরেরদিন আইসিইউতে নেয়া হলেও শিল্পী দুদিন পর চলে যান। অভিমানী এই গায়ক, জানিনা, কাউকে বলতে পেরেছেন কি না, তাঁর একা হেঁটে যাওয়া শেষ রাতটার কথা!   আর একটা গান, খুব মনে আছে, অঞ্জন দত্তের, আমার কলেজ পড়ুয়া মনে কিছু উত্তর না পাওয়া প্রশ্ন তৈরী করতে পেরেছিলো। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’। ভাগ্যের খোঁজে ক্যলিম্পং ছেড়ে কলকাতায় এসে দারোয়ানের পোশাকে চাপা পড়ে যাওয়া একটা সাধারণ ছেলের গল্প সেটা। কাল্পনিক ট্যুরিস্টকে ভালোবাসার মেয়েটিকে দেখে আসার অনুরোধ করতে গিয়ে নিরাশার দোলাচলে দুলতে থাকে ছেলেটি। তার কাঞ্চন কি বস্তির ড্রাইভার চিকমীকে বিয়েই করে ফেললো? প্রতিদিন ক্লান্ত হয়ে ঘুমের কোলে  ঢলে পড়ার আগ মুহূর্তে ট্যুরিস্টের দিকে কল্পনার হাত বাড়িয়ে তুলে দেয় তার কষ্টে জমানো সত্তর টাকা; কেন? “আর যদি দেখো তার কপালে সিঁদুর, বোলো না কিছুই তাকে আর শুধু এই সত্তর টাকা তুমি যদি পারো তুলে দিও হাতে তার। ট্রেনের টিকিটের টাকাটা সে দিয়েছিলো কানের মাকড়ি বেচে ভালোবাসার দাম তুমি দিয়ে দিও আ্মার কাঞ্চনকে...” বোকার মত ভাবছিলাম, এখনও ভাবি, এ কেমন অনুভূতি? কি অনুভূতির জোরে মেয়েটা কানের দুল বিক্রি করে ছেলেটার ভাগ্যন্বেষণের রসদ জোগালো?   গান, ভালোবাসার এক অনিবার্য অনুষঙ্গ। শুধু সুরের জন্য যারা গান শুনেন, তাদের বরং সুবিধা, শুনতে শুনতে অন্য কাজে মন দেয়া যায়। ঘাড় মাথা নাড়িয়ে সুরের সাথে তাল দিলেই হল। আর আমার মত যারা লিরিক দেখে গান বাছাই করেন? বিরাট বিপদ। গানের কথা সুরের পাগলা ঘোড়া আপনাকে কোত্থেকে কোথায় নিয়ে ফেলবে এ ব্যপারে সাবধান আছেন তো?   প্রতিটি বস্তুর একটি নিজস্ব ছন্দ আছে। এর নাম ambient frequency.  মজার ব্যপার হল, এই ছন্দ তার পারিপার্শ্বিকতার সাথে সাথে বদলে যায়। ব্রাজিলের ঘন জঙ্গলের একটি ম্যকাও পাখির ডানার ছন্দটি সুন্দরবনের কেয়াগাছের পাতার ছন্দের চেয়ে আলাদা, আলাদা আপনার জানালার কৌতুহলী দোয়েলটির পুচ্ছের ছন্দ। এই  ছন্দ আপনি আমি টের না পাই, সলীম আলী টের পেয়েছিলেন, সাধারণ প্রাণিবিদ থেকে হয়ে উঠেছিলেন পক্ষী বিশারদ। সমুদ্রের ঢেউয়ের ছন্দকে বুকে ধারণ করতে লক্ষ লক্ষ নাবিক জীবনের শেষ নিঃশ্বাস এর বুকে ফেলতে চায়, শেষ আর একবারের মত কোন জাহাজে খালাসীর চাকরী নিয়ে পাড়ি জমায় গভীর সমুদ্রে।   