ধর্ম ও গবেষনা

শেষ রাত্রির গল্পগুলো

শেষ রাত্রির গল্পগুলো
[শেষ রাত্রির গল্পের আসরে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি। ‘আরেহ! আমি কি বাচ্চা নাকি যে গল্পের আসরে শুধু শুধু বসে থাকবো?’ হুমম.. সে জন্যিই তো আমরা গল্পের ফাঁকে ফাঁকে প্রাণবন্ত আড্ডার আয়োজন করে ফেলেছি!] ---------------------------------- প্রথম গল্প শোনার আগে: ॥১॥ ধরুন, আপনি কাউকে ভালোবাসেন। খুব, খুউব ভালোবাসেন। আবেগসিক্ত অনুরাগে হৃদয়ে প্রীতিময় দ্যোতনা সৃষ্টি করেন। আচ্ছা বলুন তো, আপনার অনেক অনেক প্রিয় ভালোবাসার মানুষটির সাথে কখন কথা বলবেন? হৃদয়ের অব্যক্ত অনুভূতিগুলো কখন শেয়ার করবেন? নিশ্চয়ই একান্তে! নির্জনে! তাই না? কোলাহলমুক্ত নিভৃত কোন সময়ে আপনি মন উজাড় করে দিতে পারেন তাকে। ॥২॥ আপনি বলে থাকেন, ‘আমি আল্লাহকে সব কিছুর চেয়ে বেশি ভালোবাসি’। সত্যি তো? তাহলে ভাবুন তো, সমস্ত বিশ্ব চরাচর যখন নিঝুম রজনীতে ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে, নিঃশব্দের ঢেউ খেলে যায় প্রকৃতির বুকে, নীরবতার ছায়া নেমে আসে পৃথিবীর আঙিনায়-- তখন কি ইচ্ছে করে না আপনার প্রিয়তম মালিকের সাথে একটু নিভৃতে কথা বলার? হৃদয়ের জমানো ব্যথাগুলো তাঁর কাছে পেশ করার? ইচ্ছে করে না আপনার প্রেমাস্পদকে ভালোবাসার দু’ফোঁটা অশ্রু নিবেদন করার? সমস্ত সৃষ্টি যখন সুখনিদ্রায় বিভোর, তখনই তো প্রিয়তম স্রষ্টার সাথে একান্ত আলাপনের সুবর্ণ সুযোগ!   প্রথম গল্পটি: গল্পটি আমার আপনার মতোই দু’জন ব্যক্তির! আমাদের মতোই রক্তে-মাংসে গড়া দু’জন বিশ্বাসী মানুষের! শুনুন তবে: হুসাইন ইবন আল-হাসান এ ব্যাপারে একটু উদাসীন ছিলেন সম্ভবত। তাই ফুদ্বাইল ইবন ’ইয়াদ্ব একবার হুসাইনের হাত ধরে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, হৃদয়ের খুব গভীরে আঘাত হানার মতো: শোন হুসাইন! আল্লাহ পূর্ববর্তী অনেক কিতাবে বলেছেন, “যে আমার ভালোবাসা দাবী করে, সে মিথ্যা বলে। যখন রাত নেমে আসে, সে আমাকে ফেলে (কিভাবে) ঘুমিয়ে থাকে! আচ্ছা, প্রত্যেক প্রেমিকই কি তার প্রেমাস্পদকে নিভৃতে পেতে চায় না?...” [আল-মুজালাসাহ, ইবন মারওয়ান, ক্রমিক ১৩২]   আপনার অবস্থান? আপনি ইতোমধ্যেই বুঝতে পেরেছেন, আপনার দাবীতে আপনি সত্যবাদী কি না। যদি ইতিবাচক উত্তর হয়, আপনি আল্লাহর কৃতজ্ঞতা ও শুকরিয়া আদায় করুন এবং ধারাবাহিকতা ঠিক থাকার জন্যে আল্লাহর কাছে দু’আ করুন। যদি নেতিবাচক উত্তর হয়, চলুন না, আজ থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি আমি আমার ভালোবাসার দাবীকে সত্য প্রমাণ করবোই ইনশা-আল্লাহ! আল্লাহ আপনাকে তাওফিক দিন। থামুন, আপনার জন্যে আরো কিছু গল্প এখনো বাকী!     দ্বিতীয় গল্প বলার আগে: আপনি এরই মধ্যে একটি হাদিস প্রায় সময়ই শুনে আসছেন। