অনির্ধারিত

আলোর অপেরা...

আলোর অপেরা...

কিছুটা দৌড়াদৌড়ি করেই রাস্তাটা পার হয়ে পাশের মসজিদতায় তাড়াতাড়ি ঢুকে পরলেন জাহিদ সাহেব।শীতের বিকেলগুলোও এতো বিষম রকমের অদ্ভুত,একদমই হুড়হুড় করে ধৌয়া ওঠা কফি মগটার মতো।ঢেকে রাখলেও নিমিষেই বিন্দু বিন্দু জলকণা হয়ে কফির সাথে মিলিয়ে যায়।এ যেনো মনে কোণে বিন্দু হতে সিন্ধু হয়ে ওঠা অগণিত নিরুত্তাপ স্মৃতি।।

আসরের নামাজটা পড়তে আজও দেরি হয়ে যাওয়ায় মনে মনে নিজেই নিজের ওপর একটু বিরক্ত হলেন জাহিদ সাহেব।একবার ভেবেছিলেন নামাজটা পড়েই অফিস থেকে রওনা দিবেন,পরে আবার ভাবলেন এলাকার মসজিদেই পরবেন।রুবাইয়া কয়েকদিন ধরে কিছুটা অসুস্থ,তাই তাড়াতাড়ি ফেরা দরকার।।

এমনিতেই দেরী হয়ে যাওয়াতে আসরের নামাজের পর আর বাসায় না গিয়ে মসজিদেই থেকে গেলেন।মসজিদের একপাশে জানালার ধারে বসে তাসবীহ পাঠ করতে করতে মাগরিবের নামাজের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।।

ইদানীং উদাসভাবে বসে বসে আকাশ দেখার এক অন্যরকম অভ্যাস পেয়ে বসেছে জাহিদ সাহেবের।বয়স বাড়ার সাথে সাথে এমনিতেই নিস্তদ্ধতা জীবনের সঙ্গী হয়ে যায়।আর সন্ধ্যার এই মুহূর্তগুলোর সাথে দিনের এই মিলিয়ে যাওয়া সময়গুলোর সম্ভবত অন্য রকম এক মাত্রা যোগ করে। মিলিয়ে যাওয়া দিনান্তের এই সময়টা'তে আকাশটা বেশ অদ্ভুত ঠেকে তার কাছে।প্রজাপতির ডানায় ভর করে পেরিয়ে যাওয়া সেই রঙ-বেরঙের সময়গুলো কিভাবে যেন এক নিমিষেই অর্নিবান শিখার ন্যায় প্রজ্জলিত হয়ে ওঠে চোখের মণিটার স্বচ্ছ প্রতিচ্ছায়াটায়।

কি ছিল না সেই দিনগুলোতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সাথে ফুটন্ত খইয়ের মত গমগমে আড্ডা, চারুকলার বকুলতলায় সেই কর্মব্যস্ত দিনের রির্হাসেলের শেষ মুর্হুতটা।আর এই রকমই শীতের ঝিমিয়ে পরা কোন এক বিকালের সূর্যের সেই তেছরা আলোয় রুবাইয়াকে প্রথম দেখা।

আনমনেই সেই দিনটির কথাই ভাবতে লাগলেন জাহিদ সাহেব।

মঞ্চে অভিনেতা হিসেবে বেশ ভালোই নাম কামিয়ে ফেলেছিলেন ততদিনে।সেবার তাঁর দায়িত্ব পড়ল শো এর টিকেট চেকারের।রুবাইয়া তখন সবেমাত্র জুনিয়র ব্যাচে দলে ঢুকেছে।সেদিন টিকেট চেক করতে করতে বিরক্ত হয়ে যখনই হাতটা গুটিয়ে নিচ্ছিলেন,তখনই গেট দিয়ে ঢুকলো 'রুবাইয়া'।

রুবাইয়া তখন বেশ নতুন..তাই টিকেট চাইতেই,কি বলবে বুঝতে না পেরে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকলো।পাশে বসা মুনীর ভাই বলে ওঠলেন,"আরে ও তো আমাদের নতুন ব্যাচের জুনিয়র।"

জীবনের এক অড়ারম্বর দিনের শেষে একটি ঝলমলে মূর্হুত ঠিক কখন যে গুটিগুটি পায়ে সামনে এসে দাড়াঁয় সেটা কারোরই জানা থাকে না...জাহিদ সাহেবও জানতেন না।অদ্ভুত এক নিশ্চুপ নিমগ্নতার অনুভূতির দীপ্তিমান শুরুটা যে ঠিক কবে আর কোন মুর্হুতে শুরু হয়ে গিয়েছিল,জাহিদ সাহেব আজও বুঝতে পারেন না!