আপনি যে গানটি ছেড়ে দিয়ে কাজ করতে ভালোবাসেন, আর যে গানের সুরে গভীর রাতে জীবনের মানে খোঁজেন, সে গানগুলো এক না হলেও সে গানগুলোর সবগুলোই কোন না কোনভাবে আপনার ambient frequency র সাথে কিছুটা মিলে যায়। এই ‘কিছুটা’ শব্দটা মনে রাখু..., আসছি এর কথায়। যা হোক, কিন্তু যখনই আপনি এদের দিয়ে মোহাচ্ছন্ন হয়ে যান, দীর্ঘ দিন ধরে দীর্ঘ সময় ধরে সুরের সংস্পর্শে থাকেন, আপনার ambient frequency টি চুম্বকাবিষ্ট কম্পাসের কাঁটার মত একটু দিশেহারা হয়ে পড়ে। দীর্ঘসময় ধরে এই সংস্পর্শ আপনার স্বকীয়তাধারী ফ্রিকোয়েন্সীকে একটু একটু করে বিচ্যূত করতে থাকে।   তাতে ক্ষতি? আসেন, ‘কিছুটা’ শব্দের ব্যখ্যায় আসি।   দুইটা সুর এক্কেবারে খাপে খাপে মিলে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। একই সাথে প্রায় একই একই রকম দুটি সুর বাজালে যেটুক অমিল থেকে যায়, সেইটুকু একটা ঘাটতি হিসেবে আপনার মস্তিষ্ক জমা করে রাখতে থাকে। একসময় সে থেকে ছোটখাটো মানসিক বৈকল্য দেখা দিতে পারে, কারণ আপনার নিজের সুরটিও আর শুরুর সেই অবিকৃত অবস্থায় নেই, যার সাথে আপনার সকল শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রম টিউন করা ছিলো। ঠিক যেমন একটি অর্কেস্ট্রাতে হয়, প্রতিজন বাজিয়েই জানে কখন তার শুরু এবং কোন ছন্দে সে এগোবে। আপনার শরীরের সেই অভ্যন্তরীণ ছন্দটি একটু দোদূল্যমান হয়ে পড়ে! আপনার পছন্দের গানটিই আপনাকে এই দোলাচলে ফেলে দেয়ার জন্য দায়ী। আস্তে আস্তে এর ক্ষতিকর প্রভাব আরও বাড়তে থাকে। আপনি তখন সুরনির্ভর হয়ে যান, কানে সারাক্ষণ কৃত্রিম সুরের ছোঁয়া দরকার হয়ে পড়ে আপনার। যা প্রভাব ফেলে আপনার হজমশক্তি, ঘুম, রুচি, মেজাজের ভারসাম্য ইত্যাদীর ওপর। ভয়ের ব্যপার হল, সেই ‘কিছুটা’ পার্থক্যের কারণে এক এক সময়ে আপনার সুরের রুচি বদলে যেতে থাকে।   এবার আসি, গানের অন্য একটি প্রভাবের কথায়। যেটা দিয়ে শুরু করেছিলাম। গানের এই জগত মধুর। যে মধুরতায় আমরা শিখে যাই, আমার জানা উচিত নয় এমন অনেক কথাই। আচ্ছা বলেন দেখি, কেন বাচ্চাদের দাঁত থাকে না জন্মের সময়েই? হতে পারতো না যে দুধের দাঁতসহই আমাদের জন্ম হত? আমরা তাহলে এই দাঁত দিয়ে আমাদের মা’দের কষ্ট দিতাম খাবার সময়, আর হাঁটতে শিখতে গিয়ে বারেবার পড়ে যাবার বয়সটায় হারাতাম অনেক কয়টিই।   পৃথিবীর কোন গানেই বয়স লেখা থাকে না। গানের কথাগুলো যদি বয়স আসার আগেই আমাদের ভেতরের সুপ্ত চাওয়াগুলোকে জাগিয়ে দেয়, তাহলে আমরা কি অকালে পেকে যাওয়া দাঁতওয়ালা শিশুর মত হয়ে যাই না? আপনি যখন শুনেন, Goodbye Michelle my little one You gave me love and helped me find the sun And every time that I was down You would always come around And get my feet back