অনির্ধারিত

আবার দেখা যদি হল, সখা, প্রাণের মাঝে আয় (পর্ব-১)

আবার দেখা যদি হল, সখা, প্রাণের মাঝে আয় (পর্ব-১)
কে যেন একবার বলেছিলো, 'মানুষের জীবনের কোন একটা সময় কিছুদিনের জন্য হলেও হোস্টেল বা এরকম কোন জায়গায় থাকা উচিত। নিজেকে চেনা যায়।' শুধু এই সত্য অনুধাবনের জন্য না, ঢাকার রাস্তার অনিবার্য ভালোবাসাময় জ্যমের আদরে অতিষ্ঠ হয়ে ২০০৬ এর শেষের দিকে ভার্সিটির হলে এপ্লাই করেই ফেললাম। যদিও জানি, শহরেই যাদের বাসা, তাদের সিট দেয়া হয় না। কিভাবে যেন সিট হয়েও গেলো। মনে আছে, হলগেটে টাঙ্গানো লিস্ট দেখে আমি আর ইশিতা উদবাহু নেচেছিলাম। কয়েকটা আপু একটু হেসে কাজে বের হয়ে যাচ্ছিলেন, এরকম পাগল দেখেই অভ্যস্ত কিনা! তো, নাচানাচির ফাঁকে ইশিতা একবার বলে দিলো, এখন থেকে তোমার রুমেই আসবো। কি মজা। না হয় আমি জিগেসই করতে পারছিলাম না, আমিই না সিট পেলাম, তুমি নাচো কেন?   ডিসেম্বরের এক কাক ডাকা ভোরে ১২২ এর সামনে এসে দাঁড়ালাম। এই সেই ১২২, কত রোদেলা বা বিষন্ন দুপুরের সাক্ষী আমার। মুজতবা আলীর শবনম পড়ে বালিশ ভিজিয়ে কান্নার ১২২, বাসায় আব্বুর ড্রয়ারে প্রিন্ট করা বায়োডাটা দেখে জিনিসপত্র ভেঙ্গে হলে এসে ফোন অফ করে বসে থাকার ১২২। দেড় বছরের হল জীবনে আমি সবচে বেশী উপভোগ করেছি আমার স্বাধীনতা। যখন তখন আকাশের নিচে থাকার স্বাধীনতা, মন খারাপের তারা গোণার সময় ঘাসে শুয়ে আবার ধরা পড়ে ২১৩ তে যাওয়া, ব্যডমিন্টন খেলা, যে আমার বয়স ১২র পরে আর র‍্যকেট হাতে নেয়া হয়নি। সবচে থ্রীলিং ছিলো, পৌণে দশটায় ঘড়িতে তাকানো। হলের গেট দশটায় বন্ধ হয়। মাঝে মাঝে পৌণে দশটায় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মনে হত সেই অনবদ্য ডায়ালগ, 'কী আছে জীবনে?' দশ মিনিটে ব্যগ গুছিয়ে নয়টা পঞ্চান্নতে হলের মামার প্রশ্ন চোখের সামনে দিয়ে দৌড়ে বের হওয়া, 'এই মামা, যাবেন?' আর বাসায় এসে আব্বুর বকা শুনতে শুনতে ব্যকুল হয়ে ঘরের গন্ধ নেয়া, ডাইনিং এ ভাত খেয়ে ঢোল হওয়া পেটে হাত বুলিয়ে আবার টেবিলে বসা...  আসলেই তো, কী আছে জীবনে?   আমার হল জীবনের গল্প দুইটা ডিজিট কেন্দ্রীক; ১২২ আর ২১৩। ১২২ এ বিভিন্ন সময়ে মোট চারজন রুমমেটের সাথে থেকেছি। সে এক আজব কম্বিনেশন, কোন কিছুতেই আমরা এক না, বরং প্রতিটা ইস্যুতে এসেন্ডিং বা ডিসেন্ডিং অর্ডারে সাজানো। উদাহরণ দিই। হয়তো রুমে একটা চামচিকা ঢুকে গেছে। সোনিয়া আপু তাঁর সদা টাঙ্গানো মশারীর ভেতরে ঢুকে ইন্সট্রাকশন দিচ্ছেন, 'এই এই এভাবে না এভাবে না, হাতে কাপড় জড়িয়ে ধরেন আনিকাপু।' আর আনিকাপু? খালি হাতে দর্শনীয় ঝাঁপ দিচ্ছেন, কিছুক্ষণ পর চামচিকার ছোঁয়া লাগতেই চিৎকার, 'ইয়া আল্লাহ কি কিউট, কী নরম'। মশারী নিবাসীনীর বমনেচ্ছার উর্দ্রেক, কিন্তু বের হয়ে টয়লেটে যাবার সাহস নাই। আমি বরাবরই মধ্যম পন্থার অনুসারী, মৃদূ লাফঝাঁপের পর রুমের কোণায় আত্নগোপন করে আছি হয়তো। কিছুদিন পর আসলো মালা। একটা মায়াবতী মেয়ে, ভেতরে ভেতরে চরম 'ন্যত্রকুণাইয়ান', অরিজিনাল বিটলা। তার আবার আরেক দশা, সে তেলাপোকা ধরতে পারে, কিন্তু সেসময় কেউ চিৎকার করলে আবার তার ভয় লাগে। সুতরাং তাকে দিয়ে তেলাপোকা ইত্যাদী ধরানোর সিস্টেম হোলো, যতই ভয় বা ঘেণ্ণা লাগুক, চিৎকার করা যাবে না। অবশ্য তেলাপোকার আবির্ভাবে রুমে কি কি হত আমার ভালো মনে নাই, আমি সেসময় খুব ধাতস্থ থাকতে পারি না, আজও না!   