"স্বপ্নও কি কখনো বেলাভূমির জলরাশিতে পা ডোবাতে পারে,
অথবা অস্তমান বালুকাবেলার সঙ্গী হতে.."
হাত থেকে কলম ফেলে চেয়ারে অলিয়ে বসলো নাবিলা..
"একটু গ্রীন ট্রি সাথে থাকলে ভালো হতো..আরও দু'কলম লেখা যেতো,মনের সুখে"..মনে মনেই ভাবলো নাবিলা। কিন্তু এতরাতে রান্না ঘরে যাওয়ার মতো কোন এর্নাজিই নেই তার।। আর কাউকে বলবে এমন কোন মানুষ আশেপাশেও নেই.. কোনকালেই ছিল না ...
ছেলেটা নড়াচড়া করতেই সোজা হয়ে বসলো সে.. না,সাদ ঘুমিয়ে পড়েছে আবার..বহুকষ্টে ঘুম পাড়িয়েছে..বাচ্চাদের এমনিতেই রাতে ঘুম পাড়াতে বহু কাঠ -খড় পোড়াতে হয়..আর অসুখ হলে তো কথাই নেই..সিজন পরির্বতনের সময়টায় বলা নেই কওয়া নেই কোথা থেকে যে জ্বরের উদয় হয়..
সময়টা দেখার জন্য মোবাইলটা হাতে নিতে গিয়ে আবারো রেখে দিলো নাবিলা..
ইদানীং নাবিলা আর সময়ের ব্যাপারে আগ্রহ বোধ করে না.. সময় তাকে যেখানে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে যেখান দাড় করাবে সেখানে গিয়েই দাড়িয়ে যাবে সে,যেমন টা সমুদ্রের জলরাশিতে বিলীন হয়ে যাওয়া মুক্তো।। মুক্তোর জানা থাকে না সে কোন বেলাভূমিতে সমুদ্র জলরাশির সাথে আছড়ে পড়ছে.. জোয়ারে সে এক তীরে আছড়ে পড়ে আর ভাটায় তাকে সেই জলরাশি আবারো টেনে নিয়ে যায় সমুদ্রগর্ভে..এই তার নিত্য দিনকার পথচলা।
"উফফফ"..আবারো সেই সমুদ্র।
আনমনেই বলে ওঠলো নাবিলা।নিজের এই উচ্ছনো যাওয়া চিন্তা নিয়ে নিজের ওপরে খুব বিরক্ত নাবিলা।কোথা থেকে যে এই সমুদ্র পোকা মাথায় ডেরা বাধলো, ভেবেই অবাক হচ্ছে সে।
হঠাতই সে দিন সানিয়া দেখা হয়ে গেল রাস্তায়। কথায় কথায় কত কথা যে বললেন, এই সামারের কোথায় যাবেন, তা নিয়ে কত-শত প্লান।গেল শীতে থাইল্যান্ড কোথায় কোথায় ঘুরেছেন আর কত শপিং করছেন তার ফিরিস্তি তুলে ধরলেন।
নাবিলা বরাবরই একজন মনোযোগী শ্রোতা এবং নীরব দর্শক।সে জন্যই সম্ভবত বাচ্চাদের স্কুলের অন্য অভিভাবকরা একটু বেশিই পছন্দ করেন..!! সানিয়া ভাবীর কথাও খুব মনোযোগ দিয়ে, হেসে হেসে উত্তর দিয়ে যাচ্ছিল নাবিলা
হঠাতই সমুদ্র শব্দটা শুনেই কেন যেন নাবিলার নিউরনগুলো সজাগ হতে শুরু করলো..!!
