অনির্ধারিত

সাক্ষী

সাক্ষী

ব্যাঙ ডাকা বর্ষায় শিরশিরে বাতাস কাথাঁ গায়ে দেয়া শীত নামিয়েছে। এ বাড়ির লোকজন দশটা বাজার আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আশে পাশে আট দশটা বাড়ি নেই, বিদ্যুৎ এখনো পৌঁছায়নি। দুইটা ঘরে পাঁচজন মানুষ থাকে। ভিটে বাড়ির জায়গা নয় এটা, চাষের জমির এক পাশটায় ঘর তুলেছে সেলিম শেখ। দুর দুরান্তের এলাকা থেকে বন্যায় ভেসে আসা লোকটি এক কানি জমি কিনতে পেরেছিলো। একটু দুরের দু এক‌টি বাড়ির লোকজনের সাথে পরিচিতি আছে সেলিম আর তার পরিবারের। বাবা মা, স্ত্রী আর দুই সন্তান নিয়ে তার পরিবার। সকাল হলেই অন্যের জমিতে কাজ করতে ছুটে যায় সেলিম। গুড়গুড়িয়ে মেঘ ডাকছে, মাঝে মাঝে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি।
ফজরের আজানের সাথে সাথে দুটো শিশু ছাড়া বাকীরা উঠে পড়ে। কলপাড়ে অজু করে নামাজ পড়ে নেয়। সেলিমের বউ চুলার পাড়ে দাঁড়িয়ে বললো
-হেঁশেল খানা তো নিচ দিয়া ভিজা ভিজা, আগুন ধরবো বইলা মনে অয় না।
সেলিম হাই তুলতে তুলতে বললো,
-ঘরে যে আলোক (উচুঁ) হেঁশেল আছে ওইটা তে রাঁধো শেফালি, আমি খড়ি আনতাছি।
- সেডাই এক ভরসার কথা।

গরম ভাতে আলুভর্তা, আর ডিম ভাজি মিলিয়ে সবাই একসাথে খেতে বসে। জমির মুনসি এক বোতল ঘি দিয়েছিলো, সেটা ভাতের সাথে মাখিয়ে নেয় সবাই ঘিয়ের সুঘ্রাণ গরীবদের জন্য না! কিন্তু জমির মুনসি ভালো মানুষ শ্রমিকদেরকে নিয়ে খান, নতুন যাই কিছু ঘরে তুললে অনেক বেশি বেশি এনে প্রতিবেশী আর শ্রমিকদেরকে দিয়ে তবেই খান তিনি।
সেলিম শেখের মা মলিনা বেগম চোখ ভর্তি অশ্রু নিয়ে বলেন,
-আল্লাহ্ জমির মুনসি রে আরো সম্পদ দিক, জিবনে পোলা মাইয়াগো যা খাওয়াইতে পারিনাই তার সব ঐ মানুষের জন্য আজ পেটে যায়।
সেলিম মায়ের মুখের দিকে তাকায়,
-মা খাওতো! আল্লাহ্ রিযিকে রাখছেন বইলাই তো খাইতে পারি কও!


বিকেল নাগাদ সূর্য উঠি উঠি করেও উঠলো না পুরোপুরি। সন্ধ্যা নামার সময়টায় শুধু অস্ত যাওয়া দেখা গেলো। শেফালীর দুই ছেলে শাফিন আর শাকিল উঠোনে খেলছে। শশুর উঠোনের এক পাশে বসে পাট দিয়ে দড়ি পাকাচ্ছিলেন, আজান দেওয়ায় সব গুছিয়ে কলপাড়ে গেলেন । শেফালী রান্নার জন্য চুলা ধরিয়েছে। রান্নাঘরের মাঝামাঝি উচুঁতে একটা মাচাঙ্গে হারিকেন ধরিয়ে শেফালীর শাশুড়ি বললেন,
- রাইতে কি রানতাছো?
শেফালী ছোট মাছ পাতিলে মাখিয়ে দিতে দিতে বললো,
-আপনের পোলা মোয়া মাছ দিয়া গেছে, করল্লা আর আলু ঝুরি দিয়া চচ্চড়ি করুম।
- হ তাই করো, সেলিম আজ এহনো আইতাছেনা ক্যান? তুমি কিছু জানো বৌ?
- না আম্মা, কিছু কয়নায় তো, বিকালে এই মাছটুক দিয়া গেছে ....... জমির মুনসি দিসে কইলো।
-ও .... আচ্ছা তুমি রান্দো। শাফিন শাকিলরে হারিকেন এ আগুন দিয়া দিই পড়ুক!
-আচ্ছা আম্মা, আব্বারে কি রং চা বানায়ে দিতাম?
-আমারেও দিও বউ, মাতাডা ধরছে ......
-আচ্ছা!

