অনির্ধারিত

আমাদের কৈশোর

আমাদের কৈশোর
1521837_574926152595661_1189959038_n   আমাদের সাইকোলজির ম্যাম একদিন হটাৎ করেই জিজ্ঞেস করে বসলেন, “মেয়েরা বলতো, মতের অমিল হবার কারণে তোমাদের কার কার মায়ের সাথে ঝগড়া হয়?” একটা দু’টো করে হাত উঠতে লাগলো। একসময় আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, ৯৫% মেয়েই হাত তুলেছে! অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন কারণে হলেও সব পরিবেশের ছেলে-মেয়েদেরই একটা নির্দিষ্ট বয়সে কিছু নির্দিষ্ট সমস্যায় পড়তে হয়। নির্দিষ্ট সমস্যাগুলোর বেশির ভাগই আবেগ ঘটিত কারণ। যেটা সাইকোলজিতে বয়ঃসন্ধিকালীন আবেগ নামে পড়ানো হয়। বইয়ের ভাষায় না বলে যদি বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলি, তাহলে ১, পরিচিত এক মেয়ের (যাকে আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি।) আনুমানিক ১৪-১৬ বছর বয়স পর্যন্ত সমস্যা ছিল, সে কিছুতেই মাকে সহ্য করতে পারতো না। তার ধারণা ছিল তার মা তাকে একেবারেই পছন্দ করেনা। যার কারণে তার বড়ভাই পরিবার থেকে যতটুকু সুবিধা পচ্ছে ততটা সে পাচ্ছেনা। প্রায়ই বলতো, “উনি তো আমার আম্মুই না।” প্রায় প্রত্যেকটা বিষয়েই মায়ের সাথে বিরোধটা ছিল নিত্যদিনের স্বাভাবিক ঘটনা। একটা সময় সমস্যাটা চরম পর্যায়ে উন্নিত হলো। সে কিছুতেই ওই বাসাতে থাকবেনা। ওরা তার কেউনা। এরকম সিরিয়াস অবস্থা। পরবর্তীতে কিভাবে কি হল জানিনা, তবে ওই বয়সটা পার হবার পর তার মায়ের তার এমনিতেই বেশ ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গেল। সাধারণত এটাই হয়। কষ্টে-শিষ্টে ওই সময়টুকু কাটিয়ে দেয়ার পর “কেউ আমাকে বুঝেনা। আমাকে ভালবাসেনা। আমাকে মূল্যায়ন করেনা।” এই চিন্তাগুলো চলে যায়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যেটা দেখেছি, যেসব মেয়েদের পরিবারে্র সাথে এরকম ব্যক্তিত্বের সংঘাত তৈরী হয়, আর তারা সেটা কাটিয়ে উঠতে ব্যর্থ হয়, তারা তাদের বন্ধু-বান্ধবের কাছেই আশ্রয় খোজে, তাদেরকেই সবচেয়ে কাছের মনে করে। কেননা ওই সময়টায় তাদের কিছু সমমনা, সমব্যাথি মানুষের প্রয়োজন হয়। যারা তার সমস্যাগুলোকে উপলব্ধি করবে, তার মত করেই তার সমস্যাগুলোকে ফিল করবে, আর সর্বোপরি তার পাশে দাঁড়াবে। যেহেতু মানুষ সামাজিক জীব, সে কাউকে না কাউকে খুজেই নেয়। এই খুজে নেয়াতে ভুল হলেই জীবনের গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে যায়। এইসময়টায় সঠিক সঙ্গী নির্বাচন যেমন কঠিন থেকে কঠিনতর অবস্থায় ও ভুল পথে পা বাড়াতে বাধা দেয়, তেমনি অসৎ সঙ্গে পড়ে অনেক ভাল ছেলে-মেয়েরাও খারাপ হয়ে যায়। (এ কারণেই সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সতর্কতার প্রতি ইসলাম এত গুরুত্ব দিয়েছে।) পরিবারে অশান্তি, তাই তারা বাইরের জগৎটাতে শান্তি খুজে বেড়ায়। আর তারপর  সমবয়সিদের দেখাদেখি অথবা পাড়ার কিংবা ক্যাম্পাসের বড় ভাই-বোনদের জোড়ায় জোড়ায় ঘুরতে দেখে মনে করে, তাদের মত করে একটা সঙ্গী যোগাড় না করতে পারলে লাইফ ইম্পসিবল। বহু মানুষকে ঠাট্টায় হোক, সিরিয়াসলি হোক, এমন বলতে শুনেছি যে, “সাথের সবগুলার গার্লফ্রেন্ড ওদেরকে ঘুম থেকে উঠিয়ে দেয়। আমাকে উঠানোর কেউ নাই...............” আর মেয়েরা যোগাড় করে কোন মেয়ের কয়টা