অনুবাদ

জ্ঞান অন্বেষনের পরিপূর্ণ ধাপ সমূহ..

জ্ঞান অন্বেষনের পরিপূর্ণ ধাপ সমূহ..
60135419_tn30_0 ১২৪৪ সাল। ছোট ছেলেদের একটা দল তাদের এক বন্ধুকে ডাকতে গেল খেলতে আসার জন্য। কিন্তু দশ বছর বয়সী সেই ছেলেটি তাদের ফিরিয়ে দিল। তারা তাকে অনেক অনুরোধ করল,এমনকি খেলতে আসার জন্য জোরাজোরিও করতে লাগল। কিন্তু সেই ছেলেটি যে কাজে ব্যস্ত ছিল, তাতেই মগ্ন হয়ে রইল। সে কুরআন তিলাওয়াত করছিল। ছেলেটির নাম ইয়াহইয়া ইব্ন শার্রাফ। ইমাম আন-নাওয়াওয়ি (রাহ়িমাহুল্লাহ) নামেই আমাদের কাছে পরিচিত তিনি। অনেক শত বছর পরে, ২০১৩ সাল। জ্ঞান এখন আমাদের হাতের কাছেই। বেশ সহজলভ্য। ইমাম নাওয়াওয়ি (রাহ়িমাহুল্লাহ)-র কাছে যতটুকু জ্ঞান সহজলভ্য ছিল, ইন্টারনেটের একটি সার্চে আমরা তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি তথ্য হাজির করতে পারি। অথচ, আমাদের মাঝে এখন ইমাম নাওয়ওয়ির মতো কাউকে খুঁজে পাওয়া ভার। বরং আমরা দেখতে পাচ্ছি জ্ঞান অর্জনের বিচিত্র ও বিপরীতমুখী এক পদ্ধতি। বর্তমানে যুগে আমাদের তরুণ ছাত্ররা ফিক়হ আর আকীদাহর অনুপুঙ্খ বিষয়ে যতটা দক্ষ,ততটা দক্ষতা নিয়ে তারা সূরা ফাতিহাটাও শুদ্ধভাবে তিলাওয়াত করতে পারে না। এসব তরুণরা বিভিন্ন আলিমদের শত শত ফাতওয়া গড়গড়িয়ে বলে যেতে পারে, কিন্তু আল-কুরআনের হাতেগোনা কয়েকটা সূরা বাদে সামান্যই মুখস্থ আছে তাদের। কোনো একটা দলের আকীদাহ কেন ভ্রান্ত, এ বিষয়ে তারা বিস্তারিত আলোচনা করতে পারে। কিন্তু তারা আরবি বোঝে না। তারা যখন সালাতে তাদের প্রভুর সামনে দাঁড়ায়, তখন তারা যে কী আওড়াচ্ছে নিজেই বোঝে না। অদ্ভুত ব্যাপার, তাই না? ইমাম ইব্ন আবদুল-বার রাহ়িমাহুল্লাহ বলেছেন, "জ্ঞান অন্বেষণের অনেকগুলো ধারাবাহিক ক্রম আর পর্যায় আছে। এগুলো এড়িয়ে যাওয়া কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। যে ব্যক্তি এ পর্যায়গুলো এড়িয়ে গেল, সে সালাফদের পথ এড়িয়ে গেল। যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে এগুলো এড়িয়ে যায়, তবে সে বিপথগামী হবে। আর যদি কেউ আন্তরিকতার সাথে এড়িয়ে যায়,তবে সে ভুলে পতিত হবে।" একজন ডাক্তার হতে যেমন বিভিন্ন ধাপ অনুসরণ করতে হয়, জ্ঞানও একই ভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে অর্জন করতে হয়। বর্তমানে সবগুলো ধাপ একসাথে মিশিয়ে ফেলায় এমন এক অবস্হার সৃষ্টি হয়েছে যেন প্রাথমিক শিক্ষা ছাড়াই কোনো ছাত্র মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করছে! অতীত আর বর্তমানের ছাত্রদের মাঝে কোন বিষয়টি পার্থক্য সৃষ্টি করেছে? অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে, তবে আমরা ছাত্র হিসেবে যে মারাত্মক ভুলটি করছি তা হলো, আমরা