হামীম ঘুমিয়ে গেছে অনেক আগেই। নাবিলা চেয়ার থেকে ওঠে গিয়ে হামীমের মাথার পাশে গিয়ে বসলো।গভীর ঘুমে মগ্ন। আর সেটাই তো স্বাভাবিক, রাতটা তো আর কম হলো না।গভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকলো তাঁর দিকে।
একটা সময় সেই মুখটার দিকে তাকিয়ে গভীর ভালবাসা আর কষ্ট দুটোই অনুভব কররতো নাবিলা।এখন আর কোন কিছুই অনুভব করে না সে।
বিয়ের কিছুদিন পরেই লজ্জার মাথা খেয়ে হামীমকে একদিন বলেই ফেলেছিল সমুদ্র দেখতে যাওয়ার ইচ্ছেটার কথা।
নাবিলার প্রায়ই মনে হয়, যে জিনিস মানুষের স্বপ্নে চলে আসে, তা আর বাস্তবে আসে না।
সাদের নড়াচড়া শুনে ভাবনার সাগর থেকে তীরে ওঠে এলো নাবিলা।বহুকষ্টে সাদের কান্না থামিয়ে ঘুম পাড়ানো চেষ্টা করতে লাগলো।হামীম বাচ্চাদের কান্নার আওয়াজ একদমই সহ্য করতে পারে না,প্রচন্ড বিরক্ত হয়।আর সাদের কান্নার আওয়াজ তো একদমই না।ছেলে বলে কথা।
সাদকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়ানোর জন্য হাটা -হাটি করতে লাগলো নাবিলা।অসভ্য সমাজের হিপোক্রেসি সহজে নির্ণয় করা গেলেও সভ্য সমাজের হিপোক্রেসি বুঝতে বা বলতে পারাটা ততটাই দায়।তাই নাবিলাও এখন চুপ করে থাকতে শিখে গেছে।
সাদকে শুইয়ে দিয়ে রান্না ঘরে ঢুকলো নাবিলা।এবার আর গ্রিন ট্রিটা না খেলেই।চায়ের জন্য চুলায় পানি চরিয়ে দিয়ে,নিজের ডেস্কটার দিকে এগিয়ে গেলো নাবিলা।
নিঃশব্দে নিজের প্রিয় কবিতাটার কথাটা টেনে বের করে হাতে নিলো।এই খাতাটা নাবিলার অসম্ভব প্রিয়।নাবিলা তার সব প্রিয় কবিতাগুচ্ছ নিজের হাতে,নানা রঙের কলম দিয়ে লিখে রেখেছে।সে অনেক পুরোনো কথা,যখন নাবিলা রাত জেগে জেগে কবিতা পড়ত,আর পছন্দের কবিতা বা তার লাইন খাতায় টুকে নিতো।
নাবিলার রাত জেগে কবিতা পড়ার দিনগুলো বহু আগেই শেষ হয়েছে..নাবিলা এখনও রাত জাগে, তবে তা অন্য কারণে।
খাতাটা খুলেই প্রথম কবিতাটা পড়তে শুরু করলো নাবিলা..
"কেউ কথা রাখে নি,ত্রিশটি বছর প্রতিক্ষায় আছি..."
আনমনা ক্ষণ থেকে বাস্তবে ফিরে এসে,খাতাটা টেবিলের উপর রেখে দ্রুত রান্না ঘরের দিকে হাটতে লাগলো নাবিলা..
চা পাতি দিয়ে কিছুক্ষণ আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে লাগলো নাবিলা।আনমনে কবিতার লাইনগুলো আওড়াতে লাগতলো মনে মনে।
একসময় সুনীল বাবুর এই কবিতা অনেক পছন্দের ছিলো নাবিলার..ইদানীং সে আর আগেকার আগ্রহটা আর খুজে পায় না !
সেটাই তো-অপেক্ষা, প্রতিশ্রুতি, কথা রাখা, এগুলোকে সক্রিয় কোন শব্দই আর মনে হয় না তার কাছে । শব্দগুলোকেও বেশ অপরিচিত মনে হয় তার কাছে!
প্রতিক্ষীত ব্যক্তি আর প্রতিক্ষীত বস্তু,দু'ই খুব অদ্ভুত ঢেকে তার কাছে। একজন ডুবে মরে আর একজন ডুবায়ে মারে..
"হা হা হা"আনমনেই হাসতে লাগলো নাবিলা।
তবে সুনীল বাবুর সৌভাগ্য মনে হয় নাবিলার কাছে,মাত্র ত্রিশটি বছর প্রতিক্ষা করেই,নিজের অব্যক্ত কথাগুলো বলে ফেলতে পেরেছেন..
কত -শত মানুষের জন্য যে প্রতিটি রাতই ত্রিশ বছর সম,সেক্ষেত্রে তাদের প্রতিক্ষার সময়ের গাণিতিক সমীকরণ হাতে পেতেই যে এক জীবন ফুরিয়ে যাবে..সে খবরই বা কে রাখে.
.প্রতিক্ষা তাই নাবিলার কাছে ভয়ংকর এক অমানিশার নাম,যে শব্দ সে তার জীবন খাতা থেকে বহু আগেই মুছে ফেলেছে।
"জীবনের অপরূপ মুহূর্তগুলো নিজেকেই ছিনিয়ে নিতে হয় বরাবরই।অপরূপ মুহূর্ত গুলো চিনে, নিজের সঙ্গীও করে নিতে হয় সবসময়.." এই সব ভাবতে ভাবতে চা টা হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে দাড়ালো নাবিলা।
না,ইদানীং চাঁদের আলোটা তার ম্লান লাগে না তার কাছে।চাদনী পসর রাতে অতীত স্মৃতির শুষ্ক বেলাভূমি, তাকে আর কাতর করে তুলে না।
আসমানী রঙ সমুদ্র জল আর ছাই রঙ হয়ে ধরা দেয় না তার চোখে।শুষ্ক সমুদ্র বক্ষ জেগে ওঠা সেই ক্ষণস্থায়ী চরগুলো, আর তার সজল চক্ষু জলরাশিমালায় আর জেগে ওঠে না।
চা টা হাতে নিয়ে তার নতুন কবিতা লেখার খাতাটা খুলে বসলো নাবিলা .আরও দু'কলম লিখতে ইচ্ছে করছে তার-
"ইটের চাপার হলুদ ঘাসে,লাগলো আলোর ঝল, চাঁদের আলোয়, শুষ্ক আখি করে টলমল...
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)