সৃষ্টার কাছে এ ব্যাপারে তিনি আদতেই তাই একটু বেশিই কৃতজ্ঞতা বোধ করেন... তাঁর সেই অপার মুগ্ধতার রেশটাকে আজ অবধি অক্ষুন্ন রাখার জন্য।।

সম্ভবত কিছু কিছু মুর্হতের মুগ্ধতার রেশ এত তাই প্রবল থাকে যে ব্যক্তি মাত্রই তাকে মানবিক অনুভূতিগুলোর সবচেয়ে উপরে চির অম্লান এক জায়গায় স্থান দিয়ে দেয়।।

সময়ের জটিলতাগুলো বরাবরই মানবিক অনুভূতিতে বিরূপতা বা ভিন্নতা এনে দিতে পারে কিন্তু সেই মুগ্ধতার রেশগুলো শ্রদ্ধার মোড়কে আজীবন অক্ষুন্ন থাকে।।

কিছুদিন পরের কথা...স্টেজ ডিজাইন শেষ করে নিজ হাতেই ঝাড়ু দিচ্ছিলেন জাহিদ সাহেব।আর সামনে সারিতে বসে থাকা দলের জুনিয়রগুলোর দিকে তাকিয়ে রাগে কটমট করছিলেন।হঠাতই খেয়াল করলেন তার পাশে কে যেনো একই কাজ করছেন..হুম,তা আর কেউ না 'রুবাইয়া'!!

ধীরে ধীরে একসাথে পথচলার শুরুটা সম্ভবত তখন থেকেই...সেই যে জীবনকে কর্মময় করে তুলতে এক 'অপেরা'র সঙ্গী হয়ে দুজনের একসাথে পথ চলার শুরু আর তা থেকে জীবনের নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে জীবনের মানে'টার নতুন অর্থ খুজে নিয়ে নতুন আর অন্য এক 'আলোর অপেরা'র সাথে যাত্রা...সবই একই বিনিসুতোয় বাঁধা পরেছিলেন তারা একসাথে।।

জীবন নদী সময়ের চক্রে একেক সময় একেক দিকে বাঁক নেয়...চেনা মানুষগুলো নতুন স্বাদে নতুন চাদরে জড়িয়ে ভিন্ন এক সত্তায় রূপ নিতে থাকে, সেটাই জীবনের সাধারণ পরিব্যাপ্তি।।

কিন্তু এই যে সবগুলো বাঁকের ভিতরে সম্পর্কগুলোকে ভালবাসার, তাদের নিয়ে টিকে থাকার -বেঁচে থাকার তীব্র আর অকৃত্রিম যে অনুরাগ সেটাই তো এই কঠিন জীবন পথে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।।

একে -অন্যের সাময়িক ক্ষুদ্রাতি-ক্ষুদ্র ক্ষুদ্রতাগুলোকে জয় করে শুদ্ধতার মন্ত্রে নিজেদের আবারো দীক্ষিত করে নেয়া অমিত প্রেরণা।।

আর কি চাই এই জীবনে!!

রুবাইয়ার কাছে জাহিদ সাহেব একটা প্রশ্ন বেশ আগ্রহ নিয়েই জানতে চেয়েছিল, সেই অন্যরকম নতুন অপেরার সাথে পথচলার কিছুদিন পরেই।।

: "আচ্ছা বল তো, আজকের আমি আর সেই নতুন পরিচয়ের আমি'টার মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়??"

বেশ খানিকটা সময় নিয়ে আনমনে সাবলীল কন্ঠে রুবাইয়া উত্তর দিয়েছিলো,

:" তোমার হৃদস্পন্দনটা"!!

মুহূর্তেই বিমূঢ় হয়ে চেয়েছিলেন রুবাইয়া চোখটার দিকে।না,তাতে এক বিন্দুও অমনোযোগীতা ছিল না জাহিদ সাহেবের।।

রুবাইয়ার ভাষ্যমতে প্রতিটি বিশ্বাসী প্রাণের এক অদ্ভূত হৃদস্পন্দন থাকে।সেই যে প্রতিটি হৃদস্পন্দনে একজন বিশ্বাসী জাগতিক সকল পাওনা চুকিয়ে একমাত্র সেই আরশে আজীমের তরে নিবেদিত হতে চায়...তা সে বাম হাত থেকে লুকিয়ে ডান হাত দিয়ে দান করা হোক কিংবা অতি রাগান্বিত মুর্হুতে রাগকে সংবরণ করে নেয়া!!

