অনির্ধারিত
আবার দেখা যদি হল, সখা, প্রাণের মাঝে আয়-২

আজকে ২১৩ র গল্প বলার কথা, না? চা নিয়ে বসেছেন তো?
এইবেলা একটা গোপন কথা বলে রাখি, আমার হলে আসার অন্যতম প্রধান কারণ এই দক্ষিণমুখী রুমটা। রুমবাসী চারজন, তিনজনই আমার ক্লাসের। আর একজন... অনির্বচনীয়!
হলে আসার আগের দেড় বছর এই রুমবাসীদের যার পরনাই জ্বালিয়েছি। ভরদুপুরে একটা লম্বা ঘুম দরকার? কয়েক সেট কাপড়জামা/বই কোথাও রাখা দরকার? ল্যবরিপোর্টে কিছু করা বাকি, আটটায় ক্লাস ধরার আগে করা দরকার? জুতা/ব্যাগ ছিঁড়ে গেছে,ধার লাগবে? মন খারাপ, কান্নার জন্য জায়গা লাগবে একটা? কিংবা এমন কাউকে দরকার যে ঝেড়ে মন খারাপ উড়ায় দিবে? দুপুরে ভাতের ক্ষিধে লেগেছে, কিন্তু টাকা নাই?
সব সমস্যার একটাই ক্লিয়ারেন্স হাউজ, ২১৩।
এখানের মানুষগুলো অন্যরকম, কারো জন্য কিছু করার দরকার হলে ‘করে’ দেয় শুধু। কিন্তু এতোই স্বাভাবিকভাবে, এতোই নির্বিকারচিত্তে, যে প্রায় অসম্ভব কোন সমস্যার সমাধানের পর ওদের দিকে তাকিয়ে থাঙ্কু বলাটা একটা অপ্রয়োজনীয় বাহূল্য মনে হয়। আর হলে যাবার পর থেকে প্রয়োজনগুলা বদলে গেলো।
প্রথম প্রথম হলের জীবন একটু পিকনিকের মত হলেও আস্তে আস্তে সয়ে এলে জীবনটা বেশ অন্যরকম। যদিও আমার সামনে উইকএন্ডে বাসায় ফেরার হাতছানি ছিলো, তবুও হঠাত করে বুকে চেপে বসা একাকীত্ব অথবা, ‘এই বিশাল জায়গাটায় আমার আত্নীয় কেউ নাই’ এই অনুভূতিটা বেশ ভীতিকর ছিলো। আর আমি নিশাচর মানুষ, রাতের বেলায় এই অনুভূতিটা আরও বিরক্ত করত প্রথম প্রথম।
একদিন লজ্জ্বা পেতে পেতেই চলে গেলাম ২১৩ তে। হাতে কফির মগ, আর বই-খাতা, বলবো, পড়তে এসেছি। রুমে যাবার আগেই বারান্দায় সুরভী মগ নিলো, ‘দে দেখি এক চুমুক!’ বলে মুখে দিয়েই ... ‘ওয়াক থু, চিনি নাই তোর?’। আমি দূর্বল কন্ঠে জবাব দিলাম, আমি চিনি কমই খাই।‘বলবি না আগে?খাডাশ!’ মুখ ব্যদান করে রুমে ঢুকলাম, রুমের একমাত্র সিনিয়র লিভাপু,সেই অনির্বচনীয়, এসে সান্ত্বনা দিলেন, -আরে সুরভীটা এমনই। দে দেখি আমি একটু খেয়ে দেখি... ইয়ে তুই না আসলেই চিনি কম খাস। তিতা লাগে না পাগলী?
