অনির্ধারিত

তুমি কেমন আছো মাতৃভাষা?

তুমি কেমন আছো মাতৃভাষা?
ভাষাটা শিখেছিলাম মায়ের কাছে। সেই সাথে মা শিখিয়েছিলেন, ‘বাংলা ভাষা তোমার মাতৃভাষা, তাই এই ভাষাই তোমার প্রধান ভাষা। অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেন বা খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করেন, ‘ইংলিশ মিডিয়ামে পরে এতো সুন্দর বাংলা কিভাবে লেখো?’ অথবা এতো গুছিয়ে শুদ্ধ বাংলা কীভাবে বলো?’ আমার উত্তর একটাই, ‘মা শিখিয়েছেন। শুধু ভাষা শেখানোই নয়, মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাবোধটাও শিখিয়েছিলেন নিপুণ ভাবে। ব্যাপারটা আসলে ব্যতিক্রম কিছু নয়, মায়ের ভাষাটা সকলে মায়ের কাছ থেকেই শিখেন, কেউ শিখেন বুঝে কেউ বা না বুঝে, তবে বেশীরভাগই শিখেন না বুঝে। অধিকতর অভিভাবকের ধারণাতেই নেই যে, মাতৃভাষাটা-কে সন্তানের কাছে  পরিচয় করাতে হয় বিশেষ ভাবে। অভিভাবকরা ধরেই নেন, বাংলা ভাষা স্বয়ংক্রিয় ভাবে বাচ্চারা শিখেই নিবে। কিন্তু এটার ফলশ্রুতি কি জানেন? এটার ফলশ্রুতি হচ্ছে, মটু-পাতলু দেখে বড় হওয়া ছোট্ট আয়ান, তাই ঘুম থেকে ডাকলে, উত্তরে বলে, ‘ডিস্টার্ব মাত কারো। আয়ানের অভিভাবক কিন্তু বেজায় খুশি, কারণ তারা ভাবছে, আমার বাচ্চা নতুন একটা ভাষা শিখছে, তাতে ক্ষতি কি? তাদের কিন্তু ব্যাপারটা মাথাতেই খেলছে না, তাদের সন্তান নতুন ভাষাটি শিখছে মাতৃভাষা হিসেবে, তাই উঠতে, বসতে, কোন কিছু চাইতে ব্যাবহার করছে এই ভিন ভাষা। নাম করা একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে, কে জি-টু তে পড়া রুযাইনা, ঘরে-বাইরে অসম্ভব সুন্দর ইংলিশ বলে, বাংলাটা যেন ওর মুখেই আসে না!!! তাতে কি? রুযাইনার অভিভাবক কিন্তু খুবই গর্বিত, তাই বুক ফুলিয়ে বলেই বসলেন, ‘আমি তো বাচ্চার সাথে সবসময় ইংলিশে কথা বলি......নিষ্পাপ রুযাইনাদের দেখে আমার খুব মায়া হয়, যেই ভাষার এতো ইতিহাস, যেই ভাষা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলো, যেই ভাষাটা ওর শেকড়, সেই ভাষার মর্ম ওকে বুঝতেই দেওয়া হলো না। আমার সন্তান ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে বিধায়, অনেকেই পরামর্শ দেন, ‘বাচ্চার সাথে ঘরেও সবসময় ইংলিশে কথা বলবেন’, একবার মৃদু হেসে উত্তর দিয়েছিলাম, ‘স্কুলেও ইংলিশ, ঘরেও ইংলিশ, তাহলে বাংলাটা শিখবে কীভাবে?’ পরামর্শদাতা রীতি মতো ফেলফেল করে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে। ইংরেজি ভাষা একটি আন্তর্জাতিক ভাষা, যেই ভাষাটি জানা খুবই জরুরী। ইংরেজি মাধ্যমে সন্তানকে পড়ানর অর্থ কিন্তুই এই নয়, বাংলা ভুলে আমার সন্তান শুধুই ইংরেজি পড়বে, বলবে, লিখবে। কোন এক উন্নত দেশে চলে যাওয়া এক কিশোর, হাতে লাল অথবা নীল পাসপোর্ট নিয়ে, দশ বছর পর সবুজ পাসপোর্ট-টা কে তুচ্ছজ্ঞান করে, ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় বুঝিয়ে দেয়, এখন সে ব্রিটিশ অথবা অ্যামেরিকান নাগরিক। ওরা হয়তো কখনো আর শেকড়ের সন্ধানে ফিরবে না, ভাষার অভাবে বোবা কান্না কাঁদতে কাঁদতে শেকড়টা একদিন মরে যাবে। কোন এক বাংলা না জানা ভিন দেশি মানুষ কে অকথ্য (গালি) ভাষার মাধ্যমে যখন বাংলাকে পরিচয় করানো হয়, আর অর্থ না বুঝে অবুঝ মানুষটিও বাংলা ভেবে যখন অকথ্য ভাষাটাকেই আওড়ায়!!! ঘেন্না হয়, আমরা কি এতই নিচ? খুব করুণা হয়, যখন দেখি এই প্রজন্মের কিশোর কিশোরীরা J K Rowling অথবা Rick Riordan কে চিনে তাদের নিয়ে আলোচনা করে, কিন্তু শরৎচন্দ্র, আশাপূর্ণা দেবী, আল-মাহমুদ, জহির রায়হান অথবা সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ কে চিনে না, এবং বিকারহীন ভাবে মুখ বাকিয়ে বলে, ‘আমি  বাংলা বই পড়ি না। ইংরেজিতে মাস্টার্স করা এক ব্যক্তি, আমর হাতে সেই সময়বইটার মলাট উলটে বলেছিলেন, ‘ইয়াক, এগুলি বই দেখলে আমার বমি আসে। শুনে কষ্ট পাইনি, করুণা বোধ হয়েছিলো, বিদেশী ভাষা শিখাটা কোন অপরাধ না, কিন্তু বিদেশী ভাষা শিখতে গিয়ে নিজের ভাষার লেখাকে যে সম্মান করতে যানে না, তাকে কোন পাল্লায় মাপা যায় আমার জানা নেই। জ্ঞানের কোন দেশ নেই, নেই কোন সীমানা। তাই জ্ঞানকে পাওয়া যায় অনেক ভাষায়। ভিন ভাষা শেখা বা ভিন ভাষার বই পড়া, দোষের কিছু নয়, কিন্তু ভিন ভাষার তোড়ে, নিজের ভাষার প্রতি অনীহা নিজের অস্তিত্বের প্রতি অনীহা স্বরূপ। প্রতিটি জাতির মাতৃভাষা হোক অনেক আদরের, পরম স্নেহে লালনের, সম্মানের, যার বুকে মাথা গুঁজে হাসা যায়, কাঁদা যায়, অভিমান করা যায়, তীব্র কষ্ট অথবা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা যায়, ঠিক মায়ের মতো............ যাকে কলঙ্কিত করা যায় না, ভোলা যায় না, অকথ্য ভাষায় ক্ষতবিক্ষত করা যায় না......... তাই আমার মুখের ভাষা, আমি আমার মা-কে উৎসর্গ করলাম.........  

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)