জ্ঞানকে আমাদের লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যম ভাবার পরিবর্তে জ্ঞানকেই আমাদের লক্ষ্য বানিয়ে ফেলেছি! কিন্তু পূর্বসূরি বিজ্ঞ ‘আলিমগণ জ্ঞানকে এভাবে দেখতেন না। বরং তাঁরা জ্ঞানকে জান্নাতে যাওয়ার মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করতেন। যখন তারা জ্ঞান অন্বেষণ শুরু করতেন, তারা এটাকে সারা জীবনের পেশা হিসেবে গ্রহণ করতেন। কারণ তাদের যে লক্ষ্য ছিল তা একমাত্র পরকালেই অর্জিত হতে পারে। আবদুল্লাহ ইবন মুবারাক রাহিমাহুল্লাহকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, "আপনি কতদিন ধরে জ্ঞান অন্বেষণ করবেন?" তার জবাব ছিল, "আমৃত্যু। কারণ আমার জন্য সবচেয়ে উপকারী বিষয়টা হয়তো এখনো আমার অজানা।" আমাদের বুঝতে হবে, দ্বীনের জ্ঞান সারা জীবন অনুসন্ধান করার বিষয়। এক মাস, কয়েক বছর কিংবা বিশ বছরেও এ অনুসন্ধান শেষ হয়ে যায় না। সালাফগণ জ্ঞান অর্জনকে জান্নাতে যাওয়ার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন, কারণ উপকারী জ্ঞান সৎ কাজের দিকে নিয়ে যায় । সুফিয়ান আস সাওরি রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, "জ্ঞানের মাহাত্ম্য তো এ কারণেই যে জ্ঞান একজন মানুষকে, আল্লাহকে ভয় করার ও মান্য করার শিক্ষা দেয়। নাহলে তো এটা আর অন্য যেকোনো জিনিসের মতোই।" আমাদের পূর্বসূরী বিদ্বানগণ শুধুমাত্র জ্ঞান অর্জন করতে হবে এ কারণে জ্ঞান অর্জন করেননি। বরং তাঁরা জ্ঞান অর্জন করতেন যাতে তাঁরা ঐ জ্ঞান অনুসারে কাজ করতে পারেন। আমাদের মন আর মস্তিষ্কে এই বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন যে, জ্ঞান হচ্ছে ‘আমাল। ‘আমাল ছাড়া জ্ঞান আমাদের কোনো কাজেই আসবে না। রাসূলুল্লাহ (সঃ)  আমাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, “কিয়ামাতের দিন মানুষ তার নিজ স্থানেই দাঁড়িয়ে থাকবে, যে-পর্যন্ত না তাকে জিজ্ঞেস করা হবে: তার জীবনকাল সে কীভাবে কাটিয়েছে, তার জ্ঞান সে কী কাজে লাগিয়েছে, তার সম্পদ কোথা থেকে অর্জন করেছে এবং কিসে খরচ করেছে...?” (তিরমিযী) এ হাদিস প্রসঙ্গে শায়খ হুসাইন আল আওয়াইশ বলেন, "নতুন করে পড়াশুনা আর লেকচার শোনার আগে নিজের ব্যাপারে সতর্ক হোন। যে-জ্ঞান ইতোমধ্যেই ‘আমালে পরিণত হয়েছে তা আমৃত্যু সঙ্গ দিবে।" ইমাম ইব্ন আল-জাওযি রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, "আর সত্যিকারের মিসকিন বা গরীব হল সে ব্যক্তি, যে এমন একটা বিষয় শেখার কাজে তার সারা জীবন ব্যয় করল, যার সাথে তার জীবনযাপনের কোন সম্পর্কই নেই। এভাবে সে দুনিয়ার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হলো এবং আখিরাতের কল্যাণও হারাল। (তদুপরি বিচার