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, আবূ হুরায়রার (রা) বর্ণিত হাদিসটার কথাই বলছিলাম! রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন: “ফরয সালাতের পরে (মর্যাদা ও ফযীলতের দিক থেকে) সর্বোত্তম হলো শেষ রাতের সালাত।” [মুসনাদ আহমাদ:৮৪৮৮]   অতঃপর কী হলো? হাদিসটি শোনার পর আপনার বিশ্বাসের জমীনে ইচ্ছার বীজ বপন করে ফেলেছিলেন, আমাকেও এই সালাতে শামিল হওয়া দরকার! এর সাথে সাথে জেনে ফেলেছেন শেষ রাতের সালাতে অভ্যস্তদের জন্যে আল্লাহর কাছে সুমহান মর্যাদার কথাটাও। ঐ যে, ইবন ’আব্বাস (রা.) যে হাদিসটা বর্ণনা করেছিলেন! রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “আমার উম্মাহ’র মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত হলো কুরআনের ধারক-বাহক এবং রাত্রিতে ’ইবাদাতকারীগণ।” [শু’আব আল-ঈমান:২৯৭৭]   তারপর? আপনার সুপ্ত বাসনার অঙ্কুরোদ্গম হলো। মোটামুটি স্থির হয়েছেন। কিন্তু বাধ সাধলো আরেকটা, আপনি ঘুম থেকে জাগতে পারছেন না!   আপনার জন্যে দ্বিতীয় গল্পটা: ঠিক এমনই অভিযোগ নিয়ে একজন ব্যক্তি হাসান আল-বাসরী (রহিমাহুল্লাহ)’র কাছে এসেছিলেন। লোকটি বলেছিলেন, আমি অনেক চেষ্টা করেও রাত্রে তাহাজ্জুদের জন্যে ঘুম থেকে জাগতে পারি না। আমার জন্যে কী প্রতিষেধকের পরামর্শ দেবেন? হাসান আল-বাসরী খুব সিম্পল সল্যুশন দিয়েছিলেন: ‘তুমি দিনের বেলায় পাপ কাজ থেকে দূরে থাকো, তাহলে রাতের বেলা সালাতের জন্য জাগ্রত হতে পারবে। রাত্রে সালাতে দন্ডায়মান হওয়াটা অনেক বড়ো মর্যাদার ব্যাপার। আর পাপীকে কখনো এই মর্যাদা দেওয়া হয় না।’ অল্প কথা। ওজনটা কতটুকু ভারী, চোখ বন্ধ করে কেবল অনুভব করা যায়। নয় কি?   চূড়ান্ত গল্পগুলো: আপনি মানসিক ভাবে রেডি। আপনার দিনটি আল্লাহর সীমারেখা অতিক্রমের কোন ছোট উপলক্ষেরও সাক্ষাৎ পায় নি। আলহামদুলিল্লাহ। এই তো! এ-ই তোওও! আপনি সফল। অভিনন্দন! আপনার জন্যে চূড়ান্ত গল্পের ডালি নিয়ে আমরা অপেক্ষমাণ। তার আগে-- * খুব বেশি নয়, আপনি মাত্র আধ ঘন্টার প্ল্যান নিয়ে শুরু করুন। * মনটাকে শক্ত করে ফেলুন। আত্মবিশ্বাস রাখু...। আল্লাহর উপর আস্থা রাখু...। * প্রাথমিক ভাবে প্রতিদিন হয়তো সম্ভব হবে না। কোন্ কোন্ দিন আপনার সম্ভব হচ্ছে আগেই ঠিক করে ফেলুন। * ব্লগ বা ফেসবুকে অধিক আসক্তি থাকলে আপনার নিজের জন্যেই নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে অভ্যস্ত হওয়া অনেক বেশি প্রয়োজন। তাহাজ্জুদের সুমহান নি’আমাত পেতে হলে তো সময় অপচয়কারী এ বিষয়গুলো কন্ট্রোলে আনার বিকল্পই নেই। * ওদ্বূ করে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ুন। আল্লাহর উপর ভরসা করে এলার্ম দিয়ে রাখু...। * পর্যায়ক্রমে ইনশা’আল্লাহ নিয়মিত অভ্যস্ত হবার চেষ্টা করুন।   তৃতীয় গল্পটি: এই গল্পটা অনেক অ-নে-ক বেশি প্রেরণাদায়ক। আপনার সাথেও হয়তো মিলে যেতে পারে! ’আব্দুল ’আযীয ইবন আবি রাওয়াদ ছিলেন আমাদের মতোই আরেকজন বিশ্বাসী মানুষ। তিনি শেষ রাত্রে সালাতের জন্যে উঠতে চাইলে কোমল ও আরামদায়ক বিছানার পরশে কিছুটা পিছুটান অনুভব করতেন। তারপর কী করতেন জানেন? বিছানায় হাত বুলাতে বুলাতে বলতেন, ওহ! কতো নরম আর আরামদায়ক তুমি! কিন্তু...কিন্তু জান্নাতের বিছানাটা যে তোমার চেয়েও অধিক কোমল আর আরামদায়ক!! অতঃপর তিনি সালাতে দাঁড়িয়ে যেতেন।   