৩.
রাত প্রায় বারোটা, সেলিম শেখ এখনো ফিরেনি। সেলিম শেখের বাবা জমির মুনসির বাড়িসহ আরো ক'টা বাড়ি খোঁজ নিয়ে এসেছেন, কোথাও নেই! আশার কথা হলো জমির মুনসিও ফেরেননি এখনও! কি হয়েছে কোথায় গেছেন বলে যাননি। তাহাজ্জুদ পেরিয়ে যাচ্ছে, জায়নামাজে সেলিম শেখের মা ও বাবা - ছেলের খোঁজ না পেয়ে একদিনে কেমন অসহায় বোধ করছেন। শেফালীও রাতে ঘুমাতে পারেনি এখন ফজরের নামাজ পড়ার জন্য অজু করতে কলপাড়ে যায় - পেছন থেকে কেউ একজন ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে শেফালীকে। নিজেকে সামলাতে পারেনা শেফালী, কলের হ্যান্ডেলে সজোরে বাড়ি খেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। প্রায় সন্ধেতে জ্ঞান ফেরে ওর। সেলিম ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্ত্রীর দিকে। ছেলে দু'জন কেঁদে কেঁদে ক্লান্ত প্রায়! শাশুড়ীমা বললেন,
-বউ কি হইছে তোমার?
শেফালী সেলিমের দিকে তাকায়, মুচকি হেসে আবার অন্যদিকে তাকায়, সেলিম শেখ কিছুই বুঝতে পারেনা, শেফালী অবাক হয়ে বলে,
-কি গো তুমি জানোনা কি হইছে আমার!
- না শেফালী .........
শেফালী ভয়ার্ত দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকায়,
- তাইলে কে আমারে ওরকম পিছ থাইকা .........
সেলিম শেখ যেন আকাশ থেকে পড়ে! সে যা বুঝার বুঝে যায়।

৪.
জমির মুনসী জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ফিরেছেন শুনে সেলিম শেখ তার বাড়ির দিকে যাবার জন্য পা বাড়ালে, পেছনে থেকে শেফালী গেঞ্জি টেনে ধরে। বলল,
- ঐদিন রাইতে আর বিয়ান (বিহান) বেলা কি হইছিলো আমারে কইয়া তারপর যাইবা! জমির মুনসীরই বা জেল খাটতে অইলো ক্যান?
সেলিম শেখ অগত্যা মেঝেতে বসে পড়ে,মুরুব্বি দু'জনও এসেছেন, ছেলেরা স্কুলে।
- গেরামে একটা খু... হইছে জানো? রাকিব পরামানিকের পাগলী মাইয়াডা। হেরে ধ... কইরা খু... করার সময় আমি দেইখা ফালাইসিলাম। কামডা করছে হারুন তালুকদারের পোলা হাবীব।পুলিশ আইলে হে উল্টা আমারে দোষ দেয়। তহন আমারে পুলিশ নিয়া যায়। জমির মুনসী মানুষডা খালি আমারে বাঁচাইবার গিয়া নিজে জেল খাটসে! ঐদিন রাইতে জমির মুনসী থানায় আমার লগে ছিলো। হাবীব কয়কি জমির মুনসীই নাকী আমারে ফাঁসাইসে। এই নিয়া কথা কাটাকাটি, আমি যতবার কই জমির মুনসী কিছু করেনাই, ততবার হাবীবে কয় স্যার মেলা ট্যাকা খাইয়া এহন আমারে দোষ দিতাছে। আপনে জমির মুনসীরেই ধরেন ....
আর হাবীব ওহান থাইকা তহন চইল্যা আসে, আমারে পরদিন দশটায় ছাইড়্যা দেয়। আর হাবীবেই তোমারে ....! জমির মুনসী খুব ভালো শেফালী, খুবই ভালো মানুষ!

#সমাজের সব মুনসী মোল্লারা খারাপ হয়না, খারাপ থাকলেও সবাইকে খারাপ ভাবা অনুচিত!


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)