দিনে) নিজের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অভিযোগ নিয়ে নিঃস্ব হয়ে উপস্হিত হবে।" দ্বিতীয় যে ভুলটা আমরা করে থাকি তা হলো, আমরা জ্ঞানের বিষয়বস্তুর উপরই নিবিষ্ট থাকি। কিন্তু কীভাবে কোন পথে তা অর্জিত হচ্ছে তা নিয়ে চিন্তা করি না। আমাদের বোঝা উচিত ইলমের অনেকগুলো ধাপ আছে। যদি সঠিক উপায়ে না-হয় তাহলে জ্ঞানই আমাদের অধপতনের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আল্লাহর রাসূল (সঃ)  আমাদের খাওয়ারিজদের বর্ণনা দিয়েছেন। তারা দিনে রাতে কুরআন তিলাওয়াতে মগ্ন থাকত কিন্তু কুরআন তাদের কন্ঠনালী অতিক্রম করত না। আলিমগণ বলেছেন, যদিও তাদের ইবাদাত আপাত দৃষ্টিতে সাহাবাদের ইবাদাতের চেয়েও উত্তম মনে হয়, কিন্তু সুন্নাহর জ্ঞানের অভাবে খাওয়ারিজরা তাদের কাজের প্রকৃত অনুধাবন এবং পুরস্কার থেকে বঞ্চিত ছিল। জ্ঞান অর্জনের জন্য সঠিক পথ অনুসরণ না করার একটি সরাসরি ফল হল বর্তমান যুগের ছাত্রদের মাঝে 'আদব'-এর মারাত্মক ঘাটতি। আমল ছাড়া জ্ঞান অর্জনও এর অন্যতম কারণ। কেননা একজন ছাত্রের পক্ষে একই সাথে কুরআন এবং সুন্নাহর জ্ঞান শিক্ষা করা এবং তার সাথে সাংঘর্ষিক কিছু করা অসম্ভব ব্যাপার। পূর্ববর্তী বিজ্ঞ ‘আলিমগণ শিষ্টাচারের প্রতি এত বেশি গুরুত্ব দিতেন যে শিষ্টাচারকে জ্ঞানের অর্ধেক বা দুই তৃতীয়াংশ বিবেচনা করতেন। শিষ্টাচার সম্পর্কিত প্রচুর আয়াত ও হ়াদীস় আছে। তবে রাসূলুল্লাহ  (সঃ)  -এর একটা হাদিসই মুসলিমদের শিষ্টাচারের প্রতি যত্নবান হওয়ার গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য যথেষ্ট। তিনি বলেন, "পুনরুত্থান দিবসে একজন ইমানদারের পাল্লায় শিষ্টাচারের চেয়ে ভারি আর কিছু হবে না।" (তিরমিযী) আমরা আজকাল যা দেখছি তা হলো, 'তালিবুল- ইল্ম সুপারস্টার সিনড্রোম'! 'স্টুডেন্ট অফ নলেজ' এখন একটি জনপ্রিয় টাইটেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। দ্বীনের পবিত্র জ্ঞানকে আমরা তুচ্ছ সাজসজ্জার বস্তুতে পরিণত করে একে কৃত্রিম আর নকল করে ফেলেছি। জ্ঞানকে পণ্যের পর্যায়ে নামিয়ে এনে একে খেলো করে ফেলেছি। না জ্ঞানের সম্মান করি, না জ্ঞানী ব্যক্তির। ফলস্বরুপ ইলমের বারাকাহ থেকে আমরা আজ বঞ্চিত। হাবিব ইবন উবাইদ আর রাহবি রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, "জ্ঞান অর্জন করো। একে উপলব্ধি করো এবং সে অনুযায়ী জ্ঞানের প্রয়োগ করো। নিজের নাম ফলানোর জন্য জ্ঞান অর্জন কোরো না। কেউ যদি দীর্ঘ জীবন পায়, তাহলে এই জ্ঞান এমনিতেই তার সুনাম বৃদ্ধি করবে।" আমাদের মনে হতে পারে, কোন খেতাব বা টাইটেলের মাঝে ক্ষতি কী? কিন্তু নিয়্যাতের মধ্যে গলদ থাকলে সেটা কাউকে জান্নাত থেকে বহু দূরে নিয়ে যাবে। রাসূলুল্লাহ (সঃ)  