on the ground আপনার একলা মুহূর্তগুলো বা মানসিক দূর্বলতার সময়গুলোতে আপনি একজন মিশেলকে চাইতে থাকেন। হয়ত পাশের ঘরে আপনার বোনও কোন এক অজানা রাজপুত্রের সন্ধানে ব্যস্ত! আপনার মা হয়ত এককোণে বসে আছেন, আপনার মাথায় তাঁর হাতের একটি স্পর্শে আপনাকে সকল অভাব ভুলিয়ে দিতে প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু হায়, আপনি হয়ত ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া’র দলে।   আবার চিন্তা করেন, একটি টিনএজ বালক, যখন ‘মন চাইলে মন পাবে...’ শীর্ষক উস্কানীমূলক গানের জগতে হারাতে চাইবে, তার মনটি প্রাপ্তবয়ষ্ক হবার চেষ্টায় সময়ের আগেই ছটফট করতে থাকবে না? সেই ‘প্রাপ্তবয়ষ্কতা’কে নিজের ভেতরে ধারণ করতে গিয়ে সে হয়ত ঘটিয়ে ফেলবে ভয়ংকর কোন সামাজিক অপরাধ, আর না হয় গোপনেই ধ্বংস করতে থাকবে তার একান্ত জনের জন্য সংরক্ষিত মূল্যবান সম্পদ। প্রমাণ চান? যে কোন পত্রিকায় আইনী সাহায্য বা সামাজিক পরামর্শ দেয়া হয় এমন কলামে পাঠকদের চিঠিগুলো খেয়াল করুন। পরিষ্কার হয়ে যাবে।   ‘আবেগ’- মানুষকে দেয়া স্রষ্টার এক অনবদ্য উপহার। এ আবেগ একটি ঘোড়ার মত। একে প্রশিক্ষণ দিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ শেখালে যে কোন সময়ে এই আবেগ আপনাকে মানুষ হবার শ্রেষ্ঠত্বের স্বাদ পাইয়ে দেবে। আর, যদি এই ঘোড়াকে ছেড়ে দিয়ে ‘কই থেইকা কই লইয়া যাস?’ বলে আস্কারা দিয়ে দেন, জীবনের এক পর্যায়ে গিয়ে হয়ত নিজেকে তুলনা করবেন, গ্যাস ফুরিয়ে যাওয়া কোন বেলুনের সাথে। এক সময়ে উর্ধ্বাকাশে ছুটতে থাকা যে বেলুনটা এখন পথহারা।   সুতরাং গান হোক আমার আপনার চলার পথের নুড়িপাথর, গানের দেখানো পথে যেন না চলি আমরা। গানকে না দিই আমাদের স্রষ্টার দেয়া ছন্দকে বদলে দিতে, বরং সে গানের কাছেই ছুটে যাই, যে গান আমাকে স্রষ্টার কথা মনে করিয়ে দেয়, মানবতার জন্যই আমি এসেছি এই মাটির পৃথিবীতে- এই চিরসত্যকে আমার ভেতরে রোপণ করে দেয় এমন গানই হোক আমাদের অবসরের টুংটাং ধ্বনি। মানবিক ভালোবাসাকে আমরা যেন, ‘আকাশ এতো মেঘলা, যেও না তো একলা’ দিয়ে আটকে না ফেলে, সংজ্ঞায়িত করি এইরকম শব্দ দিয়েঃ ‘কার ঘরে প্রদীপ জ্বলেনি কার বাছার অন্ন মেলেনি কার নেই আশ্রয় বরষায় দিন কাটে ভাগ্যের ভরসায় তুমি হও একজন তাদেরি, কাঁধে আজ তার ভার তুলে নাও ----------------- আজ নয় গুনগুন গুঞ্জন প্রেমের চাঁদ ফুল জোছনার গান আর নয় ওগো প্রিয় মোর, খোল বাহুডোর পৃথিবী তোমারে যে চায়!’

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)