বয়ফ্রেন্ড, কোন মেয়ে কবে কই কই ঘুরতে গেছে তার খবর। তারপর সেটা নিয়ে গবেষণা। অতঃপর সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা নিজের মাঝেও তৈরী। তাই ছেলেরা পটায়, মেয়েরা পটে। (বিপরীত ও হয়!) আর এরপর পরিবারের চেয়ে কাছের হয়ে যায় দুইদিন আগে পরিচয় হওয়া ব্যক্তিটি। তার কথায় যেকোন নেশা ছাড়া যায়, তৈরীও করা যায়। এই পর্যায়ের পর (যেহেতু দুজনেই অপরিপক্ক বুদ্ধির মানুষ।) অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় নতুন টুইষ্ট! সম্পর্কের টানাপোড়েন, মনোমালিন্য, কষ্ট, হতাশা, ক্রোধ ইত্যাদি। সাইকোলজির ভাষায় হতাশার উৎস তিনটি। পরিবেশগত অর্থাৎ সামাজিক কারণে কোন ইচ্ছার অপূর্ণতা থাকলে, ব্যক্তিগত অর্থাৎ নিজেরই কোন সীমাবদ্ধতার কারণে ব্যর্থতা আসলে, আর দ্বন্ধ। মানে নিজের দুটো ভাললাগা বা পছন্দের মধ্যে কোনটাকে প্রাধান্য দেয়া উচিৎ তা বুঝতে না পারার কারণে যে হতাশা তৈরী হয়। হতাশার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অনেকগুলো দিক আছে। (সব লিখতে গেলে এটা নোটের বদলে বই হয়ে যাবে!) যেগুলো মানসিক স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি করে। অনেক সময় ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ও পরিবর্তন করে দিতে পারে। এর প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হল, বিষন্নতা।  আর পরোক্ষ প্রতিক্রিয়ায় মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে অবদমন।(কোন কিছুতে ব্যর্থ হলে অথবা এমন কোন আকাংখা যদি তৈরী হয় যেটা সামাজিকভাবে স্বীকৃত নয়/যেটা করলে তার সামাজিক মর্যাদা ক্ষুন্ন হবে, তাহলে ব্যক্তির মস্তিষ্ক সেটাকে চেতন স্তর থেকে অচেতন স্তরে পাঠিয়ে দেয়। এভাবে নিজের ইচ্ছাকে চেপে যাওয়াটাই সহজ কথায় অবদমন। পরবর্তীতে এ আকাঙ্ক্ষা যত তীব্র হয়, ব্যক্তির আদম ও অহমের সংঘাত ও তত বৃদ্ধি পায়।)  এ দুটো প্রতিক্রিয়াই অধিকাংশ মানসিক রোগ তৈরীর কারণ। যাহোক, হতাশার প্রতিক্রিয়াগুলো আমাদের খুব পরিচিত। আমাদের আশে-পাশে তাকালেই দেখা যাবে বিষন্নতা আর হতাশায় ভোগা অসংখ্য মানুষ।  পাশের বাড়ির ভদ্র ছেলেটাই হয়ত একদিন হুট করে সিগারেট ধরে। কিংবা ক্লাসের সবচেয়ে চঞ্চল মেয়েটাই হঠাৎ করে একদম চুপ হয়ে যায়। খিটখিটে হয়ে যাওয়া, অনিদ্রা, রুচির পরিবর্তন, ক্ষুদা বেড়ে বা কমে যাওয়া, একাকিত্বে ভুগা, আবার কারো সঙ্গ ও অপছন্দ করা, সুইসাইডের চেষ্টা, নিজেকে/ নিজের দেহকে আঘাত করে তৃপ্তি পাওয়া..., এই সবই হতাশা আর বিষন্নতা থেকে উদ্ভুত। যেটা শেষ সময়ের টিন-এইজারদের প্রধান সমস্যা। আপনি অবাক হবেন যদি কোন মানসিক স্বাস্থ্য নিরাময় কেন্দ্রে যান। সেখানের অধিকাংশই না, প্রায় সবাই টিন-এইজার। সমস্যার সমাধান হিসেবে সাইকোলজিষ্টরা বয়ঃসন্ধিকালীন আবেগকে গঠনমূলক কাজে লাগানোর পরামর্শ দেন। যেকোনো সমাজ কল্যাণমূলক কাজ, অথবা যে বিষয়ে ব্যক্তির বিশেষ দক্ষতা আছে সে সমস্ত ব্যাপারে মনযোগ প্রদান। যেমন কেউ আবৃত্তি, গান, অভিনয়, লেখালিখি, আঁকাআকি, বিতর্ক কিংবা অন্যকোন দিকে দক্ষতা থাকলে সেদিকে সময় দেয়া। এতে করে অপেক্ষাকৃত খারাপ বিষয়গুলোতে যেমন সে সময় দিতে পারবেনা, তেমনি একাকিত্ব, বিষাদ, দুঃখের স্বৃতিগুলো ভুলে থাকাটা সহজতর হয়।

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)