সর্বশেষ গল্প শোনার আগেঃ আচ্ছা, আপনি অনেক খুশি না? আরে আরে, মুচকি হেসে কী লাভ? বলেই ফেলুন, আমরাও একটু শুনি, আপনার হৃদয়ে প্রশান্তির সুশীতল বাতাস স্পর্শ করে যাচ্ছে কি নির্মল স্নিগ্ধতায়! কিন্তু আমি আপনাকে স্বার্থপর বলি, তা নিশ্চয়ই চান না! আপনি যদি ভাইয়া হয়ে থাকেন; তাহলে আপুকেও বঞ্চিত করবেন কেনো? আর আপুরাই বা কেনো ভাইয়াকে ফেলে সৌভাগ্যের অংশীদার হবেন? চলুন না, দু’জনের ভালোবাসার পদ্ম দু’টো আল-ওয়াদূদের চূড়ান্ত ভালোবাসার মৃণালেই ফুটিয়ে তুলি! রাজী তো? আপনাদের জন্যে সুসংবাদ! না, আমার নয়। প্রিয় নবীজির কাছেই শুনুন তবে: “আল্লাহ ঐ লোকের উপর রহম করুন, যে রাতে উঠে, সালাত আদায় করে, তার স্ত্রীকে জাগায় এবং সেও সালাত আদায় করে। যদি সে উঠতে না চায় তাহলে তার মুখে পানি ছিটিয়ে দেয়। আল্লাহ ঐ মহিলার উপর রহম করুন, যে রাতে উঠে, সালাত আদায় করে, তার স্বামীকে জাগায় এবং সেও সালাত আদায় করে। যদি সে উঠতে না চায় তাহলে তার মুখে পানি ছিটিয়ে দেয়।” [সুনান আবূ দাঊদ: ১৩১০; সুনান নাসাঈ: ১৬১০; মুসনাদ আহমাদ:৭৪০৪] আল্লাহ আপনাকে তাঁর রাহমাতের চাদরে জড়িয়ে রাখু...। আনমেরিড ভাইয়া-আপুদের দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই! আপনি যেখানে পড়ছেন, যেখানে থাকছেন- ওভার অল আপনার আয়ত্ত্বের ভেতরে হাতের চারপাশের পরিবেশটাকেই জান্নাতী সাজে সাজিয়ে তুলতে পারেন। খুব প্রিয় বন্ধুটির হিতাকাঙ্ক্ষী হিসেবে তাকেও আপনার পবিত্রতম অনুভূতিটির কথা জানাতে পারেন। অথবা আপনার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যিনি বা যারা আপনার খুব কাছের, তার সাথে শেয়ার করতে পারেন। আপনার রুমমেটদেরকে পর্যায়ক্রমে অভ্যস্ত হওয়ায় প্রেরণা দিতে পারেন। দেখবেন, ঠিকঠাক মত এক ডোজ পেয়ে গেলে হয়তো আপনার চেয়েও তারা অধিক যত্নবান হয়ে উঠবেন ইনশা-আল্লাহ। এতে করে হবে কি, আপনার কখনো মিস হয়ে গেলে তাঁরা আপনাকে জাগিয়ে তুলতে সহায়তা করবেন। অথবা কখনো পিছুটান অনুভব করলে আপনাকে টেনে নেবেন তাঁদেরই কেউ।   চতুর্থ গল্পটি: গল্প নয় শুধু, আমরা প্রেরণা-উজ্জীবনী চমৎকার একটি কবিতার সাথে পরিচিত হবো ইনশা-আল্লাহ। আল্লাহর ভালোবাসায় নিবেদিতপ্রাণ আরেকজন মানুষ, যিনি নিজেকে প্রায়ই স্মরণ করিয়ে দিতেন একটি কবিতা আবৃত্তি করে; আমরা সেটার কাব্যানুবাদ শুনবো: “ঘুমের তৃপ্তি তোমাকে ভুলিয়ে রেখেছে প্রকৃত আয়েশ থেকে  জান্নাতী ফুল বাগে শয্যার সুখ থেকে ঠিক গাফেল রেখে  অনন্তকাল বাঁচবে যেখানে, মৃত্যু পাবে না তোমার ছোঁয়া  প্রভূর পক্ষ থেকে নি’আমাত, যাবে না তা থেকে একটু খোয়া!  তাই বলি জেগে উঠো তাড়াতাড়ি, অশ্রু ঝরাও, তোল দু’হাত  ঘুমে নয় ভাই, আজকে না হয় কুরআন বুকেই কাটুক রাত!” [মূল কবিতা:ফাদ্বলু ক্বিয়াম আল-লাইল, আবূ বাকর আল-আজুররী, পৃ.৯]     সুবহানাল্লাহ! কতো সুন্দর সেলফ রিমাইন্ডার! আমরাও কি পারি না?   আসর এখানেই শেষ! শেষ রাত্রির গল্পের আসরের পর্দা আজ এখানেই নামলো! এবার গল্প বলার পালা আপনার। আপনার ভালোবাসার গল্পটি সোনালী হরফে লিখিত হোক আরশের খাতায়।

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
লেখকের অন্যান্য ব্লগ সবগুলো দেখুন