আমি ঢুকে যাচ্ছিলাম মানুষগুলোর ভেতর। এভাবেও কেউ কথা বলে? এতো সহজে ভেতরটা দেখা যায় তাদের? এতো স্বচ্ছ তাদের চোখ আর মুখের কথাগুলো? তবে আর যা-ই হোক, আর রিস্ক নিই নাই, এরপর থেকে রুমে গেলে দুই প্যকেট থ্রী ইন ওয়ান দিয়ে এক মগ কফি নিয়ে যেতাম, নিশা বলতো, সিক্স ইন ওয়ান। এই রুমের এতো গল্প এখন ভিড় করে আসছে মনে, সব লিখতে রাত হয়ে যাবে।
অনেক রাত গেছে নিশার সাথে কমিউনিজম আর ইসলাম নিয়ে কথায়-আড্ডায়-তর্কে! কিন্তু কী অদ্ভুত, সেসব পার্থক্য কোনদিন আর কিছুতে দেখা যায় নি, শুধু লাল চোখে ক্লাসে যাওয়া ছাড়া। কেউ শুনলে অবাক হয়ে যেতো, নিশার মত মেয়ের সাথে তুই ঝগড়া করলি? কি নিয়ে? আমরা নির্বিকারচিত্তে জবাব দিতাম, 'দেশ ও জাতি'। জাতি তখন নিরব!
একদিন, চারজন তিন টেবিলে ড্রয়িং করছি।হঠাত শান্তশিষ্ট নিশা আর্তনাদ করে উঠলো,
-আমি আর কতক্ষণ মটর সাইকেল চালাবো?
-ক্যন কি হইসে?
ঘটনা আর কিছুই না, ও একসাথে কাজের জন্য লাবিবার টেবিলে গেছে, ওর নষ্ট একটা স্ট্যন্ডিং ফ্যনের পায়াটা টেবিলের মাঝে রাখা, বেচারী তার পাশ দিয়ে পা দিয়ে বসে আছে।হাসতে হাসতে দম ফাটার অবস্থা!
আর একদিন রুমে গিয়ে দেখি গোছানো মেয়ে সুরভী আপনমনে গজগজ করছে, -খেচরগুলা, সাইজাগুইজা বাইরে যায়। ইচ্ছা করে বয়ফ্রেন্ডগুলাকে এনে দেখায় দেই কোন গুহা থেকে বের হয়ে গেছে। মাসে একবার মশারী উঠায় না...
সুরভী রেগে গেলে আমরা কেউ সাধারণত কথা বলার রিস্ক নিতাম না, কে যায় কোন না কোন মেয়ের আকামের জের নিজের ঘাড়ে টানতে?
এক রাতে, রাত প্রায় দুইটা। হঠাত দরজা খুলে একটা মেয়ে ঢুকলো, ‘সুরভী, খাওয়ার কিছু আছে? আমি ভাত খাইতে ভুলে গেসিলাম’ !!! কিছুই হয়নি এমন ভাব করে সুরভী উঠে হরলিক্স বানিয়ে দিলো, বিস্কুট দিয়ে সেটা খেয়ে মেয়েটা চলেও গেলো। আমি হতবাক, বাকিরা এমন নির্বিকার কেন? এটা কি সম্ভব? কেউ ভাত খেতে কিভাবে ভুলে যায় আর এগারোটায় গিয়ে দেখে ডাইনিং বন্ধ? জানলাম, আর্কিটেকচারের মেয়েরা এই কাজ প্রায়ই করে, সামনে কোন প্রজেক্ট জমার ডেট থাকলে বেশী করে। এই অদ্ভুত সরল মেয়েটার সাথে আমার আরও কথা হয়েছে।
কিন্তু কোনদিন ভাবি নাই একদিন ওর মৃত্যূর খবর শুনবো। আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে ঢাকার রাস্তায় এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে যেতে যেতে আল্লাহর কাছে চলে গেলো ও। আমার ব্যচে মৃত্যূর ঘটনা আরও আছে, কিন্তু এতো কাছে থেকে কাউকে চিনতাম না। দুয়া করি, আল্লাহ নাদিয়াকে তাঁর কাছের করে নিন।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)