একজন বিশ্বাসীকে তো তার বিশ্বাসের পরীক্ষা দিতে হয় প্রতি মুর্হুতে।প্রতিটি সময় তার হৃদস্পন্দনে কড়া নেড়ে,তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে যায় প্রতিটি মুহূর্তকে অর্থবহুল করে তোলার মহত্ব...ব্যয়িত প্রতিটি সেকেন্ড তাকে অনুতাপের পারদে ফেলে বারংবার কর্মের সাফল্যের বাটখারায় পরিমাপ করিয়ে নিতে বলে...তাই এক একজন বিশ্বাসীর প্রতিটি মুহূর্তের এক একটি হৃদস্পন্দনে নতুন উদ্যমে নিজেকে নতুন করে গড়ে তুলতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়!!

রুবাইয়ার ভাষ্যমতে, সেই হৃদস্পন্দন বেশ সরল কিন্তু বিশেষ এক ছন্দে সদা স্পন্দিত হতে থাকে।তাই সম্ভবত কোন বিশ্বাসীর জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তটাও এক সময়ে তার কাছে সবচেয়ে আকাঙ্খিত মুহূর্তে পরিণত হয়...কারণ সেই সময়টাতেই যে,সে তার স্রষ্টার নিকটবর্তীতা সবচেয়ে বেশি অনুভব করতো।।

রুবাইয়ার ভাষ্যমতে আগে আর পরের সেই হৃদস্পন্দিন গতির তারতম্য, তিনি অনায়াসে পার্থক্য করতে পারেন।।

আপনার সেই কাছের মানুষটা যে কি না আপনার হৃদয়ের একান্ত কাছের, যে কিনা আপনার জীবনের সব দূর্বলতাগুলোকে সবচেয়ে বেশি দেখেছে এবং বিনাদ্বিধায় সব মেনেও নিয়েছে তাকেই কি বলা যায় 'আপন মানুষ'???

:হু,হবে হয়তো!!

তবে সবচেয়ে মুশকিলের ব্যাপারটা হচ্ছে, এদের কোন মন্তব্য আপনি চাইলেই উড়িয়ে দিতে পারবেন না, তা সে যতই আজগুবী লাগুক না কেনো।।

রুবাইয়ারর জবাবটাও তাই জাহিদ সাহেব দিনশেষে কিছুটা মেনেও নিয়েছি।

অপেরার সঙ্গী তো তারা বরবরই ছিলেন কিন্তু যুগল পথের সঙ্গী হয়ে এক নতুন শ্বাশত আর সত্য পথের আলোর অপেরায় তাদের অবিরত পথচলা, তা কি একা অতটা সহজ হতো??

খোদার রঙে রঙিন হওয়ার সেই থেকে আজ অবধি,এই অক্লান্ত যাত্রা পথে কেউ যদি তাঁর পাশে কদমে কদমে রেখে না হাঁটতো...তীব্র হতশার মুর্হূতেও অনুপ্রেরণার সেই সিগ্ধ বাতাস বইয়ে না দিতো... আরেকটি বিশ্বাসী প্রাণ যদি এই সব জায়গায় তাঁর সঙ্গী না হতো"..এই সব ভাবনা তাকে প্রায়ই ভাবনার সাগরে ফেলে দেয় এবং আরেকবার স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মনটাকে সিক্ত করে তোলে।। এটা ঠিক যে,জীবন কখনো কারো জন্য থেমে থাকে না...কিন্তু কর্দমাক্ত পথের চেয়ে পিচ ঢালা পথটা যে আদতেই অনেকখানি সহজ, সে ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।রুবাইয়া তার জীবনে সেই পিচ ঢালা পথ!!

জাহিদ সাহেব প্রায়ই ভাবেন,"সেই ধূসর চোখের মায়ায় পরে যাওয়াকে কি আমি কুদরতের কোন ইশারা হিসেবে ভেবে নিবো??"

এই যে কোন ধরণের স্বাগত সূচনা ছাড়াই জীবনের এত আকাঙ্খিত মুহূর্তগুলোর পথে আনমনা পথচলা... অনেক দূর হাটার পর ছোট একটা হোঁচট খেয়ে পাশে খুব কাছের কাউকে অথবা অলস সন্ধ্যাতে বেদনার নীল রঙগুলো যখন আকাশ ছেয়ে যায়,তখন চুপ করে পাশে বসে থাকে খুব কাছের কাউকে আবিষ্কার করে নেয়া!!

