
‘যে ব্যক্তি রামাজানের রোজা রাখল অতঃপর শাওয়ালের ছয়টি রোজা রাখল সে যেন সারা বছর রোজা রাখল।’ (সহীহ মুসলিম) সমস্ত প্রসংশা মহান আল্লাহ তা’আলার জন্যে যিনি আমাদের জন্য ইসলাম ধর্মকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। দরূদ ও শান্তির অবিরাম ধারা বর্ষিত হোক সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল মুহাম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর পবিত্র বংশধর ও সম্মানিত সাথীবর্গের উপর।
একটি সূবর্ণ সুযোগ! সুপ্রিয় দ্বীনি ভাই ও বোন, প্রতিটি মুসলমানের উপর কর্তব্য হল, তারা সর্বদা সৎ কাজের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে এবং সকল সময় আত্মশুদ্ধির চেষ্টা করবে। ইবাদতের মাধ্যমেই আত্মশুদ্ধি অর্জন করা সম্ভব। প্রতিটি মানুষ যার যার আনুগত্যের পরিমাণ অনুসারেই তার আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে পক্ষান্তরে যার যার অন্যায় ও অপরাধ অনুসারেই আত্মাকে করে কলুষিত। আর এই কারণেই ইবাদতকারীদের অন্তর অধিক নরম এবং তারা সংশোধনশীল ব্যক্তি। অপরপক্ষে পাপীদের অন্তর কঠোরতাসম্পন্ন এবং তারা অধিক ফ্যাসাদকারী। রোজা ঐ সমস্ত ইবাদতসমূহের অন্যতম যা দ্বারা অন্তরকে খারাপ, অন্যায় ও নিকৃষ্টবস্তু থেকে পবিত্র রাখা যায় এবং অন্তরের ব্যাধিকে দূরীভূত করার অন্যতম মাধ্যম। একারণে রামাজান মাস হল পর্যালোচনার একটি মাস এবং আত্মাকে কলুষতা থেকে মুক্ত করার একটি মাস। এই মহান উপকারিতা যা রোজাদার ব্যক্তি রোজার মাধ্যমে অর্জন করে রোজার শেষে এক নতুন অন্তকরণ নিয়ে অবস্থান করতে সক্ষম হয়। রামাজান মাস শেষে শাওয়ালের ছয় রোজা অন্তর পবিত্র রাখার একটি সূবর্ণ সুযোগ।
শাওয়াল মাসে ছয়টি রোজা রাখার মর্যাদা : রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবীদের শাওয়াল মাসের এই ছয় রোজা রাখার প্রতি উৎসাহ দিতেন। তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রামাজান মাসের রোজা রাখলো অতঃপর শাওয়াল মাসের ছয় রোজাও রাখল ঐ ব্যক্তি যেন সারা বছরই রোজা রাখল।’ (মুসলিম) এ হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম নববী (র.) বলেন, আলেম সম্প্রদায় বলেন, ‘এই ছয় রোজাকে পূরো এক বছরের রোজার ছোয়াবের পর্যায়ভূক্ত করা হয়েছে এই জন্য যে, বান্দার প্রতিটি ভালো আমলকে আল্লাহ তায়ালা দশগুণ ছোয়াব দান করেন। এ হিসেবে রামাজান মাসের রোজা দশ মাসের ছোয়াব এবং এই ছয় রোজা দু’মাসের ছোয়াবের অন্তর্ভূক্ত মনে করা হয়।’
হাফেয ইব্নু রজব (র.) ইব্নু মোবারক থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন : ‘শাওয়াল মাসের ছয় রোজা রামাজান মাসের রোজার ছোয়াবের সমতুল্য। এ হিসেবে যে কেউ এ ছয় রোজা রাখবে সে ফরজ রোজার ছোয়াব পাবে।’