বলেছেন, "পার্থিব কিছু অর্জনের জন্য যারা ইসলামিক জ্ঞান অর্জন করে কিয়ামতের দিন সে জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না।" (আহমাদ) বিশুদ্ধ নিয়্যাত জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে এবং ইসলামের যে কোন ভাল কাজের ক্ষেত্রে এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে, ভুল নিয়্যাত কাউকে জাহান্নামে পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের ঐ আলিমের উদাহরণ দিয়েছেন যারা সর্বপ্রথম জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে কারণ তারা খ্যাতি অর্জনের জন্য জ্ঞান শিখত ও শেখাত। ইমাম আহমদ রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, "যে ব্যক্তি তার নিয়্যাতকে পরিশুদ্ধ করতে পারে, তার জ্ঞানের সমপরিমাণ (পুরস্কার) আর কিছু নেই।" উপেক্ষিত কিতাব — অবহেলিত ভাষা জেনে রাখু..., আল্লাহর কিতাব ছাড়া কখনোই ইসলামিক জ্ঞানের শিক্ষার্থী হওয়া সম্ভব না। আর আরবি ভাষা না-জানা মানে কুরআনের প্রকৃত স্বাদ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা। আমরা আজ কুরআন বা আরবি দিয়ে জ্ঞানের পথে যাত্রা শুরু করি না। এটা শুধু বিজ্ঞ পূর্বসূরীদের সুন্নাহরই খেলাফ নয় বরং এটা আল্লাহর সুন্নাহরও বিপরীত । ‘আ’ইশাহ রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, "যদি কুরআনের প্রথম আয়াতেই মদ পানকে নিষেধ করা হতো, যদি কুরআনের প্রথম আয়াতেই ব্যভিচার করাকে নিষিদ্ধ করা হতো, তাহলে কারও পক্ষেই সেই আদেশ মানা সম্ভব হতো না। কুরআনের প্রথম দিককার আয়াতগুলোতে আল্লাহ মানুষকে জানিয়েছেন জান্নাতের সুসংবাদ আর জাহান্নামের ভয়াবহতা। এগুলো জানার পর মানুষের হৃদয় যখন আল্লাহর স্মরণে গলতে শুরু করল, তারপর আল্লাহ হালাল আর হারাম সংক্রান্ত আয়াতগুলো অবতীর্ণ করেছেন।" মানুষকে ইসলাম শেখানোর সেরা পদ্ধতি হচ্ছে আল্লাহ যেই পদ্ধতিতে শিখিয়েছেন, সেই পদ্ধতি। তাই কুরআন দিয়ে জ্ঞান অর্জন শুরু করাই সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত। এর ফলে আমরা আমাদের অন্তরকে আল্লাহর স্মরণে মশগুল রাখতে পারব। আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করতে পারব। কুরআনের এই ব্যাপারটি আমাদের উম্মাহর জন্য বর্তমান প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত জরুরি একটি বিষয়। আমরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এমন একটি ধ্বংসাত্মক বৃত্তের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছি যাতে কুরআনের সাথে আমাদের কোনো সেতুবন্ধন নেই। তাই আমরা কুরআন শিখতে আগ্রহী না। আমরা শিখতে আগ্রহী না, কারণ আমরা কুরআন বুঝি না। আমরা কুরআন বুঝি না, কারণ আমরা আরবি জানি