অথবা ধরা যাক এফেয়ারের কথা। আমি হয়তো এর ঘোর বিরোধী, আনিকাপু গলা নামিয়ে ষড়যন্ত্রীর মত বলছেন, 'জানো আজকে কি হইসে? ______ শালা না আজকে দীপিকাকে বলসে ওকে সঞ্চয়িতা কিনে দিবে। হে হে চিনে নাই... -ক্যন আপু? -এরপর থেকে কমপক্ষে পঞ্চাশটা কল পাইসে, সবগুলা মেয়েদের। সবাই ওর কাছে সঞ্চয়িতা চায়। তুমিও কল দিবা নাকি একটা? আর মালা? রুমের বাইরে কারুর প্রেমময় ফোনালাপের আওয়াজ কান পেতে শোনা আর শেষ হলে সেই আপুকে গিয়ে বলা, 'আপু শুনেন। আমার রুমের সামনে আপনের বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বইলেন না , আমার সমস্যা হয়। আমার একলা একলা লাগে' (নেত্রকোণার টোন লেখায় দেয়া যাচ্ছে না, কারো জানা থাকলে সেই টোনে পড়ে নিয়েন) !!!   অথবা ধরা যাক, পড়াশুনার কথায়। আমি আর আনিকাপু দেশ জাতি নিয়ে চরম আলোচনায় মত্ত, রাত হয়তো সাড়ে তিনটা। আমাদের গরম আলোচনায় বিরক্ত সোনিয়াপু হয়ত সে-ই এগারোটায় কমন্ রুম বা রিডিং রুমে থানা গেড়েছেন। হাঁটতে হাঁটতে পড়তে পড়তে কিংবা উনার তিনটা ফোনের কোন একটার চার্জার বা হেডফোন নিতে রুমে এসে আমাদের এই 'অপচয়' দেখে সিনিয়র ভুলে উপদেশ দেয়া শুরু, 'আনিকাপু, আপনের না কালকে দুইটা ক্লাসটেস্ট?' আনিকাপুর চেহারায় তখন বুদ্ধের গাম্ভীর্য, 'ঘোর কলিকাল! আমারই জুনিয়র, আমাকে উপদেশ দেয়!!' কিংবা, আমাকে আর আনিকাপুকে হাতে ধরে (আক্ষরিক অর্থে)সোনিয়াপুর ওয়াদা করানো, 'আমি এই একটু ঘুমাবো, আমার এলার্ম বাজলে আমাকে ডেকে দিও?' অতঃপর উনাকে ডেকে বসানো এবং বিছানার অভিকর্ষে আবার ঢুলে পড়ে যাবার দৃশ্য ভিডিওকরণ, আর তিন চাররাতের অঘুমা আপুটা দুই ঘন্টা পর উঠে যখন বিষদৃষ্টিতে আমার আর আনিকাপুর দিকে তাকাচ্ছেন, তখন ভিডিও দেখিয়ে রুমে হাসির রোল তুলে দেয়া।   অথবা, আমি হয়ত এই দশমিনিট পর উঠে যাবো, চোখ ঘুমে ঢুলুঢুলু, বাকিসব ঘুম, আমার টেবিলল্যম্পটা রুমের অন্ধকারকে আরও ঘন করে দিচ্ছে। এমন সময় কানের কাছে গা ছমছমে কন্ঠস্বর, 'তোমার কাছে চাবানোর কিছু আছে?' আমি আক্ষরিক অর্থে এক হাত লাফ দিয়ে তাকিয়ে দেখি সোনিয়াপু, 'ক্যন আপু?' 'আমার ঘুম আসছে, তিনরাত ধরে ঘুমাই না'। অতঃপর আমার টিনে অবহেলায় পড়ে থাকা প্রস্তরসম লাড্ডু হস্তান্তর আর 'চাবানোর জিনিস' হাতে খুশী মনে সোনিয়াপুর স্বদেশ থুক্কু রিডিংরুমে প্রত্যাবর্তন! আর মালা? খাতা বই রেডি করে চেয়ারে বসে 'পড়ার মুডের' অপেক্ষায় ঘুমিয়ে যাওয়া সেই নিষ্পাপ চেহারা। এই বাবদেও আমি মধ্যমপন্থী, ক্লাসটেস্টের আগের রাতেও চারটা পর্যন্ত গল্পের বই পড়েছি, অন্য কেউ হয়ত লাইনে আছে , সকালেই দিয়ে দিতে হবে... কী আছে জীবনে?   (২১৩ র গল্প চান? জানিয়ে যান কিন্তু... নইলে পর্ব দুই আসবে না )

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)