ধর্ম ও গবেষনা

রাসুল (স) এর কবর স্থানান্তরের খবরটি গুজব (বিস্তারিত পড়ে নিন, এড়িয়ে যাবেন না)।

রাসুল (স) এর কবর স্থানান্তরের খবরটি গুজব (বিস্তারিত পড়ে নিন, এড়িয়ে যাবেন না)।
madina hd (3) রাসুল (স) এর কবর স্থানান্তরের খবরটি গুজব। সম্প্রতি দ্যা ইন্ডিপেন্ডেন্ট (independent.co.uk) এ রাসুল (স) এর কবর স্থানান্তর বিষয়ে প্রকাশিত প্রবন্ধটি উত্তেজনা ছড়ানোতে পটু মিডিয়ার কপটতার আরেকটি ইঙ্গিত। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের অনলাইন পোর্টালগুলোও নিউজটাকে হটকেক হিসেবে নিয়ে নিল। প্রথমত, সৌদিদের ব্যাপারে এবং তাদের সাথে পবিত্র স্থানগুলির সম্পর্কের বিরুদ্ধে গুজব ছড়িয়ে উত্তেজনা ছড়ানোর ব্যাপারে এই নিউজ পেপারটি এবং বিশেষ করে সাংবাদিক মিঃ জেরমে টেইলরের অস্বাভাবিক বাতিক রয়েছে। আপনারা নীচের লিংক গুলোতে গিয়ে তার ইতিহাস টা দেখে নিতে পারেন। একই রকম খবর ধারাবাহিকভাবে তারা প্রচার করে অপপ্রচার চালাচ্ছে, আর আমাদের মিডিয়াগুলো তা অনুবাদ করে প্রকাশ করছে। আপনারা নীচের লিংক গুলোতে গিয়ে তার ইতিহাস টা দেখে নিতে পারেনঃ ২০১১ সালেঃ https://www.independent.co.uk/news/world/middle-east/mecca-for-the-rich-islams-holiest-site-turning-into-vegas-2360114.html ২০১২ সালেঃ https://www.independent.co.uk/news/world/middle-east/medina-saudis-take-a-bulldozer-to-islams-history-8228795.html ২০১৩ সালেঃ https://www.independent.co.uk/news/world/middle-east/the-photos-saudi-arabia-doesnt-want-seen--and-proof-islams-most-holy-relics-are-being-demolished-in-mecca-8536968.html ২০১৪ সালেঃ https://www.independent.co.uk/news/world/middle-east/saudis-risk-new-muslim-division-with-proposal-to-move-mohameds-tomb-9705120.html দ্বিতীয়ত: রাসুল (স) এর কবর স্থানান্তরের কথিত পরিকল্পনা আসলে সরকারী কমিটির নিকট দেয়া একটি একাডেমিক পেপার। যারা এসকল একাডেমিক পেপার সম্পর্কে জানেন তারা বুঝতেই পারছেন যে এরকম একটি পেপার সাবমিট করাটা কিছুতেই কমিটির প্রকৃত পরিকল্পনা পত্রের প্রকার ও প্রকৃতির মধ্যে পড়ে না। তৃতীয়তঃ এই পেপারে কোথাও রাসুল (স) এর কবরকে স্পর্শ করার কথা বলা হয়নি। কোনও প্রকৃতিস্থ মুসলমান এটা প্রস্তাব করবেও না। বরং এই পেপারটি যেটা প্রস্তাব করেছে সেটা হল পুরো মসজিদটাকেই আবার পুনর্নির্মাণ পরিকল্পনার আওতায় আনা উচিত যাতে কবরটি মসজিদের সীমানার বাইরে পড়ে। সুতরাং প্রস্তাব প্রণয়নকারী যা প্রস্তাব করেছে সেটা হল মসজিদের সীমানাটাকে পরিবর্তন করতে কবরকে স্থানান্তর করতে নয়। চতুর্থত: রাসুল (স) এর কবর মসজিদের ভেতরেই হতে হবে এই মতটি একটি সংখ্যালঘিষ্ঠ স্কলারদের মত যা পরিষ্কার ভাবে মেইনষ্ট্রীম সালাফি ও নন-সালাফী স্কলারদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। ঐতিহাসিক ভাবে রাসুলের (স) কবরকে মসজিদে নববী তে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে উমাইয়াদদের সাথে বড় ধরনের কোনও অমত কখনই ছিল না এবং কোনও মাজহাবের বড় স্কলারই কখনও বলেন নি যে মসজিদে নববীর সীমানা নতুন করে নির্ধারণ করতে হবে। পরিশেষে, এটা হারামাইনের চার পাশে সাউদী নির্মাণ নীতির পক্ষে কোনও সাফাই নয়। এই টপিকটি আলোচনার জন্য একটা বড় আর্টিকেল প্রয়োজন। একটা ফেসবুক পোষ্টে এটা সম্ভব নয়। এই পোষ্টের উদ্দেশ্য হল