শাওয়াল মাসের রোজা রামাজান মাসে রোজা রাখতে পারার জন্য কৃতজ্ঞতার বহির্প্রকাশ শাওয়াল মাসের ছয় রোজা রাখা হলো, আল্লাহ তা’আলা রামাজান মাসের রোজা রাখার তাওফীক দান করেছেন সে জন্য শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজা রাখার মাধ্যমে তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। এমনিভাবে সৎ আমলের উপর প্রতিষ্ঠিত ও অবিচল থাকারও প্রমাণস্বরূপ। হাফেয ইবনু রজব (র.) বলেন, ‘রামাজান মাসের রোজা রাখার তাওফীক পাওয়ার পর আবার গুনাহে লিপ্ত হওয়ার উদাহরণ হলো নেআমতের এমন কুফরী করা যেমন ঈমান আনার পর মুরতাদ হয়ে যাওয়া।’
প্রিয় ভাই, ইবাদতের জন্য কোন সময় নির্ধারিত নেই যে, কেবল ঐসময়েই ইবাদত করবে আর সময় শেষ হয়ে গেলে আবার গুনাহের কাজে লিপ্ত হবে। বরং মানুষ দুনিয়াতে যত দিন বেঁচে থাকবে ততদিন তাকে ইবাদত করতে হবে। এমনকি এ ইবাদত মৃত্যুর পূর্ব মূহূর্ত পর্যন্ত চালু থাকবে। আল্লাহ বলেন, ‘এবং তুমি তোমার মৃত্যু উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত তোমার প্রতিপালকের ইবাদত কর। (সূরা হিজ্র: ৯৯)
বাসীর আল হাফী (র.)-কে বলা হলো, কিছু লোক শুধু রামাজান মাসেই ইবাদত করে। একথা শুনে তিনি বললেন, ‘তারাই নিকৃষ্ট লোক যারা শুধু রামাজান মাস এলে আল্লাহকে ডাকে। প্রকৃত সৎ লোক তো তারাই যারা সারা বছর ধরে আল্লাহকে ডাকে।’
শাওয়াল মাসে ছয়টি রোজা রাখার উপকারীতা : সুপ্রিয় দ্বীনি ভাই, রামাজান মাস চলে যাওয়ার পর রোজা চালু রাখার মধ্যেই রয়েছে বহুবিধ উপকারিতা। এই উপকারিতা তারাই লাভ করবে যারা শাওয়াল মাসের রোজা রাখবে। নিম্নে উহার কতিপয় উপকারিতা উল্লেখ করা হল :
১) যে ব্যক্তি রামাজান মাসের রোজা পূর্ণ করবে এবং শাওয়াল মাসের ছয় রোজা রাখবে সে পূর্ণ এক বছরের রোজার ছোয়াব পাবে।
২) শাওয়াল মাসের ছয় রোজা এবং শাবানের রোজা রাখা হলো ফরয নামাযের আগে ও পরে সুন্নাত নামাযের মত। ফরয ইবাদতে যে সমস্ত ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে যায় তা নফলের মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করে। অনুরূপভাবে রামাজানের রোজা পালন করতে গিয়ে ভুল-ত্রুটি হলে শাওয়ালের এছয়টি রোজা পালনের মাধ্যমে তাকে পূর্ণতা দেয়া হয়। কেননা অধিকাংশ মানুষকেই লক্ষ্য করা যায় তাদের রোজাতে ভুল-ত্রুটি রয়েছে এবং কিয়ামতে যখন ফরয দ্বারা তার হিসাব পূর্ণ হবে না তখন নফল দ্বারা তা পূর্ণ করা হবে।
৩) রামাজান মাসের পর শাওয়াল মাসের রোজা রাখা হলো রামাজান মাসের রোজা কবুল হওয়ার আলামত। কেননা আল্লাহ যখন কোন ভালো আমল কবুল করেন তখন পরবর্তীতে তাকে আরো ভালো আমল করার তাওফীক দান করেন।
৪) ঈমানের সাথে এবং ছওয়াবের আশায় রামাজান মাসের রোজা পালন করলে নিশ্চিতভাবে বান্দার গুনাহসমূহ বিদূরিত হয়। রামাজান মাসে রোজাদার ব্যক্তি বছরের অন্যান্য দিনসমূহের ছোয়াব লাভ করবে। আর সেই দিনগুলো হলো : রোজা ভাঙ্গার বৈধ দিনসমূহ। সুতরাং ঐদিনগুলোর পর পুনরায় রোজা রাখা হলো আল্লাহ তা’আলা নেআমাতের শুকরিয়া করা। গুনাহ মাফ হওয়ার নেআমাতের চেয়ে আর বড় নেআমাত কিছু নেই।
নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাত্রিতে দাঁড়িয়ে এমন ভাবে নামায পড়তেন যে তার পা ফুলে যেতো। তাঁকে বলা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এত নামায পড়েন যে আপনার পা ফুলে যায় অথচ আল্লাহপাক আপনার পূর্বের এবং পরের সকল প্রকার গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন? রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘আমি কি আল্লাহর শুকরিয়া আদায়কারী বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত হব না?’ (বুখারী)
আল্লাহ স্পষ্ট ভাষায় তাঁর বান্দাদের রামাজান মাসের রোজার শুকরিয়া আদায় করার আদেশ করেছেন। তিনি বলেন, এবং যেন তোমরা নির্ধারিত সংখ্যা পূরণ করে নিতে পার এবং তোমাদেরকে যে সুপথ দেখিয়েছেন, তজ্জন্যে তোমরা আল্লাহ্র বড়ত্ব বর্ণনা কর আর যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। (সূরা বাক্বারা ১৮৫) সুতরাং আল্লাহ তাঁর বান্দাকে রামাজান মাসের রোজা রাখার শক্তিদান করেছেন এবং তার গুনাহ সমূহ ক্ষমা করেছেন। তাই রামাজান মাসের শেষে পূনরায় রোজা রাখা অর্থ হলো, তাঁর শুকরিয়া আদায় করা। সালফে সালেহীনদের মধ্যে কেউ যদি রাত্রি জাগরণ করার তাওফীক লাভ করতেন তাহলে শুকরিয়া স্বরূপ দিনের বেলায় রোজা রাখতেন।
ওহাইব ইব্নু ওরদ (রাহ.)-এর এই কথাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ: ওহাইব ইব্নু ওরদকে কোন ভালো আমলের ছোয়াব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলতেন যে, ‘ছোয়াব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিও না বরং বল এই ভালো কাজের শক্তি পাওয়ার দরুন সে শুকরিয়া করার কি শক্তি পেয়েছে। দ্বীন ও দুনিয়ার প্রত্যেক নেক কাজের জন্য শুকরিয়া করা আবশ্যক। অতঃপর শুকরিয়া করার শক্তি পাওয়া ইহা আর একটি নেআমত, এই নেআমতের জন্য প্রয়োজন আবার শুকরিয়া করা।
আবার এই নেআমতের শক্তি পাওয়ার জন্য প্রয়োজন পুনরায় শুকরিয়া করা। এমনি ভাবে প্রত্যেকটি কাজের বিনিময় আল্লাহর শুকরিয়া করা আবশ্যক। যে সমস্ত আমল দ্বারা মানুষ রামাজান মাসে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে থাকে তা রামাজান মাস শেষ হওয়ার সাথে সম্পৃক্ত নয় বরং মানুষ দুনিয়াতে যত দিন বেঁচে থাকবে সেই আমলও ততদিন অবশিষ্ট থাকবে। নবী (সা.)-এর আমল ছিলো স্থায়ী। আয়েশা (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে যে, নবী (সা.) কি ইবাদতের জন্য কোন দিনকে খাছ করতেন? তিনি বলেছেন না! বরং তিনি সর্বদা আল্লাহর ইবাদত করতেন। আয়েশা (রা.) আরও বলেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাজান এবং রামাজান ছাড়া অন্য মাসে ১১ রাকাতের বেশি রাত্রির নামায পড়তেন না। রামাজান মাসের কোন কাজ যদি ছুটে যেতো তাহলে তিনি তা শাওয়াল মাসে আদায় করে নিতেন। এক বছর তিনি ইতিকাফ করতে না পারলে উহা শাওয়াল মাসের প্রথম দশকে পূর্ণ করেছেন।
সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)