না। পূর্ববর্তী ‘আলিমগণ কুরআন দিয়ে জ্ঞান অর্জন শুরু করাকে বিশেষভাবে জোর দিতেন। ইমাম আল-বাগদাদি রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “ইসলামিক জ্ঞান অর্জন শুরু করতে হলে কুরআন মুখস্থ করা দিয়ে শুরু করা সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি। কারণ এটিই জ্ঞানের সর্বোৎকৃষ্ট শাখা। কাজেই কুরআনকে সর্বপ্রথমে রাখা উচিত; সবকিছুর আগে কুরআনকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।” আমাদের অবশ্যই এটা বুঝতে হবে যে, আল্লাহর কিতাব মুখস্হ করা অনেক সাওয়াবের কাজ। কিন্তু এর উপর আ‘মাল করাটা অত্যাবশ্যকীয়। বাস্তবতা বলে, আমরা কুরআন মুখস্হ করাকে বাধ্যতামূলক করেছি, আর এর উপর আ‘মাল করাকে বানিয়েছি সাওয়াবের কাজ। আমরা ভুলে গেছি, কুরআনের জ্ঞানই শেষ কথা নয়; বরং, কুরআনের জ্ঞানকে কাজের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলাই মূল বিষয়। কুরআন মুখস্হ করা, কুরআনের ভাষা, তাফসির, ব্যাকরণ, ‘উলূম, তাজউইদ শেখাটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো কুরআনের নির্দেশনাকে বাস্তবে মেনে চলা। কুরআন নাজিলের প্রথম উদ্দেশ্য শিক্ষা দেওয়া নয়, বরং স্মরণ করিয়ে দেওয়া। আরও ভেঙে বললে, প্রকৃত লক্ষ্য হলো হিদায়াহ বা পথ দেখানো। দু'টোকে একত্রে বলা যায়, স্মরণ করার মধ্যেই পাওয়া যায় সঠিক পথের নির্দেশনা। আল্লাহ বলেন, ﻓَﺬَﻛِّﺮْ ﺑِﺎﻟْﻘُﺮْﺁﻥِ ﻣَﻦْ ﻳَﺨَﺎﻑُ ﻭَﻋِﻴﺪِ “যে আমার শাস্তিকে ভয় করে, তাকে কুরআনের কথা মনে করিয়ে দাও।” [সুরা ক়াফ, ৫০:৪৫] আয়াতটিতে আল্লাহ যাদের কথা উল্লেখ করেছেন তারা সেই সময় অনেক জ্ঞানী ছিল। কিন্তু ঐ সূরাতেই আল্লাহ বলেছেন যে, তারা রাসূলকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। না- বুঝে তারা একাজ করেনি, বরং বুঝে শুনেই তারা একাজ করেছে। আল্লাহ বলেন, ﻳُﺤَﺮِّﻓُﻮﻧَﻪُ ﻣِﻦ ﺑَﻌْﺪِ ﻣَﺎ ﻋَﻘَﻠُﻮﻩُ "বোঝার পরই তারা একে বদলে দিত।" [সূরা আল-বাক়ারাহ ২:৭৫] জ্ঞানের অভাব তাদের ছিল না। তাদের ছিল দিকনির্দেশনার অভাব। আমাদের কুরআন ও আরবি শেখার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আল্লাহর দেখানো পদ্ধতিতে তাঁরই শেখানো ভাষায় আল্লাহ স্মরণ করা। তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। আর কুরআন ও আরবি ভাষার প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা হওয়া উচিত এমন— এদুটো জ্ঞান আমাদের মধ্যে আল্লাহর স্মরণকে উত্তরোত্তর বাড়িয়ে তুলবে। কুরআনের সাথে সুন্দর সম্পর্ক গড়ার প্রথম ধাপ হচ্ছে আরবি ভাষা শেখা। আল্লাহ মুহাম্মাদ ইবন আবদুল্লাহ (রঃ)  -কে যেভাবে আমাদের রাসূল হিসেবে মনোনীত করেছেন, ঠিক তেমনি আরবিকে তিনি তাঁর ঐশী বাণীর ভাষা হিসেবে