মিডিয়ার উত্তেজনা ছড়ানোর হীনকর্ম কিভাবে চলছে এবং কিভাবে মুসলমানরা খুব সস্তা ভাবে এগুলোর উপর ভিত্তি করে অন্য গ্রুপকে কলঙ্কিত করছে তা বুঝানোর জন্য। [শাইখ ইয়াসির কাদীর ষ্ট্যাটাস অবলম্বনে জাবাল আত তারিক] ===================================== আরেকটি অনুসন্ধানঃ ব্রিটেনভিত্তিক ইন্ডিপেন্ডেন্ট, ডেইলি মেইল, ও টেলিগ্রাফের বরাত দিয়ে গতকাল সারাদিন নিউজফিডে এরকম একটি নিউজ শেয়ার করতে দেখলাম যে, মসজিদে নববী থেকে নবীজীর স. দেহ মোবারক সরানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে বা হতে যাচ্ছে। Masjid_Nabvi_78 এ সম্পর্কে আরবীতে খুঁজতে গিয়ে এই লিংকটি পেলাম: https://www.almasryalyoum.com/news/details/514359 - এতেও ইংরেজি পত্রিকাগুলোর ন্যায় শিরোনাম করা হয়েছে। তবে ভেতরে পড়তে গিয়ে জানতে পারলাম ড. আলী বিন আব্দুল আযীযের "عمارة مسجد النبي عليه السلام ودخول الحجرات فيه دراسة عقدية" শীর্ষক গবেষণার সূত্রে তারা এ কথাগুলো বলছেন। আরবী গবেষণার শিরোনামটি সার্চ করতেই গবেষণাটি মাজমা'য়াহ ইউনিভার্সিটির সাইটে পাওয়া গেল, যেখানে সম্ভবত তিনি ফ্যাকাল্টি। https://faculty.mu.edu.sa/download.php?fid=77545 আরবী নিউজটিতে এখান থেকে বেশ কিছু কোটেশন আনা হয়েছে। এতে নিশ্চিত হলাম, ডকুমেন্ট এটাই, যা নিয়ে কথা হচ্ছে। প্রথম কথা হলো, এটা মূলত মসজিদে নববীর সম্প্রসারণ ও সংস্কারের ইতিহাস, বিশেষ করে আম্মাজান আয়েশা রা. এর হুজরাসহ (যেখানে নবীজী স. শায়িত) অন্যান্য হুজরাকে মসজিদে অন্তর্ভুক্তিকরণের ইতিহাস, এবং শেষে ওনার কিছু প্রস্তাবনা। এটা মোটেও কোনো সিদ্ধান্ত নয়। গবেষণাটা ও শেষের প্রস্তাবনাগুলো সময় নিয়ে পড়লাম। ইতিহাসটা জেনে খুব ভালো লাগল, তবে সংস্কারের বিষয়গুলো আসলেই খুব কষ্ট দিল। শেষে ওনার প্রস্তাবনাগুলোও খুব চমৎকার। এখানে রাসূল স. এর দেহ মোবারক সরানোর বিন্দুমাত্র কথাও নেই। অথচ এটাকেই শিরোনাম করছে সবাই। গবেষণাটি পড়লে স্পষ্ট বুঝা যায়, তিনি ইতিহাসের নিরিখে মসজিদে নববীর সংস্কার ও বিবর্তন তুলে ধরেছেন। যুগে যুগে নানা আমীর-সুলতানের আমলে নানা নতুন বিষয় সংযোজনের কথা তুলে ধরেছেন। এর শুরু প্রথম শতাব্দীর শেষ দিকে উমাউয়ী খলীফা ওয়ালীদ বিন আব্দুল মালিকের মাধ্যমে। তিনিই প্রথম আম্মাজান আয়েশা রা. এঁর হুজরা (যেখানে রাসূল স. এঁর কবর) ও অন্যান্য হুজরাকে মসজিদে নববীর অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দেন, যা খলীফা ওমর রা. ও উসমান রা. কেউই করেন নি। ওনাদের সময় মসজিদের অন্য তিন পাশ দিয়ে মসজিদ বড় করা হয়েছে, এই পূর্ব দিকটাকে ধরা হয় নি। যেন রাসূল স. এর কবর মসজিদের অন্তর্ভুক্ত না হয়ে যায়, আর কবরকে মসজিদ বানাতে রাসূল স. নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন, আল্লাহ তায়ালা ইয়াহুদী ও নাসারাদের লা'নত করুন, এরা এদের নবীদের কবরকে মসজিদ বানিয়েছে। (বুখারী: ১৩৯০) যাহোক, তাবেয়ীদের বিশিষ্ট সাত ফকীহসহ অন্যদের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও তৎকালীন খলীফা হুজরাকে মসজিদের ভেতর নিয়ে নেন। এরপর একে একে যুগে যুগে এ মসজিদে নানা ডিজাইন, মূল্যবান পাথর, মোজাইক ইত্যাদি সংযুক্ত হয়। হুজরার ওপর গম্বুজ হয়, সুলতানদের নাম খচিত মিম্বর আসে, হুজরা ও কবরের ওপর নানা আয়াত লিখিত পর্দা আসে। প্রায় প্রত্যেক খলীফাই এগুলোর পেছনে অঢেল টাকা-পয়সা খরচ করেন। এর মধ্যে