১০

সেই সাথে রুবাইয়ার ভিতরের একটু ভিন্ন সেই সরল সত্তাকে আবিষ্কার করাটাও জাহিদ সাহেবের জন্য একটু বেশিই রোমাঞ্চকর ছিলো।।

যেখানটায় আগে জাহিদ সাহেব শুধু এক জটলা মেঘ দেখতে পেতেন,তাতে যে তিনি সূর্যের আলোকচ্ছটাও আবিষ্কার করতে শিখেছেন।।

জীবনের পাওনাগুলোর হিসেব মিলানো বেশ ভার।কিন্তু জাহিদ সাহেব বেশ সচেতন হয়ে বলতে পারেন, তাদের জীবনের অসংখ্য রাত জোৎস্নাকে বুকে নিয়ে মেঘেদের,তন্দ্রার কিংবা জোনাকিদের সাথে করে গল্প রচে গেছেন। কিংবা অতলান্তিক বিষাদ মাখা রাতগুলোয় চুয়ে চুয়ে পরা কুয়াশাগুলোকেও তারা একসাথে আপন করে নিয়েছেন।।

তবুও,এই আত্মিক সম্পর্কগুলোয় কিছুটা অভিমান থেকেই যায়।তাই জাহিদ সাহেবের মনে অভিমানের সুরে মাঝে মাঝে বলেও ওঠে,"ইশ..আরেকটু যদি বেশি ভালোবাসতো সে আমায়??"

তাই এই শেষ বয়সে এসেও জাহিদ সাহেবের মনে এই গানের কলিগুলো সব সময় বাজতেই থাকে... 

"আকাশ পারে ওই অনেক দুরে
যেমন করে মেঘ যায় গো উড়ে।
যেমন করে সে হাওয়ায় ভাসে
কই তাহার মতো
তুমি আমার স্বপ্নে কভু ভাসনাতো।।

চাঁদের আলোয় রাত যায় যে ভরে
তাহার মতো তুমি করোনা কেন
ওগো ধন্য মোরে।

অলির কথা শুনে বকুল হাসে
কই তাহার মতো
তুমি আমার কথা শুনে হাসনাতো
ধরার ধূলিতে যে ফাগুন আসে
কই তাহার মতো
তুমি আমার কাছে কভু আসনাতো।।"

১১

মাগরিবের নামাজ শেষ করে বের হতেই পুরোনো বন্ধু 'সৌরভ' আর 'জুনায়েদ' সাথে বহুদিন পর দেখা হয়ে গেলো জাহিদ সাহেবের।সৌরভটা বেশ বুড়ো হয়ে গেছে..চোখে খুব একটা ভালো দেখে না।দাঁতগুলোও প্রায় নাই বললেই চলে..শুধু রয়ে গেছে মুখে সেই অমায়িক হাসিটা আর বন্ধুর জন্য অকৃত্রিম ভালোবাসাটা!!পুরোনো দিনের আলাপে মুখর হয়ে ঘরের পথে পা বাড়ালো তাঁরা!!

('আলোর অপেরা' শিরোনামে একটা গল্প লিখবো ঠিক করেছিলাম আরো পাচঁ-ছয় বছর আগে।দিনে দিনে মাথায় শিরোনামদের সংখ্যা বাড়তে লাগলো আর এদের মাথায় নিয়ে চলাফেরা করাটা আমার জন্য ততই কঠিন হতে লাগলো...কথা নেই বার্তা নেই,হঠাতই এরা হামলে পরে বর্তমানের সব চিন্তাগুলোকে গুরুতরভাবে বির্পযস্ত করে দেয়। শেষমেষ এদের আর মাথায় রাখতে না পেরে পুরোনো এক খাতার পিছনের পাতাটায় টুকে রেখেছিলাম। ।

যাই হোক,বহু বসন্ত পেরিয়ে এই তীব্র গরমের দিনে শিরোনামটিকে একটি অবয়ব দিতে পেরে আমি সত্যিই বেশ আনন্দিত!!)

উৎসর্গঃ'আলোর অপেরার' প্রতিটি যুগল সঙ্গীদের..(সাথে 'জাহিদ' ভাই এবং তার 'রুবাইয়াকে')


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
লেখকের অন্যান্য ব্লগ সবগুলো দেখুন