মনোনীত করেছেন। আল্লাহ কুরআনে ১১ বার বলেছেন যে, তিনি আমাদের কল্যাণের জন্যই আরবিকে কুরআনের ভাষা হিসেবে বেছে নিয়েছেন: ﺇِﻧَّﺎ ﺃَﻧﺰَﻟْﻨَﺎﻩُ ﻗُﺮْﺁﻧًﺎ ﻋَﺮَﺑِﻴًّﺎ ﻟَّﻌَﻠَّﻜُﻢْ ﺗَﻌْﻘِﻠُﻮﻥَ “তোমরা যাতে কুরআনের প্রকৃত অর্থ অনুধাবন করতে পারো, এজন্যই আমি আরবি ভাষায় কুরআন পাঠিয়েছি।” (সুরা ইউসুফ, ১২:২) ইসলামিক জ্ঞানের ছাত্র বলে নিজেকে দাবি করা কেউ কুরআন বোঝে না, কুরআনের প্রাপ্য মর্যাদা দিতে জানে না—এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্য। অবস্থাদৃষ্টে, এখন সবাই ঐচ্ছিক বিষয়ের জ্ঞান অর্জন করাকেই আবশ্যিক বানিয়ে নিয়েছে। পূর্বসূরী বিজ্ঞ ‘আলিমগণ আমাদের এ ধরনের মাইন্ড সেটের ব্যাপারে কড়াভাবে সতর্ক করে দিয়েছেন। মালিক ইব্ন দিনার রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, "আল্লাহর কথায় আনন্দ না-পেয়ে যে মানুষের কথায় আনন্দ পায়—বুঝে নিতে হবে তার জ্ঞানের পতন ঘটেছে, তার হৃদয় অন্ধ হয়ে গেছে; তার জীবন বৃথা।" আমরা কুরআনে দেখি, আল্লাহ ঈমানকে কুরআনের সাথে বেঁধে দিয়েছেন, ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺁﺗَﻴْﻨَﺎﻫُﻢُ  ﺍﻟْﻜِﺘَﺎﺏَ ﻳَﺘْﻠُﻮﻧَﻪُ ﺣَﻖَّ ﺗِﻠَﺎﻭَﺗِﻪِ ﺃُﻭﻟَـٰﺌِﻚَ ﻳُﺆْﻣِﻨُﻮﻥَ ﺑِﻪِ “যাদেরকে কুরআন দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে যারা কুরআন যেভাবে পড়া উচিত, সেভাবে পড়ে [অর্থাৎ কুরআনের আদেশ-নিষেধ যেভাবে মানা উচিত, সেভাবে মানে] প্রকৃত অর্থে তারাই কুরআনকে বিশ্বাস করে।” (সুরা বাকারা, ২:১২১) [অর্থের ব্যাখ্যা: মুহসিন খান ও হিলালী] আবদুল্লাহ ইব্ন মাস‘ঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু আল্লাহর নামে কসম করে বলেছেন, "হ়াক্ক়া তিলাওয়াতিহি,—সত্যিকারের তিলাওয়াত —হচ্ছে: যা হালাল তাকে হালাল মনে করা আর যা হারাম তাকে হারাম মনে করা। আল্লাহ একে যেভাবে নাজিল করেছেন, সেভাবেই তাকে তিলাওয়াত করা। এর কোনো একটি শব্দকেও তার প্রকৃত অর্থ থেকে বিকৃত না করা এবং যেভাবে তা ব্যাখ্যা করা উচিত নয়, সেভাবে ব্যাখ্যা না করা।" বুঝতে চেষ্টা করুন: আমাদের জ্ঞান আমাদের দুদিকেই টেনে নিতে পারে। জ্ঞান অর্জন হয় আমাদেরকে আল্লাহর কাছাকাছি নিয়ে যাবে নয়তো এটা আমাদের আখিরাতকেই বরবাদ করে দেবে। আমাদের সংস্কারের দায়িত্ব আমাদেরই। জ্ঞান যেন ইহকালীন ও পরকালীন সাফল্য লাভের মাধ্যমে পরিণত হয়, আল্লাহর কাছে সবসময় সেই দু‘আই করা উচিত আমাদের। সুতরাং, এখনই সময় জ্ঞান অন্বেষণের হারিয়ে যাওয়া সেই সুন্নাহকে ফিরিয়ে আনা। ইসলামিক জ্ঞানকে তার মর্যাদাপূর্ণ আসনে পুনরায় উন্নীত করা।   মূল- ইউসরা ওয়াইজ (আমাতুল্লাহ) । সম্পাদনা- মাসউদ শরীফ।

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)