দেয়ালে ও কলামে বিভিন্ন বিদয়াতী/ শিরকী কথার শ্লোকও আসে। সবশেষে তিনি প্রথম যে প্রস্তাব করেছেন সেটা হলো, হুজরার পূর্ব দিক থেকে দেয়াল পর্যন্ত এবং উত্তর দিকে আহলুস সুফফার জায়গাসহ ওদিকে বাবে জিবরীল পুরোটাকে দেয়াল দিয়ে দিতে, যদিও সেটা কাঠের হয়। এতে রাসূলের স. কবর ও হুজরাগুলো মসজিদ থেকে আলাদা হবে, যা রাসূলেরই স. নির্দেশ। আর বিদয়াতীরা এসব জায়গা ব্যবহারের সুযোগ কম পাবে; একইভাবে ফাতিমা রা. -র হুজরাকে কেন্দ্র করে শীয়াদের তৎপরতাও রোধ হবে। এছাড়া হুজরার দেয়াল ও কলামের ওপর লেখা প্রশংসাসূচক শ্লোকগুলো মিটিয়ে দিতে, যেন শিরকের পথ বন্ধ হয়। এবং দুই পাথুরে জায়গায় লেখা সাহাবীদের নাম ও বারো ইমামের নাম মুছে ফেলতে, যেন এগুলোকে কেন্দ্র করে হওয়া ফাসাদ বন্ধ হয়। এবং সবুজ গম্বুজকে আর সংস্কার না করতে এবং এর ওপরের তামার প্রলেপও যথাসম্ভব মিটিয়ে দিতে। (এগুলো রাসূল স. ও খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে ছিল না। মসজিদের এসব অতিরিক্ত নকশা মূলত পারস্য/রোম ও চীনাদের প্রভাব, গবেষণায় তা তিনি দেখিয়েছেন। এর আগে মসজিদ ছিল সাদামাটা।) আর সম্প্রসারণ যেন কিবলার দিকে করা হয়। উমর রা. ও কিবলার দিকে সম্প্রসারণ করেছিলেন। কিবলার দিকে দেয়াল ভেঙে তা আরো সামনের দিকে সম্প্রসারিত করা যেতে পারে। সবশেষে তিনি মসজিদে নববীর প্রয়োজনগুলো গবেষণার জন্য উলামাদের একটি টিম গঠনের সুপারিশ করেন, যেন মানুষের ঈমান-আক্বীদা সুরক্ষিত থাকে। সবমিলিয়ে ওনার গবেষণাটি আমার কাছে দালীলীক ও যৌক্তিক মনে হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন আসে, নিউজটা ছড়াচ্ছে কোথা থেকে? নিউজটা মূলত করেছে ইউকের ইন্ডিপেন্ডেন্ট, ড. ইরফান আলাউইর বরাত দিয়ে। ওনার পরিচয়ে যাব না, গার্ডিয়ানে ওনার সংক্ষিপ্ত পরিচয় ও নিউজগুলো রয়েছে। (https://www.theguardian.com/profile/irfan-al-alawi) মূল গবেষণা থেকে নিউজটি মাইলের পর মাইল দূরে অবস্থান করছে। নিউজটা পুরোপুরি উদ্দেশ্যমূলক মনে হয়েছে। আরব বিশ্বের বলতে গেলে বড় কোনো পত্রিকায় এসব কভার করে নি, কভার করার মতো কিছু হয় নি বলে। আরবী-ইংরেজী-বাংলাসহ সব ভাষাতেই শিয়া ও বিদয়াতীদের এই নিউজ ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। পেছনে কী কারণ, তা আর নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। সবমিলিয়ে আমাদের অত্যন্ত সতর্ক থাকা প্রয়োজন। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন। এবং তাহকীক (যাচাই) ছাড়া নিউজ শেয়ার করা থেকে বিরত থাকার তাওফীক দিন। আমীন। == লিংকসমূহ: ১. ইন্ডিপেন্ডেন্টের মূল নিউজ: https://www.independent.co.uk/news/world/middle-east/saudis-risk-new-muslim-division-with-proposal-to-move-mohameds-tomb-9705120.html ২. ড. ইরফান আলাউই: https://www.theguardian.com/profile/irfan-al-alawi ৩. একটি আরবী নিউজ: https://www.almasryalyoum.com/news/details/514359 ৪. ড. আলী বিন আব্দুল আযীযের "عمارة مسجد النبي عليه السلام ودخول الحجرات فيه دراسة عقدية" শীর্ষক গবেষণা: https://faculty.mu.edu.sa/download.php?fid=77545 কৃতজ্ঞতায়ঃ Mufti Yousuf Sultan (দাঃমাঃ), জাবাল আত তারিক এবং যুবায়ের আহমাদ আনসারী। সূত্রঃ আবুবকর ভাইয়ের স্ট্যাটাস থেকে।

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
লেখকের অন্যান্য ব্লগ সবগুলো দেখুন